হুমায়ূন আহমেদ স্টাইলের নাটক
‘আজ আমি সেমাই খাব না’
দৃশ্য এক
ঈদের দিন সকালবেলা।
নীলার বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে পেপার পড়ছেন। যদিও ঈদের আগে ও পরে কিংবা ঈদের দিন পেপার বের হয় না। তারপরেও তিনি পেপার পড়ছেন কারণ তিনি পেপার ছাড়া অন্য কিছুই পড়তে পারেন না।
এ সময় চায়ের কাপ হাতে সেখান নীলা আসবে।
নীলা: বাবা, চা খাবে? এই নাও ধরো।
বাবা: (চায়ের কাপ হতে নিয়ে) এ কী! চায়ের কাপে সেমাই কেন?
নীলা: এটা হচ্ছে বাবা সবাইকে চমকে দেবার একটা পদ্ধতি। সবাই চা মনে করে হাতে নেবে। নিয়ে দেখবে লাচ্ছা সেমাই। পিরিচে করে চামচও দেয়া থাকবে। আজকে ঠিক করেছি সবাইকে এভাবে সেমাই দেব।
বাবা: মা, তুই খুবই বুদ্ধিমতী। তোর মাও তোর মতই বুদ্ধিমতী ছিল।
এসময় সেখানে কাজের বুয়া মরিয়ম আসবে।
মরিয়ম বুয়া: নীলা আফা, মুহিব ভাইজান আইছে।
নীলা: আচ্ছা ওকে বসতে বল।
মরিয়ম বুয়া: জ্বে আচ্ছা।
বুয়া চলে যাবে।
বাবা: মুহিবকেও কি চায়ের কাপে সেমাই দিবি?
নীলা: হুঁ!
বাবা: আচ্ছা যা।
এরপর বাবা আবার পেপার পড়া শুরু করবেন।
নীলা উঠে চলে যাবে।
দৃশ্য দুই
নীলাদের বাড়ির ড্রইংরুমে নীলা আর মুহিব মুখোমুখি বসে আছে। মুহিব চুপচাপ চায়ের কাপ থেকে সেমাই খাচ্ছে।
নীলা: মুহিব ভাই, সেমাই কেমন হয়েছে?
মুহিব: অসাধারণ!
নীলা: আরো এনে দেই?
মুহিব: না লাগবে না।
নীলা: মুহিব ভাই, আপনি যে সেমাই খাচ্ছেন তার নিচের দিকে একটা তেলাপোকা আছে ।
মুহিব: তাই নাকি?
নীলা: আপনাকে কিন্তু সেমাইয়ের সাথে তেলাপোকাটাকেও খেতে হবে। অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য ধরেছি।
মুহিব: আচ্ছা।
মুহিব কোন কথা না বলে সেমাইয়ের সাথে তেলাপোকাটাকেও কচকচ করে খেয়ে ফেললো।
নীলা মুখ গম্ভীর করে সেটা দেখতে লাগলো।
দৃশ্য তিন
নীলা আবার বারান্দায় তার বাবার সাথে চেয়ারে বসে আছে।
বাবা সম্ভবত তার পেপার পঠন পর্ব শেষ করেছেন।
বাবা: মুহিব চলে গেছে?
নীলা: হুঁ!
বাবা: তেলাপোকা খেয়ে গেছে?
নীলা: হুঁ!
বাবা: নীলা, তুই কাঁদছিস কেন?
নীলা: বাবা, মুহিব ভাই এত ভালো কেন?
বাবা: মা রে, পৃথিবীতে ভালো মানুষের দেখা খুব বেশি পাওয়া যায় না।
নীলা: বাবা, তুমি মুহিব ভাইকে বলে দিও এত বেশি ভালো মানুষের আমাদের কোন দরকার নেই।
বাবা: মা, তুই যা তো, দুই কাপ সেমাই নিয়ে আয়। বাপ-বেটি মিওে একসাথে খাই।
নীলা: না বাবা, আমি আজ সেমাই খাবো না। কিছুতেই না।
মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী স্টাইলে নাটক
‘সেমাই সেমাই লাগতাছে’
দৃশ্য এক
ঈদের দিন সকালবেলা।
জয়ার বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে পশের বাড়ির জানালার দিকে তাক করে রেখেছেন। বাবার মুখ হাসি হাসি। এমন সময় বারান্দায় জয়াকে ঢুকতে দেখে বাবা চট করে বাইনোকুলার লুকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পরে যাবেন।
জয়া: হয়েছে, থাক আর লুকাতে হবে না। চা নাও।
বাবা: (কাপ হাতে নিয়ে) কী রে জয়া, চায়ের কাপে সেমাই কেন?
জয়া: সেদিন এইচবিওর একটা মুভিতে দেখলাম নায়িকা গ্লাসে করে নুডুলস খাচ্ছে। সেটাই খানিকটা মোটিভেট করে চায়ের কাপে ঢুকিয়ে দিয়েছি।
বাবা: মা, তুইতো দুই দিন পর প্লেটে করে শরবত নিয়ে আসবি।
এমন সময় সেখানে কাজের মেয়ে রিনা চলে আসবে।
রিনা: আফা, মারজুক মিয়া আইছে।
জয়া: মারজুক মিয়া কি রে? ভাইজান বলতে পারস না। যাহ্, ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে বল।
দৃশ্য দুই
জয়া ড্রইংরুমে ঢুকে দেখবে মারজুক দাড়িয়ে আছে।
জয়া: আরে তুমি বসো নাই ক্যান?
মারজুক: তুমি নাকি কইছো বসা নিষেধ।
জয়া: আরে দূর! জানো না তো আমাদের কাজের মেয়েটা একটা আস্ত ফাজিল।
মারজুক: (সোফায় বসে) আহ্! শান্তি পাইলাম।
জয়া: তারপর ঘটনা কি? তোমর এত দেরি ক্যান? সকাল থেকে ট্রাই করতাছিÑ মোবাইল অফ। আর এইটা কি কালারের শর্ট পাঞ্জাবী পরছো?
মারজুক: ক্যান, কালারটাতো জটিল। টোকনের লগে কিনলাম।
জয়া: এজন্যই তোমারে টোকাই টোকাই লাগতাছে। বাসায় গিয়া এটা চেঞ্জ করবা। আর আমি আজকে বাহিরে কোথাও যেতে পরবো না, বুঝলা?
মারজুক: ক্যান, রোহেলের লগে বাইর হইবা?
জয়া: ধ্যাৎ! ও একটা ছেলে হইলো নাকি? আজকে সবাইকে চাযের কাপে সেমাই খাওয়াবো।
রিনা সেমাই দিয়ে যাবে। মারজুক কাপে চুমুক দিয়ে সেমাই খেতে থাকবে।
জয়া: সেমাই কেমন হইছে?
মারজুক: কঠিন জিনিস হইছে। আমার মা এরকম রাঁধতো। কে রাঁধেছে, তুমি?
জয়া: আরে নাহ, ঠিকা বুয়া ময়নার মা রাঁধছে মনে হয়।
মারজুক: ওক! আক্! ওক!
জয়া: কি হলো? গলায় ঠেকছে? অ্যাই রিনা, জলদি পানি নিয়ে আয়।
দৃশ্য তিন
জয়ার বাবা বাইনোকুলারের লেন্সটা অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা করছেন।
বাবা: কিরে মারজুক কই?
জয়া: ও তো চইলা গেছে। ওর গলায় সেমাই ঠেকছে।
বাবা: ইজি সেমাই গলায় বিজি হইলো ক্যান?
জয়া: কি জানি?
বাবা: তাহলেতো আজ সেমাই খাওয়াটা নিরাপদ না।
জয়া: বাদ দাও। কালকে আবার লবণ-মরিচ দিয়া সেমাই রান্না করে দেব।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্টাইলে নাটক
‘সেমাই সেমাই শূন্য তিন’
দৃশ্য এক
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ কিহি তার বাড়ির বারান্দায় বসে আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্র“ণ সমীকরণ সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্ভবত তিনি সমাধানের শেষ পর্যায়ে চলে এসছেন। তার মুখে রেডিয়া রংের তীব্র আভা দেখা যাচ্ছে। এমন সময় সেমাই হাতে কিহির কন্যা তৃণার আগমন।
তৃণা: বাবা আজকে ঈদ, তোমার মনে আছে?
কিহি: হুঁ।
তৃণা: বাবা,আমি আজকে ক্রিস্টাল ডিস্ক ব্যবহার করে পৃথিবীর অতীব প্রাচীন খাবার সেমাই তৈরি করেছি। তুমি একটু খেয়ে দেখবে?
কিহি: ( সেমাই হাতে নিয়ে মুখে খানিকটা দিয়ে বলবে) তোমার তৈরি নুডুলসটা ভালোই তবে সোডিয়াম ক্লোরাইড কম হয়েছে।
তৃণা: বাবা, এটা নুডুলস নয়..
কিহি কিছু বলার আগে চতুর্থ মাত্রার সপ্তম প্রজাতির রোবট ট্রটন বারান্দায় চলে আসবে এবং তার সবুজ ফটোসেলের চোখ জ্বলতে নিভতে থাকবে।
ট্রটন: মহামান্যা তৃণা, প্রকৃতিবিদ ত্রাতুল সেমাই খেতে চলে এসেছেন।
তৃণা: তুমি বুদ্ধিহীনদের মতো বেশি কথা বলো। তোমার কপোট্রনে বুদ্ধি, চিন্তা ও যুক্তির লগারিদমে সমস্যা দেখে দিয়েছে। তিনি অন্য কোন কারণেওতো আসতে পারেন।
ট্রটন: আপনি নিজেই যুক্তিহীন কথা বলছেন মহামান্যা তৃণা। তাছাড়া আমি জিজ্ঞেস করলে-ত্রাতুল নিজেই বলেছেন তিনি সেমাই খেতে চলে এসছেন।
দৃশ্য দুই
ত্রাতুল সেমাইয়ের মধ্যে একটা মিলিকিউব দিয়ে রেখেছে। তৃণা অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ত্রাতুলের সামনে বসে আছে।
তৃণা: আপনি সেমাই খাচ্ছেন না কেন?
ত্রাতুল: আমার মিলিকিউব টেস্টারটা বলছে, এটা ল্যাবে তৈরি খাবার নয়। তাছাড়া এতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
তৃণা: তারমানে আপনি সেমাই খাবেন না?
ত্রাতুল: হ্যাঁ খাব। তবে যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য বায়োটিক জিহ্বা লাগিয়ে খাব।
তৃণা: আপনার সেমাই খাবার দরকার নেই।
ত্রাতুল: চিন্তা করো না। তুমি দিতে পারো। বায়োটিক জিহ্বা সব ব্যাকটেরিয়াকে শুষে নেবে।
দৃশ্য তিন
গণিতবিদ কিহি উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন।
তৃণা: বাবা, কি হয়েছে?
কিহি: গ্র“ণ সমীকরণ সমাধান বলছে, সেমাই পৃথিবীর মানুষের আবি®কৃত কোনো খাদ্য নয়। পৃথিবীর সভ্যতা বিকাশের যুগে গ্র“ণরা এই পৃথিবীতে এসে সেমাই খাদ্যদ্রব্যটির প্রচলন করে। সমীকরণের সমাধানটা ইন্টারেস্টিং না?
তৃণা: হ্যাঁ।
কিহি: ত্রাতুল চলে গেছে?
তৃণা: না তিনি বায়োটিক জিহ্বা লাগিয়ে সেমাই খাচ্ছেন।
কিহি: তুমি সেমাই খাবে না?
তৃণা: না ।
কিহি: কেন?
তৃণা: আমার সেমাই খেতে ইচ্ছা করছে না।
আবহমান বাংলা অপেরা স্টাইলে যাত্রাপালা
‘ঢংকুমারী ও মদনকুমার’
দৃশ্য এক
আরাম নগরের রাজা গোঁফে তা দিয়ে তামুক খাচ্ছিলেন আর অযথাই মাঝে মাঝে ‘খামোশ’ ‘খামোশ’ বলে চেঁচামেচি করছিলেন।
এমন সময় রাজার খাসকামরায় রাজকন্যা ঢংকুমারীর প্রবেশ।
ঢংকুমারী: আব্বিহুজুর! আজ ঈদের দিন। আর আপনি বসে বসে তামুক খাচ্ছেন। জানেন না, আজ শুধু সেমাই খাবার দিন। তামুক ফেলে দিন।
রাজা: ওরে না না না, তুই আমাকে তামুক ফেলতে বলিস না। এ তামুক আমার জান আর তুই আমার প্রাণ। কাকে রেখে আমি রাখিবো কার মান!
ঢংকুমারী: আব্বি হুজুর, আমি অনেক পেয়ার ঢেলে আপনার জন্য শাহী সেমাই তৈয়ার করেছি। কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও তাহার কিছু অংশ মুখে দিতেই হবে...।
ঘন্টা বাজবে। ঢং ঢং ঢং। রাজগোলামের আগমন।
রাজগোলাম: সেলাম জাঁহাপনা, সেলাম রাজকুমারী।
হাবলু নগরের রাজপুত্র মদনকুমার সৈন্যসামন্ত ছাড়াই মহল আক্রমণ করেছেন।
রাজা: হায় হায় হায়! আমার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত ও মন্ত্রী ছুটিতে। এখন কে আমকে রক্ষা করবে? কে আমাকে ভরসা দেবে? ঢংকুমারী...
ঢংকুমারী: ইয়েস আব্বি...
রাজা: যেভাবেই হোক, মদনকুমারকে তোমার সেমাই খাইয়ে বিমারি বানিয়ে দেশ থেকে বের করে দাও।
রাজকুমারী ও রাজগোলামের প্রস্থান।
দৃশ্য দুই
মদনকুমার: কোথায়? কোথায়? এই দেশের গাঁজাখোর রাজা কোথায়? আমি তার মুণ্ডুর দো-পেঁয়াজা করতে এসেছি।
ঢংকুমারী: ছিঃ মদনকুমার! আপনার ও মুখে এ কথা শোভা পায় না। আপনি কেন ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে যাবেন?
মদনকুমার: হে অবলা নারী ! কে তুমি? কি তোমার পরিচয়?
ঢংকুমারী: আমি আরাম নগরের রাজকন্যা। আপনার খেদমতে হাজির হয়েছি।
মদনকুমার: হো হা হা হো হা নিশ্চয়ই ওই ছুঁচোটা তোমাকে পাঠিয়েছে সুন্দরী।
ঢংকুমারী: আপনি ক্লান্ত মদনকুমার। আগে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিন।
এ সময় রাজগোলাম থালাভর্তি সেমাই নিয়ে আসবে।
দৃশ্য তিন
রাজা সিংহাসনের পেছনে বনে তামুক টানছেন। রাজ দরবার ফাঁকা। এমন সময় সেখানে ঢংকুমারীর আগমন।
রাজা: মদনকুমার, সে কোথায়?
ঢংকমারী: টয়লেটে আব্বিহুজুর!
রাজা: সে কী? মদনকুমার টয়লেটে কি করছে?
ঢংকুমারী: সেমাই একটু বেশি খেয়েছেন তো। তাই খানিকটা হাঁপিয়ে গেছেন। টয়লেটে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
রাজা: এ কী শোনালে তুমি? তবে আমি কার সাথে লড়াই করবো?
ঢংকুমারী: চিন্তা করবেন না আব্বি...আমি এক্ষুণি আপনার জন্যও সেমাইয়ের এন্তেজাম করছি।
রাজা: আজ আর সেমাই নয়Ñ রয়েছে মিষ্টান্নের ভয়। তুমি জানো না, আমার আবার ডায়াবেটিস আছে?