রিপোর্টখানা কোনোমতে হাতে দিয়ে মুখ নীচু করে, বলতে গেলে চোখ কান বুজেই সেখান থেকে একপ্রকার ছুটে পালালেন পতিদেবতা। শিরি হাতে রিপোর্ট নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখবে কি, পতিদেবতার তড়িঘড়ি পলায়নপর গমন পথের দিকে হা করে চেয়ে রইলো সে। হলো কি? এমন চোরের মত চেহারা করে পালালো কোথায় তার ভালোমানুষ স্বামীটি!
ভালো করে কাগজখানা মেলে ধরলো চোখের সামনে। দূচ্ছাই, কিচ্ছু বুঝা যায়না। ধীরে গিয়ে পৌছোলো এবার সে বসার ঘরে। তিনি মুখের উপর নিউজপেপার মেেলে ধরে বিশাল মনোযোগে কোনো সংবাদ বা দুঃসংবাদে ডুবে আছেন। তবে কেনো যেন সন্দেহ হলো সেটা এক প্রকার ভান। কিছুই পড়ছেন না তিনি। শিরিকে ঢুকতে দেখে একটু বিচলিতও হলো যেন। শিরি গিয়ে বসলো তার সামনে, মনে মনে যত কথাই বলুক না কেনো সে, মুখে সাত চড়ে রা না করা মানুষ শিরি। আস্তে জানতে চাইলো, কি লেখা আছে রিপোর্টে? পতিদেব আরও আস্তে জবাব দিলেন, পজিটিভ।
কথাটা শোনা মাত্র কি হলো যে শিরির। রিনরিনে এক মৃদু ঝংকারের সুললিত সুর বয়ে চললো তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। মুখখানাও মনে হয় এবার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠলো। জানিনা কি ছিলো সে মুখে, হঠাৎ খেয়াল করলো পতিদেব এবার হা করে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে। এইবার ওর ছুটে পালানোর পালা।
সে যাইহোক বেশ কিছুদিন ধরে দূরারোগ্য রোগে ভুগছিলো শিরি। যা খায় তাই বমি হয়ে যায়। সারাটাক্ষন মাথা ঝিমঝিম করে। প্রথম দিন তো সে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখা ওদের বিয়ের যুগল ছবিটা হতে ধুলো মুছতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো ওর। ভীষন ভয় পেয়ে দৌড়ে গেলো শ্বাশুড়ির ঘরে। শ্বাশুড়ি তখন জি বাংলায় কোনো এক সিরিয়ালে নিমগ্ন ছিলেন। তার পায়ের কাছে বসে নতুন বুয়া মোমেনা। শিরিকে ওমন ছুটে আসতে দেখে চোখ তুলে তাকালেন তারা দুজনেই। রাসভারী শ্বাশুড়ি কিছু বললেন না বটে কিন্তু মোমেনা তার ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে বলে উঠলো, কি হইসে বউ? কিছু না বলে ফিরে এলো শিরি , কেনো যেন বলতে ইচ্ছে হলোনা কাউকেই ওর সমস্যাটার কথা। ভাবলো হঠাৎ কোনো কারণে শরীর খারাপ করেছে ওর। হাসব্যান্ডকে ফোন দিতে গিয়েও ফোন দিলোনা সে।
হঠাৎ মায়ের ফোন। ওর গলা শুনে মা বুঝে ফেললেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে তার। শিরি বললো, তেমন কিছু না তবে কিছুদিন ধরে এমন সব অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে ওর। কেনো যেন মনে হচ্ছে ও আর বাঁচবেনা। বলে ভ্যা করে কেঁদে ফেললো শিরি। ওর মা তো হেসে খুন। শিরি ভীষণ অবাক হলো। মা তো এমন নন যে মেয়ের এত বড় বিপদে হাসবেন। তারপরপরই মা ওর ফোন কেটে শ্বাশুড়িকে ফোন দিলেন।
ছি ছি এখন এসব ভেবে লজ্জা লাগছে ওর। সেদিনও লজ্জা লেগেছিলো ওর কিন্তু লজ্জাটা বেশিক্ষন টিকেনি মানে এসব লজ্জা টজ্জা নিয়ে ভাবার সময় ছিলোনা তখন ওর। চোখের সামনে কেবলি ভাসছিলো, ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাতের মুঠি, গুটু গুটু পা.....নিস্পাপ হাসির একটি কচি মুখ..
কি এক অজানা ভালোলাগায় মন ভরে উঠছিলো। মনে পড়ে ...
হঠাৎ ওমন গুরু গম্ভীর শ্বাশুড়ির হাক ডাক শুরু হলো। চমকে উঠলো শিরি। পর্দা ঠেলে হুইল চেয়ারে ওর ঘরে প্রবেশ করেছেন শ্বাশুড়িআম্মা স্বয়ং। ওকে কাছে টেনে বললেন, খুব সাবধানে থাকবে এখন থেকে, ভালো খাবার খেতে হবে, বেশি পরিশ্রম চলবে না, চুল খোলা রাখবেনা, মোমেনা তুমি সব সময় বৌ এর বাথরুম মুছে শুকনো খটখটে রাখবে। আর বৌমা তোমার কি কি খেতে ভালো লাগে সব বলবে আমাকে। কোনো কিছু লুকোবেনা নইলে নাতী বা নাতনী যে আসছে সে হবে পেটুক রাজা নয়তো খাই খাই স্বভাব হবে। বলে নিজেই হা হা হা করে হাসতে লাগলেন।
শ্বসুর মশাই ঢুকলেন হই হই করে। তার দিকে তাকিয়ে শিরির চোখ কপালে উঠলো। মনে হলো ঢাকা শহরের সব মিষ্টির দোকানই খালি করে এনেছেন তিনি। একটু পর খালা শ্বাশুড়ি, খালু শ্বসুর, মামা, মামী, চাচা, চাচী, ফুপু , ফুপা সমস্ত শ্বসুরকুল এসে হাজির বাড়িতে। এই উপলক্ষ্যে হাজির বিরিয়ানী অর্ডার দেওয়া হয়েছে। হাজার হোক বংশের প্রথম সন্তান আসছে শুধু মুখে এ সুসংবাদ চলে!
এসব কিছুর মধ্যমনি শিরি। চাচী শ্বাশুড়ির দেওয়া নতুন জামদানী শাড়ি পরতে হয়েছে তাকে। সবাই নানা উপদেশ দিচ্ছে। হঠাৎ পুরো বাড়িতেই উৎসবের আমেজ।
রান্নাঘরে কি যেন একটা আনতে গিয়ে শুনতে পেলো, ছোট দেবর পিছের বারান্দার কোনায় কাকে যেন ফিসফিস করে বলছে, এ্যাই জানো, ভাবীর বাচ্চা হবে, সারাবাড়ি ভর্তি মানুষ জড়ো হয়েছে। পুরাই ঈদ আজ আমাদের বাড়িতে। তোমাকে মিস করছি। আর ভাবছি কবে ......
মুচকি হেসে সেখান থেকে সরে গেলো শিরি.........
ওর ভুবন জোড়া এখন শুধু একটি আনন্দ। যে আনন্দের প্রতীক্ষায় আছে শিরি। কবে আসবে ওর অনাগত ছোট্ট রাজকুমার। সব সময় ফিসফিস করে কথা বলে সে ছোট্ট রাজকুমারের সাথে। আচ্ছা ছেলে হবে নাকি মেয়ে? ওর পছন্দ ছেলেই কিন্তু তার পছন্দ ......
অপেক্ষায় দিন কাটে তার .......