সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনো কোন তরুণের চোখে যে উজ্জ্বল আভা থাকে তা এতোদিনে মিলিয়ে গেছে। গ্রাজুয়েশনের আট মাস হয়ে গেলো কোন চাকরি নেই। চরম অর্থকষ্টে ভুগছি। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে পরিত্যাগ করেছে। কিছুদিন আগে দিপ্তর বিয়ে গেলো। আমার সকল বন্ধু নিমন্ত্রণ পেলো,আমি পেলাম না। সেদিন রাস্তায় অপুকে দেখলাম। আমাকে দেখে এমন ভান করলো যেন এই প্রথম দেখছে।
এইসব ঘটনার পর নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। পুরোনো একটা মেস খুঁজে বের করে সেখানে গিয়ে উঠলাম। প্রয়োজন না হলে বের হয়না। কেউ গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে এলে তৎক্ষণাৎ কেটে পড়ি।
সেদিন সন্ধ্যায় টিউশনি শেষ করে মেসে ফিরছি। প্রবল বর্ষণে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। মাথার উপর ছাতা ধরে রেখেছি।তবু ভিজে যাচ্ছি। এই রকম বৃষ্টি আজকাল বেশি হয়না। ইচ্ছা হলো ছাতা নামিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যায়। লোকলজ্জার ভয়ে পারছিনা। ছাতা হাতে নিয়ে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি, লোকে দেখলে নিশ্চয় পাগল ভাববে। হুশকরে পাশ দিয়ে একটা মোটরসাইকেল গেল।নোংরা পানি ছিটকে এসে পড়লো আমার গায়ে। গালি দিতে গিয়েও থেমে গেলাম।বাইকওয়ালা ততোক্ষণে বহুদূর চলে গেছে।
রাস্তায় পানি বাড়ছে।আগে গোড়ালি তে ছিল। এখন সেটা হাটুর কয়েক ইঞ্চি নিচে । এতো ভয়ানক বর্ষনে শহরটা নিশ্চয় কয়েকদিনের জন্য অচল হয়ে যাবে।বৃষ্টিতে পুরো ভিজে যাচ্ছি।পকেটে হাজার দুয়েক টাকা। টাকার মায়ার জন্য সামনে একটা বহুতল ভবন দেখে দাঁড়ালাম।শরীরটা ঝেড়ে একটু শান্ত হলাম।
আশেপাশে কেউ নেই,শুধু একজন ছাড়া।লোকটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে।সামনে পলিথিনের ব্যাগে প্রচুর বই রাখা।নিশ্চয় লোকটা ফুটপাতে বই বিক্রি করে।
-ভাইজানের কাছে সিগারেট আছে?
শুনে চমকে উঠলাম। লোকটা সিগারেট চাচ্ছে?অপরিচিত লোকের কাছে এভাবে সিগারেট চাওয়া যায়?
ভদ্রতার খাতিরে একটা সিগারেট আর লাইটার এগিয়ে দিলাম। লোকটা সিগারেট ধরালো।
-ভাইজান শুকরিয়া। এই বৃষ্টি আজ সারারাত চলবো। সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়বো। যেতে চাইলে এখনই চলে যান।
-তুমি কি করে জানলে বৃষ্টি থামবেনা?তুমি কি জোতিষী?
শুনে লোকটা হেসে উঠলো। তারপর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। অবাক হয়ে বইটা হাতে নিলাম। বইয়ের উপরে লেখা 'জন্মান্তর রহস্য'। ভৌতিক বিষয়ের উপরে লেখা বই। আজকাল এইসব কেউ পড়ে?
আমি বইটা থেকে চোখ সরিয়ে পাশে বসা লোকটার দিকে তাকাতে ভয়াবহ চমকে উঠলাম। হায় আল্লাহ! জায়গাটা পুরো খালি। লোকটা কোথায় গেল?চারপাশে তাকানোর কোন মানে নেই। লোকটা যদি সামান্য নড়াচড়াও করতো তাহলেও সেটা শুনতে পেতাম। চোখের পলকে লোকটা হাওয়া হয়ে গেল। অজানা এক ভয় আমায় ঝেকে ধরলো।
তাড়াতাড়ি রাস্তায় উঠে এলাম। হাটু সমান পানি রাস্তায়। হাঁটতে যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু আতংকের কাছে সব অসুবিধা তুচ্ছ। দ্রুত পা চালালাম। কোন অশরীরীর পাল্লায় পড়েছি কে জানে । কোনমতে মেসে পৌছুলাম । কাপড় পালটে শোয়ার পর কিছুটা শান্ত হলাম।'জন্মান্তর রহস্য' বইটা পাশের টেবিলে পড়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো এই বইটার জন্যই সব কিছু হয়েছে । সঙ্গে সঙ্গে বইটাকে তুলে রাস্তায় ছুড়ে দিলাম।সেদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে।
কিছুদিন পর চাকরির একটা ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিলাম । হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশ দিয়ে ঋতু যাচ্ছে। কলেজ জীবনের ভালবাসাকে দেখে সারা শরীরে আনন্দের শিহরন বয়ে গেলো।কিন্তু পরমুহূর্তেই হৃদয় আনন্দের বদলে ঘৃণায় পূর্ণ হলো।কোন এক অচেনা ছেলের হাত ধরে ঋতু হেঁটে যাচ্ছে । প্রচন্ড রাগ নিয়ে মেসে ফিরলাম ।
একটা সামান্য চাকরির জন্য আজ ঋতু অন্য ছেলের হাত ধরে রয়েছে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ টেবিলের উপর চোখ আটকে গেল। 'জন্মান্তর রহস্য' বইটা পড়ে আছে সেখানে। কিন্তু সেদিনতো আমি বইটা ফেলে দিয়েছিলাম।আবার এখানে কিভাবে এলো? কিছুটা অবাক হয়ে বইটা হাতে নিলাম। বই পড়লে কিছুক্ষণ ঋতুর ব্যাপারটা ভুলে থাকা যাবে সেই আশায় বইটার পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। তখনি এক জায়গায় এসে চোখ আটকে গেল 'কালো যাদু'। আগ্রহের বশে পড়তে শুরু করে পুরো ডুবে গেলাম। যখন পড়া শেষ করলাম তখন প্রতিশোধের আগুন আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় তৃণার বাসায় গেলাম। তৃণা ঋতুর বেষ্টফ্রেন্ড। আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
-তৃণা তোর কাছে একটা জিনিস চাইলে দিবি?
-কি জিনিস বল।
ভয়ে ভয়ে বলল তৃণা।
-বেশি কিছুনা।ঋতুর চুল।
শুনে তৃণা হেসে ফেলল।
-তুই এখনো তাকে মিস করিস তাইনা?
-হু।দিবি?
তৃণার বাসা থেকে যখন ফিরলাম তখন আমার হাতে ঋতুর একগুচ্ছ চুল।জানতাম তৃণার কাছে ঋতুর চুল পাবো।ঋতু তারকাছেই সাজগোজের জন্য আসে। মেসে আসার আগে নীলক্ষেত থেকে একটা কালো বিড়াল কিনে এনেছি।
মেসে এসে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলাম।
গোসল করে পবিত্র হয়ে মেঝেতে বসলাম।কালো বিড়ালটার পেটে কিছুক্ষণ আগে মন্ত্র পড়ে চুরি চালিয়েছি। সেই রক্ত দিয়ে আমার চারপাশে চক্র আঁকলাম, তারপর বইটা থেকে শেখা মন্ত্রটা আওড়াতে লাগলাম। চক্রের মাঝে বসে আমি একটা মাটির পুতুল হাতে নিলাম। খুব যত্নে সেটার গায়ে ঋতুর চুল পেচিয়ে দিলাম।অতঃপর একটা মোমবাতি জ্বেলে পুতুলটা মোমবাতির আগুনের উপর ধরলাম। এক মূহুর্ত কিছু হলোনা। কিছুক্ষণ পর মনে হলো বহুদূর থেকে আমার কানে চিৎকার ভেসে আসছে। ঋতুর চিৎকার । আগুনে পোড়ানো ব্যক্তিরা যেভাবে চিৎকার করে ঠিক সেভাবে ঋতু চিৎকার করছে। যদিও সে এখন আমার কাছ থেকে শতমাইল দূরে তবুও তার যন্ত্রনাময় চিৎকার আমার কানে আসছিল। মোমবাতির উপর থেকে পুতুলটা সরালাম। না আর দেরি নয়।প্রচন্ড টানে এক এক করে আলাদা করে ফেললাম হাত পা । ঋতুর তীব্র চিৎকার আমার কানে মধুবর্ষণ করছে। অবশেষে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করতেই চিৎকার থেমে গেলো। শেষ। বিদায় হে ঋতু,তুমি জানতেও পারলেনা কে তোমায় হত্যা করলো।
পরদিন ঋতুর বাসার সামনে গেলাম।সবাই কান্নাকাটিতে ব্যস্ত। কেউ খেয়াল করলোনা আমায়। ঋতুর লাশের সামনে দাঁড়ালাম। শরীর থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পৈশাচিক শক্তির কেউ হাতপা টেনে ছিড়ে ফেলেছে। সেই সাথে পুড়ে গেছে ভেতরের সবকিছু। হাসি গোপন করে বেড়িয়ে এলাম। রাস্তায় আসতেই সেই বইওয়ালা লোকটাকে দেখলাম।আমার দিকে মুচকি হেসে বলল 'লুসিফারের জগতে স্বাগতম'।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:২৫