আমার ছোট মামা অপু প্রচুর পড়াশোনা করেন । উনার ছোট্ট কুঠুরির সামনে গেলেই পাতা উল্টানোর শব্দ শুনা যাবে । কি এতো পড়ে কে জানে । ভেতর থেকে দরজা সবসময় বন্ধ থাকে । শুধু খাওয়ার সময় চুপচাপ দুটো খেয়ে যান । তারপর ফের পড়াশোনা শুরু । এভাবেই ছোট মামার দিন কাটে ।
এসএসসি পরীক্ষার পর দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে ছিলাম । সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি । ছুটিতে গ্রামে যায় । গ্রামে এসে ছোট মামাকে দেখে বিরাট ধাক্কা খেলাম । যে ছোটমামা দিনরাত দরকায় খিল এটে পড়াশোনা করতো সে এখন দৌড়ে নানান কাজের তদারকি করছে । তখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুর কাটা হচ্ছিল । ছোট মামার ভাবসাব দেখে মনে হলো পুকুর একাই কেটে ফেলবে । সারাক্ষণ লোকদেরকে বকাবকি করছে । মামার এহেন পরিবর্তনে আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম । যে ছেলেটা দিনরাত বসে বসে শুধু বই পড়তো সে এখন পড়াশোনা ছেড়ে দিনরাত কাজ করে । কিভাবে এমন হলো সেটা রাতেই জানা গেল । হারিকেনের আলোয় খেতে বসেছি । ছোট মামা আমার পাশেই । সে শুধু আলুভাজা আর ডাল ভাজা ছাড়া আর কিছু নিচ্ছে না । এটা দেখে আম্মু মামার পাতে এক টুকরো মাছ তুলে দিতেই ছোট মামা হাহাকার করে উঠলো ।
- হায় হায় আপু এটা কি করলা ?
- কেন তুই মাছ খাস না ?
মামা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল । তারাতারি হাত ধুয়ে অজু করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেল । আমরা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম । মামা যখন নামাযা শেষ করলো ততোক্ষণে আমাদের কৌতুহল চরমে পৌঁছেছে । সবাই তাকে চেপে ধরলো আসলে হচ্ছেটা কি ? কেন সে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে ? অনেক জোরাজুরির পর ছোট মামা মুখ খুলেন । তার ভাষাতেই ঘটনাটা বলছি
- তোরা তো জানিস আমি দিনরাত বই পড়ি । শুধু পাঠ্য বই না, সামনে যা পাই সেটাই গিলে ফেলি । একদিন ক্লাসের এক ছেলে রতন এসে বলল, দোস্ত চন্দননগরে বই মেলা হচ্ছে । বইমেলার কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেলো । রতনকে নিয়ে দৌড়ে গেলাম চন্দননগর । গিয়ে দেখি কোথায় বই মেলা! ষাড়ের লড়াই চলছে । মেজাজ এতো খারাপ হলো মনে হচ্ছিল রতনকে ধরে দু'চার ঘা লাগিয়ে দেয় । মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসছিলাম । হঠাৎ কোথা থেকে এক সাধু উদয় হলো । আমার দিকে চেয়ে হেসে বললো 'কি হে বই পাওনি বুঝি? এই নাও' বলে আমার হাতে একটা মোটা চামড়া দিয়ে ঢাকা ডায়েরির মতো কি একটা গুজে দিল । তারপর হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো । ঘটনার আকস্মিকতায় এতো তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম যে কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারিনি কি হচ্ছে । যতোক্ষণে হুশ হলো তখন সাধু লোকটা হেঁটে বহুদূর চলে গেছে ।
বাসায় ফিরে বসলাম সাধুবাবার ডায়েরি নিয়ে । বলা বাহুল্য এটা কোন সাধারণ ডায়েরি ছিল না । তন্ত্রমন্ত্রে ভরপুর ডায়েরিতে অল্পক্ষণেই এতো মগ্ন হয়ে গেলাম কখন যে বিকাল পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে টের ই পেলাম না । সম্পূর্ণ ডায়েরি শেষ করে যখন উঠে বসলাম তখন আমি আর আমি নেই । যাদু বিদ্যার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হলো । অদ্ভুত সব জিনিস পড়ে নিশ্চয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো । ডায়েরিতে সবচেয়ে ভালো অদ্ভুত যে জিনিসটা পড়ে ছিলাম সেটা হলো অদৃশ্য হওয়ার গুপ্ত জ্ঞান । সেই অধ্যায় পড়ে এতো বিমোহিত হয়েছিলাম তখন থেকেই আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে অদৃশ্য হওয়া নিয়েছিলাম । তবে এটা সহজ কোন কাজ ছিলনা । এর জন্য দরকার ছিল সদ্য মৃত কুমারী মেয়ের কবরের মাটি । সেই মাটি আবার আনতে হবে গভীর রাত্রে । ভরদুপুরে আনলে কাজ হবে না । সেই মাটি হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়ে গায়ে ছিটালেই তুমি অদৃশ্য হয়ে গেছো । মন্ত্র নাহয় ডায়েরি থেকে শেখা যাবে কিন্তু কুমারী মেয়ে কোথায় পাব ? রতনকে বলে দিলাম কোথাও কুমারী মেয়ে মারা গেলেই যেন আমাকে জানায় । কয়েকদিন পরে বিকেলে রতন ছুটে এসে জানালো জেলে পাড়ায় এক মেয়ে বিষ খেয়ে আত্নহত্যা করেছে । শুনে হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম । জেলে পাড়ায় গিয়ে দেখে এলাম মেয়েটাকে কোথায় কবর দেওয়া হবে । বাসায় এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন রাত গভীর হবে । বাসার সবাই বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তেই বের হলাম । অদৃশ্য হওয়ার উত্তেজনায় ভয়ডর উবে গেছে । আমাদের বাসা থেকে জেলে পাড়া পনেরো মিনিটের রাস্তা । বিশমিনিটের মাথায় গিয়ে কবরস্থানে হাজির হলাম । কুমারী মেয়েটার কবর বের করতে অসুবিধা হলোনা । নতুন কবর দেখলেই বুঝা যায় ।
মাটি নেয়ার জন্য কবরে হাত দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে কবরটা ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠলো । চমকে উঠে দূরে সরে গেলাম । একি কবর কাঁপছে কেন? নিশ্চয় মনের ভুল । আবার কবরে হাত রাখলাম । এবার আরো ভয়ানক ভাবে কবরটা কেঁপে উঠলো । কিছুটা ভয় পেয়ে হাত সরিয়ে নিলাম । কিন্তু কবর কাঁপতেই থাকলো । মনে হচ্ছে কবরের ভেতর থেকে কেউ বের হয়ে আসছে । এবার সত্যি সত্যি প্রচন্ড ভয়ে পেয়ে গেলাম । থাক বাবা অদৃশ্য হওয়ার দরকার নেই । ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে আসবো এমন সময় পেছন থেকে নাকিকন্ঠে কেউ বলে উঠলো -কিরে মাটি নিবিনা?
এটা শুনে আতংকে আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো । সব কিছু ফেলে দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম । পেছন থেকে তখনো ভয়ানক হাসির শব্দ আসছে । কোনরকমে বাসায় পৌঁছলাম । তারপর থেকে শুধু শুনি সেই কন্ঠ আমায় বলে চলেছে কিরে মাটি নিবি না? আয় আয়' । তাই নিজেকে এখন নানারকম কাজে ব্যস্ত রাখি এইসব ভুলে থাকার জন্য ।
ছোট মামার এই ঘটনা শুনে সে রাতে ভয়ে ঘুমুতে পারিনি । বারবার মনে হচ্ছিল সেই কন্ঠটা এসে আমাকে বলবে 'কিরে মাটি নিবি না? আয় আয় ' । পরদিন সকালে গ্রাম ত্যাগ করলাম ।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩০