আমি, প্রচন্ড আত্মহত্যাপ্রবণ একটা ছেলে।
আমি আমার জীবনে অসংখ্যবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছি, কারণে-অকারণে। বালকবেলা আমার মা- রোমেছা বেগম, আমি নানাবাড়ি বেড়ানো অপছন্দ করতাম বলে ছোটোভাইটাকে নিয়ে যখন দিনের পর দিন সেখানে গিয়ে পড়ে থাকতেন, প্রতিদিন আমি স্কুল থেকে ফিরে তীব্র অভিমান বুকে চেপে চোখে জল নিয়ে বাড়ির পেছনের বাঁশবনে, মাঠে মাঠে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি, আর বারবার করে ভেবেছি- মা খুব খারাপ। আমি যেমন মা’র জন্যে কেঁদে বেড়াচ্ছি, মাও আমার জন্যে কেঁদে বেড়াবেন। চাচি, ফুপু, খালা- সবার নিকট থেকে প্রবোধ খুঁজে খুঁজে মা কেঁদে বেড়াবেন। কাউকে না জানিয়ে আমি টুপ করে মরে যাবো একদিন।
আমার আব্বা- আক্কাস আলী মারা যাবার পর মিয়াভাই(বড়োভাই) ওমর ফারুক এবং মেজোভাই হারুন-অর-রশীদ, অর্থাভাবের কারণে হোক আর যে কারণেই হোক, যখন প্রায়ই, নানা কারণে, আমাকে অবহেলা করেছেন- আমি মরে যেতে চেয়েছি। আমার কেবলই মনে হয়েছে- এতো কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই।
কলেজজীবনে মেজোবোন আফরোজা খাতুনের অস্বচ্ছল সংসারে শুধু বোঝা হয়ে পড়ে থেকেছি, তাঁর নিত্যদিনের দৈন্য দূর করবার জন্যে কিছু করতে পারি নি বলে, বড়োবোন সাবিয়া খাতুনকে তাঁর স্বামীর নানান অত্যাচারের গন্ডি থেকে বের করে আনতে পারি নি বলে থেকে থেকে শুধু মনে হয়েছে- আমার মতো অপদার্থের দ্বারা কারো জন্যে কিছু করা হবে না। এভাবে অর্থহীন বেঁচে থাকার চে’ মরে যাওয়া ঢের ভালো।
সুদূর ঢাকা শহরে একাকী পড়ে থাকা ছোটোভাই তুহিন অর্ণব কদাচিৎ যখন মন খারাপ করে মেঘস্বরে ‘হ্যালো’ বলে- নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে। আমার বেঁচে থাকাটা তখন নিতান্তই বাহুল্য বোধ হয়।
নূপুর আজিজ। বাপ-মা’র অতি আল্লাদি এই মেয়েটা যখন বুঝে, না-বুঝে, আমাকে অবহেলা করে- আমি অসম্ভব কষ্ট পাই, এখনও। তখন কম্প্যুটারস্কৃনের সামনে বসে চুপচাপ আমি কাঁদি, এবং প্রায় প্রতীজ্ঞা করে মনে মনে বলি- বেয়াদব ছেম্ড়ি, তোকে আমি এমন কষ্ট দেবো- তুই মরার আগ পর্যন্ত চোখের পানি ফেলবি। তুই তোর ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাবার জন্যে আমার ক্ববরের কাছে গিয়েও দাঁড়াতে পারবি নে। আমি জাস্ট আত্মহত্যা করবো, এবং তার আগে আমার দেহটা ডোনার ক্লাব জাতীয় কোনো সংস্থায় দান করে যাবো।
আমি এখনো বেঁচে আছি। যাদের জন্যে অসংখ্যবার মরতে চেয়েছি, তাঁদের কারো জন্যে কৃত স্বার্থচিন্তাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে নি। আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে একটাই মাত্র জিনিস- লোভ। অমরত্বের লোভ। সেই ছোটোবেলা থেকে লোভটা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে অধিকার করে বসে আছে। আমি মরে গেলে শুধুমাত্র আমার স্বজনরা কাঁদবে কেনো? আমার গ্রাম কাঁদবে, আমার দেশ কাঁদবে, সারা পৃথিবী আফসোস করবে।
কে বলবে- হয়তো, কাউকেই কাঁদানো হবে না, সারাজীবনের তাবৎ ব্যর্থতা নিয়ে একদিন একা একা চলে যাবো; কোনো পত্রিকায় শিরোনাম হয়ে বের হবে না, কোনো রেডিও বা টিভিচ্যানেলে খবর শুরু করার আগে কেউ আর্দ্রকণ্ঠে বলবে না-
"নন্দিত কথাশিল্পী স্বার্থক নাট্যকার প্রক্ষাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সুপণ শাহরিয়ার আর নেই"