সন্ধ্যাকাশে তখনও হরিদ্রাভ অরুনচ্ছটা। ঝকঝকে শরতের খানিক হিম হিম হাওয়ায় ধরিত্রীতে হঠাৎ নেমেছে এই অপূর্ব গোধুলী। যাকে বলে কনে দেখা আলো আর ঠিক সেই কনে দেখা আলোতেই কনের আজানুলম্বিত চুলের দীঘল বেণী দেখে হবু শ্বাসুড়ীআম্মা থ বনে গেলেন।
চোখ সরাতেই পারছিলেন না তিনি। ছোটখাটো গড়ন গাড়নের এই পাতলা ছিপছিপে মেয়েটার সকল সৌন্দর্য্য যেন গিয়ে মিশেছে ওর ঐ দীঘল কালো সর্পবেনীতে। কনে দেখতে আসা অন্যান্য ফুপু, খালা, নানীশ্বাসুড়ীদের মনের অবস্থাও বোধ হয় একই ছিলো। সবার চোখই ঘুরে ফিরে আটকে যাচ্ছিলো শিরির দীঘল কালো রেশমী চুলের বিনুনীটির ফাঁদেই।
বড় কোনো আয়োজন নয়, নয় কোনো রেস্টুরেন্ট বা কম্যুনিটি সেন্টারে ঘরোয়া অনুষ্ঠান, এই কনে দেখা পর্বটা ছিলো একদম সাদামাটা এলেবেলে। যেন নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছেন তারা। হঠাৎ এবাড়ি ওবাড়ির লোকজনের দেখা হয়ে গেলো। অথচ শিরি সুদ্ধু তারা সবাই জানতো এইভাবেই নিউমার্কেটের বারান্দায় গুলশান শাড়ি দোকানের সামনে কনে দেখাদেখির আয়োজনটা হচ্ছে।
আগের আমলে নাকি গামলার পানিতে পা চুবিয়ে সেই পায়ের ছাঁপ মাটিতে ফেলে ফেলে দেখা হত কনে লক্ষী নাকি অলক্ষী। চুলের খোঁপা খুলে দেখাতে হত আসল চুল নাকি নকল চুল, আরও কত কি! এমন শত রকমের পরীক্ষার কথা শুনেছে শিরি। অন্যদের কথা কি বলবে স্বয়ং তার দাদীকেও নাকি নানা রকম প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে শুভ পরিণয়ের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়েছিলো।
হঠাৎ সে কথা ভেবে তার হাসি পায়। ফিক করে বুঝি হেসেই ফেলতো। কিন্তু হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায় যার সাথে, শিরির বুঝতে বাকী থাকেনা পাত্র তিনিই। বেশ গুরু গম্ভীর চেহারা। আবার একটু লাজুকও বটে।
সে যাইহোক, বিয়ে পাকাপাকি হতে সময় লাগলো না।মেজ খালাশ্বাসুড়ীর ছেলে মানে পাত্রের বয়সে ছোট কাজিনের প্রেম করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে একমসের মাঝেই। ডেটও পাঁকাপাকি, এই দিকে বড়ভাই মানে হোক না কাজিন, তার এখনও বিয়ে হলোনা এটা কিভাবে হয়? কি করে সম্ভব! এমন ভাবনা থেকেই শিরির শ্বাসুড়ির সিদ্ধান্ত বড় ভাই এর বিয়ে এর আগেই দিতে হবে।
আর তাই সাতদিনের মাথায় শিরির বিয়ে হয়ে গেলো এক রকম তাড়াহুড়ো করেই।
যে চুলের কারণেই এক দেখাতেই কনে দেখা বৈতরণী পার হয়ে গেলো শিরি, সেই দীঘল চুলের জন্যই প্রথম বিড়ম্বনা দেখা দিলো বিউটি পার্লারে খোঁপা বাঁধাতে গিয়ে। বিউটিপার্লারের কেশবিন্যাসকারিনীরা শুধুই ছেড়া চুলে খোঁপা বাঁধবার সেই প্রবাদ বাক্যের মত এত্তটুকু চুলকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, জটা পাঁকিয়ে বিশাল খোঁপা বাঁধতে শিখেছেন কিন্তু এই বিশাল দীর্ঘ চুল জটা পাঁকাতে গেলেও তো তাদের এখন দশ বছর সময় লাগবে সে কথা ভেবেই তারা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসে গেলো!
আর দশ বছর সময় তারা ভেবেচিন্তে যদিও দেয়, শিরি তা কিছুতেই দেবেনা। নতুন বউ এর চুল বাঁধার নমুনা শুনে সে বেঁকে বসলো যে, সে খোঁপাই বাঁধবে না কারন সে প্রায় নিশ্চিৎ বিউটি পার্লারের ঐ প্রচলিত পদ্ধতিতে তাকে খোঁপা বাঁধাতে হলে তার আর সংসার করা হবেনা বাকী জীবনটা বসে বসে ঐ চুলের জটই ছাঁড়াতে হবে।
সে যাইহোক তারপর অনেক বুদ্ধি করে বের করা হলো ওর দীঘল চুলগুলোকে লম্বা বিনুনী করে বেঁধেই সেই বিনুনীটাকেই পেঁচিয়ে খোঁপা করে ফুল টুল লাগিয়ে দেওয়া হবে। হ্যাঁ সেটাই বেস্ট ডিসিশন হলো। আর বিয়ে করতে গিয়ে সাজসজ্জায় বসে চুল বিড়ম্বনা থেকে সে যাত্রা মুক্তি পেলো শিরি।
এরপরদিন থেকে চুল নিয়ে শুরু হলো শ্বসুরবাড়ী জনসাধারণ বিড়ম্বনা । গোসলের পর নানীশ্বাসুড়ি অক্লান্ত পরিশ্রমে ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকলেন। ওরে বারান্দায় রোদে দিয়ে চুল শুকায় আনো, শ্বাসুড়ি বলে, এত বড় চুল সহজে শুকাবেনা, ভালো করে মুছাও, ছোটখালা শ্বাসুড়ি বলে হেয়ার ড্রায়ারে শুকাও। এর মাঝে দুষ্টু দেবর ফোঁড়ন কাঁটে, বলে মা ভাবীর চুলে আগুন ধরায় দিলে মনে হয় সবচেয়ে তাড়াতাড়ি শুকাবে। শ্বসুর মুচকি হেসে বলেন, নতুন বউ এর চুল সম্পর্কীয় নানা কাহিনী দেখে ও শুনে তো আমার শিবরামের চুল নিয়ে চুলোচুলি রম্য কাহিনীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
এভাবেই কাটলো কিছুদিন- তারপর-
সকলের হয় এক রকম, শিরির হয় আরেক রকম। শিরির ভাগ্যটাই যেন কেমন! নইলে এমন হানিমুনের শখ হয় কোনো পাগলের জন্মে শোনেনি সে। বিয়ের সাতদিন পরে তার স্বামীদেবতা তাকে জানালো, মানুষ হানিমুন করতে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া যায়, সেসব সাধ্যে না কুলোলে যায় কক্সেসবাজার বা কুয়াকাঁটা। কিন্তু তার শখ সে যাবে তার প্রায় পরিত্যাক্ত নানার বাড়ির গ্রামে। সেটা তার সবচাইতে প্রিয়স্থান।
ছেলেবেলার কত মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেখানে। নানাবাড়ির প্রতিটা ইঁট, কাঁঠ দেয়াল, পুকুর, সব্জী ক্ষেত সব তার অতি পরিচিত। অতি ভালোবাসার। নানা মারা গেছেন বহুবছর! খালা, মামারা সবাই দেশে বিদেশে নানাস্থানে ছড়িয়ে আছেন।নানী ছেলেমেয়েদের একেকজনের বাড়ি কয়েকমাস করে করে কাটিয়ে বছর পার করে দেন। গ্রামের সে বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। আছেন কেবল নিসন্তান তিনকুলে কেউ নেই এমনই একজন পুরাতন ভৃত্য। তবুও সেখানেই তার হানিমুনে যাবার ইচ্ছা।
চিরকালই শিরি মুখচোরা স্বভাবের। তাছাড়া মুখে মুখে কথা বলার অভ্যাস তার একদমই নেই কাজেই সে রাজী হয়ে গেলো। নির্ধারিত দিনে যথারিতী রওয়ানা দিলো ওরা। সারাদিনের শ্রান্তি শেষে সন্ধ্যার কিছু আগে গিয়ে পৌছালো ওরা বাংলাদেশের নঁওগা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক অপরুপা মায়াময় গ্রামে। চোখ জুড়িয়ে গেলো ওর! বিশাল ঘাট বাঁধানো পুকুর, চারিদিকে শতেক ফুল ও ফলের গাছ, উঁচু সিড়ি, এসব দেখে বুঝা যায় বাড়িটি এককালে বেশ বনেদী ছিলো।
নানাবাড়ি পৌছে তার স্বল্পভাষী, গুরুগম্ভীর স্বামীটি যেন ছেলেমানুষ হয়ে উঠলো। পরদিন সকালে সে বাড়ির সামনে পেয়েরা গাছে চড়ে পেয়ারা পাড়তে লাগলো। সে দৃশ্য যত না হাস্যকর ছিলো তার চাইতে বেশি হাস্যকর হলো যেটা। পেয়ারা গাছে চড়ার সময় তার কাঁছাবাঁধা . এটা দেখে অনেক কষ্টেও হাসি চাপতে পারলোনা শিরি। হাসতে হাসতে তার পেট ফাঁটে এমনি অবস্থা। নববঁধু যে হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছে তাকে দেখে মানে তার কাঁছা বাঁধা দেখে, তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই যেন তার স্বামীদেবতার। সে পরম উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ছেলেমানুষী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে রইলো।
কিছুপরেই শুরু হলো তার পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা অভিযান। জাল ফেলে তোলা হলো এক রাশ ছোট ছোট কি সব মাছ।সেসব নাকি শিরির স্বামীর মহা প্রিয় মাছ। এখন নতুন বউকে দিয়ে রাঁধিয়ে সেই ছোটমাছের চচ্চড়ি খাবেন তিনি এমনি তার বহুদিনের স্বপ্ন।
অগত্যা কি আর করা! শিরি কাঁটতে বসলো সেই মাছ।সারাজীবন পড়ালেখা নিয়ে ব্যাস্ত থাকায় ও বিয়ের আগে মেয়ে রান্নাঘরে গেলে হাত পুড়ে যেতে পারে, রঙ কালো হয়ে যেতে পারে এমন সব ধ্যান ধারনা থাকায় মায়ের বাড়িতে ছোটমাছ কোঁটাটা শেখা হয়নি শিরির। তবুও সহজাত নারীসুলভ মনোবৃত্তির কারনে সে ভাবলো এই মাছ কোঁটা আর কি এমন শক্ত! কাজেই আঁশবটিটা নিয়ে বসলো সে সেই বনেদী বাড়ীর প্রায় পরিত্যাক্ত বিশাল হেসেলের সামনের রোয়াকে।
একটা ছোটখাটো সুন্দর চকচকে মাছ তুলে নিতে হাত দিয়েই খ্যাঁচ করে কাঁটা ফুটে গেলো হাতে। উফ করে উঠলো শিরি। নাহ ধরাটা ঠিকঠাক হয়নি।অন্যদিকে ধরে বটিতে ফেলে কাঁটতে হবে। উফফফফ! আরও জোরে এইবার আঙ্গুলের অন্যদিক দিয়ে মানে উপর দিক দিয়ে নখের কোনা দিয়ে ঢুকে গেলো আরেকটা কাঁটা। কি আশ্চর্য্য ! শিরি তাহলে মাছটার ধরবে কোথায়! এইবার একের পর এক মাছ ধরে কোনোমতে হাঁতের এধারে ওধারে কাঁটা ফুটিয়ে ঘন্টা দুয়েক চেষ্টার পর সেই আধা খেঁচড়া কাঁটা মাছগুলো লবন মরিচ দিয়ে কিছু একটা যাচ্ছেটাই রান্না করলো শিরি। তবে ততক্ষণে দুহাতই ব্যাথায় টনটন করে ফুলে উঠেছে।
খেতে বসে শিরির দুহাতের দিকে তাকিয়ে স্বামীদেবতার মুখ মলিন হয়ে উঠলো! কি সর্বনাশ! এই পাগলী করেছে কি! মাছ কাঁটতে জানেনা তাহলে কাঁটতে গেলো কেনো? ইশ! একটু বললেই তো অন্য ব্যাবস্থা করা যেত।মনটাি খারাপ হয়ে গেলো তার।
বিকেলের দিকে জ্বর এসে গেলো শিরির। বাড়ির পুরাতন দেখাশোনার মানুষটা বললো, "ভাইজান এইসব তিনকাঁটার মাছ।কাঁটতে না জানলে তারে দিয়া কাঁটানি ঠিক হয় নাই তোমার।"শিরির স্বামী অপরাধী মুখ করে বসে রইলেন। পাশের বাড়ির আবুর মা এসে চুনটুন কি সব লাগিয়ে দিয়ে গেলো হাতে।রাতের খাবারও পাঠিয়ে দিলো সেই। হানিমুন করতে এসে এইসব কি মুন শুরু হলো ভেবে পেলোনা শিরি।
রাত বাড়তেই উসখুশ শুরু হলো শিরির। তিনকাঁটার মাছ হাতে ফুঁটে হাতের ব্যাথায় কাতর সে সমস্যা তো আছেই তবে আসল সমস্যা আবার সেই চুল বিড়ম্বনা। রাতে চুলে টাইট দুই বেনী ছাড়া ঘুমাতেই পারেনা শিরি। কিন্তু কে বেঁধে দেবে এখন তার চুল? আশে পাশে কেউ নেই তো চুল বেঁধে দেবার জন্য। শেষ পর্যন্ত লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে স্বামীকেই জানালো এই সমস্যার কথা। স্বামীদেবতা এতক্ষনে তার কৃত অপরাধ লাঘবের কিঞ্চিৎ সুযোগ পেয়ে মনে মনে বুঝি বলে উঠলো, কই বাত নেহি, আমি এই কাজ খুব ভালো পারবো। আমি তোমার বেনী বেঁধে দিচ্ছি, তারপর তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো। যদিও মুখে কিছু বলেন নি কিন্তু ভাবে সাবে বুঝে নিলাম আর কি।
বেঁনি বাঁধতে গিয়ে দেখা গেলো শিরির মাছ কোটার অদক্ষতার চাইতেও স্বামীর বেঁনী বাঁধার অদক্ষতা আরও অনেক বেশি। সে ঘেমে নেয়ে কোনো মতে ঝ্যালঝ্যালা ল্যালল্যালা করে বেঁনি নামক কি যেন বাঁধলো তা আল্লাই জানে। টাইট বেঁনী তো দূরের কথা সেই চুল এখুনি খুলে ছড়িয়ে যায় যায় অবস্থা। কোনোমতে সেই এলোথেলো বেঁনী নিয়েই অসস্থিকর রাত পার করতে হলো তার। আর হাতের ব্যাথা, জ্বর তো আছেই।
পরদিন হতে হাতের ব্যাথা কমে গেলো, জ্বরও চলে গেলো কিন্তু শিরির হানিমুন আর হানিমুন হলোনা। নানাবাড়ির পরিত্যাক্ত রুম কোনো মতে ঝেঁড়ে মুছে সাফ সুতরো করেছিলো আহমদমিয়া। কিন্তু তখনও আনাচে কানাচে বেশকিছু ধুলোবালী লেগে থাকায় শিরি নিজেই স্ব উদ্যোগে কোনার একটা ডেকোরেশন র্যাক মুছতে গেলো। আর তখনই বাঁধলো বিপত্তি। নীচের তাকটা মুছার সময় ঝাঁকি লেগে উপরের তাক হতে একটা পুরোনো কাঁচের ফুলদানী নীচে এসে পড়লো। পড়বি তো পড় একেবারেই শিরির মাথায়।
শিরি কেবলি শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে চুল শুকিয়েছিলো। হাস্যকর উপায়ে ফুলদানী মাথায় পড়ে মাথার চামড়া কাটলোনা বটে তবে সেই পাতলা কাঁচের ফুলদানীটার কুচি কুচি কাঁচের টুকরো দিয়ে সারা মাথার চুলের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে গেলো। সমস্ত মাথার চুল ভরে উঁঠলো কুঁচো কাঁচে।
কি আর করা, এগিয়ে আসলেন স্বামী দেবতা। নতুন বউ এর সেই মন ভুলানো দীঘল কালো রেশমী চুলের ফাঁক থেকে থেকে সেই পাতলা কাঁচের টুকরোগুলো সাবধানে তুলে ফেলে চুল ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করতে করতে সেদিন দুপুর পেরিয়ে বিকেলও পেরিয়ে গেলো।
যেই চুলের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত বাড়ির সকলে সেই চুল নিয়ে এত বিড়ম্বনা সত্যিই যেন শ্বসুরমশাই এর রসিকতা করে বলা সেই কথাটার মত চুল নিয়ে চুলোচুলি।
কবি নজরুলের একটি গান আছে-
সই ভালো করে বিনোদ বেঁনী বাঁধিয়া দে
মোর বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিনুনী ফাঁদে।
তবে শিরি এই বিনুনী ফাঁদে বঁধুকে বাঁধবে কি, এই চুলের ফাঁদে সে নিজেই তো পড়ে বার বার ।