প্রত্যেকটা মসজিদে সাধারনত ওই এলাকার কেউ মারা গেলে তার লাশ বহনের জন্য একটা খাট থাকে।
.
আমার বাবা,চাচারা ৩ ভাই,এক বোন।এরমধ্যে এলাকায় আমার বড় চাচাকে ছাড়া আমার আব্বু বা ছোট চাচাকে কেউ চিনেনা।বড় চাচাকেই যতটুকু চিনে সবাই। মান্য করে।গতবছর ঈদের নামাজে বসে মসজিদে বসে চাচা কথা দিয়েছিল একটা খাট দিবে মসজিদে।২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখে চাচা মসজিদে একটা খাট দেয়।সেটা অর্ডার দিয়ে তৈরি বিধায় একটু লেট হয়েছিল তার সেটা মসজিদে দিতে।
.
মুলত প্রত্যেকবার ঈদেই চাচা কিছু না কিছু দেয়।এলাকায় মোটামোটি আমাকে বা বাবাকে বা ছোট চাচাকে যারা চিনে সবাই চিনে বড় চাচ্চুর ভাই হিসেবেই।নিজস্ব বাসা এখানে।যুদ্ধের সময়কাল থেকেই শুনেছিলাম।
.
তো এবারে আসি মুল ঘটনায়।অক্টোবর ১৬ তারিখ শুক্রবার রাত ১০.৩০ এ চাচার ফোনে একটা কল আসে।শুক্রবার ছিলো বিধায় চাচা আগেই বাসায় ফিরেছিল।বাবাও আগে ফিরত।কিন্তু ওইদিন ১০.৩০ এও খবর নেই তার।অবশেষে চাচার ফোনে কল আসার পরেই দেখলাম যে আম্মু কি যেন শুনে কেঁদে উঠলো।আমি বুঝতেই পারলাম না।
.
অবশেষে জানলাম বাবাকে কোপানো হয়েছে।আমি শুনার সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলাম ঘটনাটা কে ঘটিয়েছে।আম্মু আর চাচীও বুঝতে পেরেছিল।বড় চাচা জানত না বাবার কর্মচারীর সাথে বাবার ঝামেলা চলছে সেটা জানলে চাচা অনেক কিছুই করতে পারতেন।তার হাতে ছিল।
.
অবশেষে হসপিটালে গেলাম,সেখান থেকে ঢাকা পাঠানো হলো।মাঝপথেই বাবা মারা গেলো।যদিও আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।একটা বিশ্বাস ছিল আল্লাহ এমন করবেন না।বাবার পা দুটো আমার কোলের উপরে ছিল। আমি আদর করতে ছিলাম।ব্যাথায় ছটফট করছিল গাড়িয়ে বসে।বার বার মুখ থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ আর বলছে শ্বাস নিতে পারছেনা।একটা মুহুর্ত নিজেকেই নিজের কাছে মৃত মনে হলো আমার।রাত যখন ৪ টা গাড়ির সকল লাইট তখন বন্ধ।হঠাৎ বাবার পা নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেলো।তার আগে শুধু একটাই শব্দ ছিল তার মুখে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ,আল্লাহ তুমি আমার ছেলে মেয়েকে দেখো।আর চাচাকে অনুরোধের সুরে বলে গেলেন আমাদের যেন সে দেখে রাখে।" আমার দাদা মারা গিয়েছে ২০০৯ সালে।তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন -"বাবা আমি আসছি।" নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো।আমি পায়ে হাত বুলাচ্ছি আর আল্লাহকে ডাকছি শুধু।
.
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কোপ হয়ত কোন মানুষ সহ্য করতে পারতেন না।তবুও আমার বাবা ছোটবেলা থেকেই খুব শক্তিসামর্থ্য মনের মানুষ শুনেছি দাদীর মুখে।
.
ভোর ৭.৩০ এ আমরা ঢাকা পৌঁছালাম।তখন বাবাকে মৃত ঘোষনা করা হলো।বড় চাচার চশমা পানিতে ভিজে গেলো।আমি, আম্মু গাড়ির ভিতরেই ছিলাম।আর বুঝতে বাকি নেই।শুধু চাচাকে বলেছিলাম -" চাচ্চু ওদেরকে তুমি ছেড়োনা।" আমার পবিত্র বাবার শরীরে যারা আঘাত করেছে,আমাদের এতিম করেছে আমি বেঁচে থাকতে তাদেরকে ভুলবোনা।শাস্তি তারা পাবেই।
.
পরে বরিশাল ফিরতে আমাদের ৩ টা বেজে যায়।এরপর পোস্টমর্টেম করে বাবাকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে।দুইটা জানাজা দু জায়গায় সম্পন্ন করার পরে অক্টোবর ১৭ শনিবার রাত ৯টার দিকে বাবাকে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
.
এর ৩ দিন পরে মসজিদে মিলাদের পর চাচ্চু আফসোস করতে থাকে আর বলতে থাকে -"যেই খাটটা আমি কিনে দিয়েছিলাম মৃত লাশকে বহনের জন্য সেই খাটেই সর্বপ্রথম আমার ভাইকে বহন করতে হলো আমাকে আর তার ছেলেকে"....
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ দুপুর ১২:২৫