ঘটনাটা আশির দশকের। তখন আমরা গ্রামে থাকতাম। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোলাহল শুনতে পেলাম। বাইরে গিয়ে দেখি বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের দশ গ্রামের লোকজন সেখানে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে দেখার কৌতুহল হলো। তাই সামনে এগোলাম। ছোট ছিলাম,তাই জনগণের ফাঁক গলে সামনে এগোতেই দেখলাম মাঝখানে 'তানবাদশা' হাটু ক্রস করে মাটির উপর বসে আছে। বুঝলাম কেন এই সাতসকালে লোকজন জড় হয়েছে।
সবাই এসেছে এই 'তানবাদশাহ' কে দেখতে। তখন ছোট বড় সবাই এই তানবাদশাহর নাম জানতো। সে ছিল তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ যাদুকর । আমি অনেক ছোট থেকে এই তানবাদশার কথা কথা শুনে আসছি। বলা হয়ে থাকে তানবাদশাহ একবার আস্ত ষাড়কে মানুষে রুপান্তরিত করেছিলেন। মানুষ হওয়ার পরেও সেই ষাড়টা নাকি অন্যসব ষাড়দের মতো দুহাতপায়ে হাঁটতো আর বিকটভাবে চেচাঁতো। পরে সেই মানুষরূপী ষাড়টাকে নাকি গ্রামের লোকজন মিলে কুরবানী করে দেই। এমনকি কিছু কিছু লোক সেই মাংসও খেয়েছে।
যায়হোক 'তানবাদশাহ' কে আমিও মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম। তার বয়স কত কেউ জানেনা। গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ লোকটার দাদাও নাকি তানবাদশাহর গল্প করেছে। খালি গা,পরনে শুধু একটি লাল রঙের লুঙ্গিতে তাকে সন্ন্যাশীর মতো লাগছিল। চোখ বন্ধ করে যেন ধ্যান করছে। বেলা যতো বাড়তে লাগলো,ভীড় ততো বাড়তে থাকলো। গ্রামে এইধরনের ঘটনা সচরাচর ঘটেনা। তাই সকলে খুব আগ্রহভরে তানবাদশাহকে দেখতে আসছে।
একপর্যায়ে তানবাদশাহ চোখ খুলল।চারদিকে কটমট করে তাকাতেই সকলে কিছুটা পিছু হটলো। সেই সাথে গুঞ্জন ও থেমে গেল।চারপাশে তখন এক আশ্চর্য নীরবতা। তানবাদশাহ মনে হয় এতে সন্তুষ্ট হয়নি। সে তার হাত দিয়ে মাটিতে একবার আঘাত করতেই তার চারপাশে গোল করে আগুন জ্বলে উঠে মুহূর্তের জন্য।অতঃপর নিভে যায়।এটা দেখে লোকজন আরো পিছিয়ে যায়। এইবার তানবাদশাহ কিছুটা শান্ত হলো।আমি তখন হতভম্ব। হঠাৎ করে আগুন কোথা থেকে উদয় হলো আর কোথায়বা মিলিয়ে গেল?
এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে আবার তাকালাম তানবাদশার দিকে। এবার সে মাটি নিয়ে কিছু করছে।দুহাতে মাটি নিয়ে সেগুলো সে উপরে ছুড়ে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো পাখিতে পরিনত হলো। এতো সুন্দর ও আর বিচিত্র পাখি আর কখনো দেখিনি । লোকজন বিস্ময় ধ্বনি প্রকাশ করলো সেটা দেখে।কিছু কিছু উৎসাহী লোক "মারহাবা" বলে চিৎকার শুরু করে দিল।
এইবার সে যে কাজটা করলো সেটার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের বাসার দক্ষিণে একটা ছোট আম গাছ ছিল। তানবাদশাহ সেই গাছটার কাছে গিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বললো। তারপর দুহাতে গাছ টাকে ধরে প্রচন্ড ভাবে ঝাঁকাতে লাগলো।সাথে সাথে আঙুরের বৃষ্টি শুরু হলো। গ্রামের লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়লো আঙুর ফলগুলো ধরতে।
আমগাছ থেকে অনবরত আঙুর ঝড়ছে। আমরা দুহাতে সেটা মুখে পকেটে ভরছি। অবশেষে যখন তানবাদশাহ থামলো ততোক্ষণে আমাদের সকলের ঝুরি ভরে উঠেছে আঙুর ফলে। এরপর সে সোজা হাঁটা শুরু করলো নদীর ঘাটের দিকে। আমরা তার পিছুপিছু গেলাম। তারপর তানবাদশাহ একটা নৌকায় উঠে চলে গেলেন। যতক্ষন তাকে দেখাযাচ্ছিল ততক্ষণ সবাই নদীর দিকে তাকিয়েছিল। আমরা দীর্ঘদিন সেই আঙুরফল খেয়ে শেষ করতে পারেনি।
তখন ছোট ছিলাম। তাই এতোকিছু মাথায় আসেনি। এখন মাঝে মাঝে ভাবি এটা কিভাবে সম্ভব যে গাছ ঝাঁকালে বৃষ্টির মতো ফল ঝড়ে?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:১৯