তখন পুরো শীতকাল চলছে।গাছের সব পাতা পড়ে গেছে।বিকেলবেলা বের হলে দেখা যায় সকলের গায়ে শীতবস্ত্র। সন্ধ্যাবেলা বের হলে কারো মুখ দেখা যায়না।সবার চোখমুখ কাপড়ে ঢাকা।সন্ধ্যা শেষ হলে রাস্তা পুরো খালি।যে কুকুরটা গভীররাতে ডাকাডাকি করে পাড়ার লোকদের বিরক্তি উৎপাদন করতো,সেটাকেও সন্ধ্যা মেলালে আর রাস্তায় দেখা যায় না।এমনি এক শীতে ডাক এলো দাদুবাড়ি থেকে।শীত গ্রামের লোকদের কাছে বিয়ের মৌসুম।চাচাত ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।অবশ্যই যেতে হবে।অফিসের বসের দীর্ঘদিনের চা'য়ের সঙ্গী আমি।ছুটি পেতে কোন অসুবিধা হলোনা।যেদিন ছুটি পেলাম সেদিন বিকেলে লাগেজ গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম।বিকেলের ট্রেন ধরে রওনা হয়ে গেলাম গ্রামের বাড়ি।
আমার গ্রামের বাড়ি বটতলায়।গ্রামের প্রবেশপথে প্রচুর বটগাছ থাকায় এই নাম।বাংলাদেশের আর কোথাও এক সাথে এতো বটগাছ নেই।মানিকগঞ্জ রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম তখন রাত প্রায় দশটা বাজে।পুরো পাঁচ ঘন্টা সময় বসে কাটিয়েছি।আড়মোড়া ভেঙে লাগেজটা টেনে নিয়ে স্টেশনের এক কোণায় গিয়ে বসলাম।একমাত্র এই দোকানটা খোলা আছে।চা এলো।স্টেশনের চা নাকি সবচেয়ে ভাল হয়।কিন্তু এই দোকানের চা'য়ে একচুমুক দিতেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এতো বিস্বাদ চা! তবু কোনমতে খেয়ে নিলাম।এইজন্য না যে দোকানদার আমায় আবাল ভাববে।এইজন্য যে মানিকগঞ্জ থেকে বটতলা প্রায় ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা।এই শীতে এতোদূর রাস্তা পাড়ি দিলে ঠান্ডায় জমে যাব।তাই কোনভাবে গরম চা শেষ করে উঠে বসলাম।
এতো রাতে কিছু পাওয়া গেলনা।দুতিনজন রিক্সাওয়ালাকে যাও পেলাম তারা বটতলা যাবেনা।বটগাছে নাকি "খারাপ" কিছু থাকে।তাদের কথা শুনে বিরক্ত হলাম।যাবেনা বললেই হতো।এতো অজুহাতের দরকার ছিলনা।সিদ্ধান্ত নিলাম এতো রাতে পায়ে হেঁটে গ্রামে যাবার কোন মানে হয়না।আজ রাত স্টেশনে থেকে যায়।তাই আবার হেঁটে গিয়ে চায়ের দোকনাটার সামনে গিয়ে বসলাম।
কিছুক্ষন পর দেখলাম স্টেশন মাষ্টার তার ঘরে তালা মেরে চলে যাচ্ছে।আশ্চর্য! যাবার আগে স্টেশনের সব লাইট নিভিয়ে দিয়েছে।পুরো স্টেশন অন্ধকার।এখন দোকানীর লাইটটাই আলোর উৎস।একটু পরে দোকানীও দোকান বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।ফলে অবশিষ্ট যে আলোটা ছিল সেটা এখন আর নেই।আক্ষরিক অর্থে এখন পুরো স্টেশন ঘুটঘুটে অন্ধকার।আলো নিভে যাওয়ায় শীত আরো জেঁকে বসেছে।এখানে সারারাত কিভাবে বসে থাকবো?একটুপরে মনে হলো এই ভয়ানক অন্ধকারে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বের হয়ে গেলাম।নক্ষত্রের আলোতে বাইরে এসে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়ে কিছুটা শান্ত হলাম।আমি ভীতু নয়।তাই অতিপ্রাকৃত কিছুর ভয় আমার ছিলনা।তাই এবার সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রামে ফিরে যায়।এতো রাতে আমাকে দেখে তারা নিশ্চয় খুব অবাক হবে।
স্টেশন থেকে বটতলার রাস্তাটা সুবিধের নয়।মাটির রাস্তা।বর্ষাকালে এর অনেকটা পানির নিচে থাকে।কিন্তু শীতকালে সম্পূর্ন শুকনো।রাস্তায় নামতেই শীত আরো জেঁকে ধরলো।দুপাশে উন্মুক্ত ধানি জমি।আকাশে চাঁদ নেই।তবুও চারদিকে দেখতে অসুবিধে হচ্ছেনা।এর মাঝে আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি।এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটলো।অনেকদূর এগিয়েছি।তখন যে জায়গাটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটার নাম ছিল "চড়গ বিল"।গ্রামের মানুষরা বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে এটা বানিয়েছিল।দেখতে অতিকায় বলে এমন নামকরণ।সে জায়গায় আসতেই লক্ষ্য করলাম, ঠান্ডাটা কেমন যেন কমে গেছে।দীর্ঘসময় পরে গরম অনুভব করছি।কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে।আর কিছুদূর এগোলাম।বিলটা একদম সামনে।তখনি নড়াচড়া চোখে পড়লো।ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম বহুলোক চড়গবিলের পাড়ে জড় হয়েছে।নিশ্চয় কিছু হয়েছে।সেই লোকগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম।আশা যে এতো লোকের মধ্যে নিশ্চয় আমার গ্রামের কেউ থাকবে।তখন এক সাথে যাওয়া যাবে।লোকগুলোর একদম কাছে পৌছে গেলাম।সামনের লোকটার কাধে হাত রাখলাম।মনে হলো গরমে হাতটা পুড়ে যাবে।সঙ্গে সঙ্গে লোকটি পেছনে ফিরে তাকালো।তারদিকে চেয়ে আমি একটা আর্তনাদ করে লাফিয়ে দূরে চলে এলাম।একি দেখছি আমি?লোকটির মুখে মনে হচ্ছে কিছু পোড়ানো হচ্ছে।অনবরত সেখানে আগুন জ্বলছে।চোখ দুটো দেখে মনে হলো, চোখের অপর পাশেও আগুন জ্বলছে।ভয়ানকভাবে জ্বলজ্বল করছে।হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে আতংকে আমি জমে গেলাম।নড়তে পারছিনা। আমি শেষ।অশরীরীটা নিশ্চয় আমাকে মেরে ফেলবে।তখন অবাক হয়ে দেখলাম সেই প্রেতাত্মা ধীরে ধীরে আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার সামনে থাকিয়ে রইলো।বিলের পানির দিকে।একসাথে এতোগুলো অশরীরী দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।একসময় খেয়াল করলাম তারা সকলে সামনে তাকিয়ে আছে।ধীরে ধীরে জায়গাটা থেকে দূরে সরে এলাম।রাস্তায় উঠে হাঁটা শুরু করলাম।কিভাবে যে বাড়ি পৌছেছি সেটাও এক আশ্চর্য।হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে আবিষ্কার করি আমি বিছানায় শুয়ে আছি।নিশ্চয় আমার আতংকগ্রস্থ অবচেতন মন আমাকে নিয়ে এসেছে।সেবারের মতো বেঁচে গেলাম।পরে গ্রামের এক চাচাকে ঘটনাটা বলে, জিজ্ঞাস করেছিলাম " তারা" কে ছিল?তখন উনি বলেছিলেন তারা একধরনের জ্বিন ছিল।গভীর রাত্রে দলবেধে বিলে মাছ খেতে এসেছিল।গ্রামের আরো অনেকে তাদের দেখেছে।ভাগ্যিস তাদের ক্ষিধে ছিলনা।তানহলে আমি আজ তাদের পেটে থাকতাম।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৭