গ্রামের নাম কান্দাড়িয়া।অত্যন্ত দূরের এক গ্রাম।দুদিকে ঘন জঙ্গল।একদিকে নদী।যা গ্রামটাকে আধুনিক সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।তাই প্রথম এসে যখন দেখলাম গ্রামে বিদ্যুৎ নাই,তখন এতো অবাক হলাম না।।গ্রামটার জন্য কিছু উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্ল্যান করা হয়েছে।তাই পর্যবেক্ষণের জন্য আমি এসেছি।আমাদের এনজিও মোটামুটি বেশ বড় সংগঠন হলেও এইরকম প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের কোন নেটওয়ার্ক নেই।তাই কোন স্থানীয় লোকের বাড়িতেই থাকতে হবে।আর বিপত্তি বাধলো তখনি।গ্রামের মানুষ গুলো ভীষণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন।তারা সবসময় বাইরের লোকদের এড়িয়ে চলে।এমনকি বাইরের লোকদের সাথে সম্পর্ক করা থেকেও দূরেও থাকে। ফলে বিয়েশাদীও নিজেদের মধ্যেই করে।তাই আমাকে যে তারা ভালভাবে নিবে না সেটা আগেই জানতাম।গ্রামের কোন লোক আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হলো না।এক লোককে বললাম আমি টাকা দিতে রাজি আছি তবুও ওদের কাছ থেকে কোনরূপ সাহায্য পেলাম না।অন্যদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।একটু একটু করে শীত পড়ে যাচ্ছে।গ্রামে আসার সময় নৌকাওয়ালা বলেছিল এই গ্রামে প্রচুর শেয়াল আছে।রাতের পর ঘর থেকে বের হওয়া যায়না।তাই শেয়ালের ভয়টাও আমাকে ঝেঁকে ধরলো।রাতে কোন অবস্থাতেই বাইরে থাকা চলবে না।
বহু অনুরোধের পর গ্রামের একজন বৃদ্ধ দয়াপরবশ হয়ে বলল গ্রামের উত্তরদিকে একটি পুরোনো বাড়ি আছে।বহুকাল থেকে পরিত্যক্ত।ঐখানে থাকতে চাইলে আমি নাকি থাকতে পারি।বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনে বেশ স্বস্তি লাগলো।যাক বাইরে থেকে অন্তত শেয়ালের ডিনার হতে হলোনা।
যদিও বলেছিলাম বাড়িটা আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারবো,তবুও বৃদ্ধ লোকটি আমার সাথে এলো।বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম।দোতলা বাড়ি,দেখে মনে হচ্ছে কোন জমিদারের বাসা।তবে খুব পুরানো তাতে কোন সন্দেহ নেই।জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে।শেওলা জন্মেছে অনেক স্থানে।একরামুল চাচা মানে বৃদ্ধ লোকটা মনে হলো বাড়িটা খুব ভাল করে চেনে।আমাকে যে ঘরে নিয়ে গেল সেটা দেখে মন ভরে গেল।সম্পূর্ণ পরিষ্কার।মনে হচ্ছে নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় জায়গাটার।একরাম চাচার কাছে জানতে
পারলাম বাড়িটা উনার দাদার ছিল।এইরুমটাই শুধুমাত্র অক্ষত আছে।তাই মাঝেমাঝে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন।অন্যরুমগুলোর কিছু কিছু ভেঙে পড়েছে।কিছুকিছু সাপের বাসা।তাই সেগুলোর যত্ন নেওয়া হয়না।রাত্রে খাবার দিয়ে যাবেন বলে উনি চলে গেলেন।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।সারাদিনে প্রথমবারের মতো খেয়াল করলাম আমি ভীষণ ক্লান্ত।চাচা একটা মোমবাতি দিয়ে গিয়েছিল।সেটা জ্বালিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।সাথে সাথে দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা।ঘুমের-ঘোরেই হঠাৎ মনে হলো কিছু একটা আমার শরীরকে উপরে তুলে ফেলছে।অতঃপর প্রচন্ড শক্তিতে ছুড়ে ফেলল পাশের দেয়ালে।ঘোর কেটে গেল।প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে লক্ষ করলাম আমি দেয়ালে ভর দিয়ে পড়ে আছি।বিছানা থেকে কয়েক হাত দূরে।তবে কি কেউ সত্যিই আমায় ছুড়ে ফেলেছে?ঘটনাটা স্বপ্ন ছিলনা?চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্র একরাশ ভয় ঘিরে ধরলো আমায়।কোনমতে বিছানায় গিয়ে বসলাম।নিজেকে বোঝালাম আমি নিশ্চয় ঘুমের হাটছিলাম।একসময় দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম।রাত দশটা বেজে তেত্রিশ মিনিট।একরাম চাচা এখনো আসেনি?আমি আবার শুয়ে পড়লাম।
আধো ঘুম আধো জাগরণের এক পর্যায়ে আছি।হঠাৎ মনে হলো আবার উপরে উঠছি।তবে এবার আমি একা নয় আস্ত বিছানা উপরে উঠে যাচ্ছে।সম্পূর্ণ ভাবে ঘুম কেটে গেল।প্রচন্ড আতংক নিয়ে দেখলাম পুরো বিছানাসহ আমি মাটি থেকে কয়েকফুট উপরে উঠে গেছি।ধীরে ধীরে বিছানাটা উল্টে যাচ্ছে।কল্পনা করুন আপনি বিছানায় বসে রয়েছেন।হঠাৎ সেটি উপরে উঠে গেল।একটু পরে উলটে গেল।তখন আপনি বিছানার নিচে আর বিছানা উপরে।এই অবস্থায় যদি নিচে পড়ে যান আর আপনার উপরে আস্ত বিছানা পড়ে তাহলে কি হবে?হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে।কোন অশরীরী শতবর্ষ পুরানো এক বিছানা আমার উপর ফেলে আমাকে মারতে চাইছে।বেঁচে থাকার আদিম ইচ্ছার জন্যই হোক বা অন্যকারণে,আমি উপর থেকে লাফিয়ে নিচে নেমে সোজা দরজার দিকে ছুটলাম।কিন্তু দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।হায় আল্লাহ, শেষে বদ্ধ করে মরতে হবে?ঈশ্বরের নাম নিয়ে দরজায় প্রচন্ড আঘাত করতেই দরজা খুলে গেল।সাথে সাথে বাইরে চলে গেলাম।
বাড়ির বাইরে এসে পড়লাম।গভীরভাবে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।তখনি পেছনে প্রচন্ড শব্দ হলো।পেছনে তাকিয়ে দেখলাম,আমি যে ঘরটায় ছিলাম সেখান থেকে শেয়ালের অবয়বের মতো কিছু একটা বের হচ্ছে।অবয়বটার পুরো শরীর থেকে উজ্জ্বল নীল আলো বের হচ্ছে।এটা দেখে ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।প্রচন্ডভাবে ছুটতে শুরু করলাম।বার বার মনে হচ্ছিলো থেমে গেলেই শেয়াল রুপী অশরীরীটা ছিড়ে ফেলবে আমায়।দৌড়াতে দৌড়াতে নদীর ঘাটে হাজির হলাম।ভাগ্য ভালো ছিল।নদীর ঘাটে পাশের গ্রামের কয়েকজন জেলে ছিল।তারা আমার ভয়াবহ অবস্থা দেখে শহরে পৌঁছে দেয়।ফলে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৪৩