(লেখকরা কেন লিখেন? এ বিষয়ে বিনয় ঘোষের একটি চমৎকার লেখা পড়লাম লেখা পড়লাম। ভাল লাগল। শিল্প সংস্কৃতি ও সমাজ বইয়ের সংযোজন অংশ। তাই ব্লগার বন্ধুরাও কেন লিখেন তা যাতে তারা যাচাই করতে পারেন সে উদ্দেশ্যেই লেখাটি হুবহু তুলে দিলাম। লেখাটি মোটামুটি বড়। তাই কয়েকটা পর্বে ভাগ করে দিচ্ছি। আশা করি সবার ভাল লাগবে। আজ প্রথম অংশ লিখলাম। ধারাবাহিকভাবে পুরো লেখাটাই দেয়ার আশা রাখি। আজ ২য় কিস্তি প্রকাশিত হলো।)
১ম কিস্তি
কেন লিখি? কেন ছবি আঁকি? কেন গান গাই? একই প্রশ্ন?
অনেক লেখক বলেন যে তিনি লেখেন তার নিজের জন্যে, কে পড়ল না পড়ল তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না। এটা একেবারে মিথ্যে কথা। এমন যদি হয় যে কোনো দেশে বা কোনো দ্বীপে লেখক একলা বাস করেন, তাঁর পরিবেশ জনমানবশূন্য, লেখার ক্ষমতা তার অসীম, মনের চিন্তাভাবনা অফুরন্ত এবং গভীর। তিনি কি সেখানে বসে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখবেন? ধরে নিলাম লিখবেন, কিন্তু সেই লেখা কি তাঁর প্রকাশিত হবে? হবে না। কার জন্য হবে? তাঁর খেয়াল খুশিতে লেখা সেই হাজার হাজার পৃষ্ঠা কীট-পতঙ্গের খাদ্য হবে, যে কীট পতঙ্গরা তাঁর মনের কথা একটিও বুঝতে পারবে না, অথচ তাঁর হাজার পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি খেয়ে হজম করে ফেলবে। সুতরাং "আমার জন্য" লিখি এই মিথ্যাকথা আবর্জনাস্তুপে নিক্ষেপ করা উচিত। আমরা লিখি পাঠকদের কথা মনে করে। আমরা যেমন মানুষ, পাঠকরাও তেমনি মানুষ। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভাব আদান-প্রদানের জন্যই লেখা। লেখকের কাছে পাঠক -‘dialactical correlative’ এর মতো। লেখার সময় মানুষ হিসেবে পাঠকরাও লেখকের উপর প্রভাব বিস্তার করেন, যেমন লেখকরা মানুষ হিসেবে তাঁদের লেখার ভিতর দিয়ে পাঠকদের উপর প্রভাব বিস্তার করেন। লেখা বা যে- কোনো শিল্পকলা সৃষ্টির মধ্যে এই যে 'আমি' শিল্পী এবং 'তারা' অনেকে যারা পাঠক-দর্শক-শ্রোতা, এই দু'য়ের মধ্যে যে ডায়লেক্টিক্যাল সম্পর্ক থাকে তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন।‘There is no art except for and by others’. (Sartre)
লেখক কি লিখবেন? মানুষ সম্বন্ধে বললে কিছুই বলা হয় না। মানুষের কোন বিষয় নিয়ে লিখবেন? লেখক যদি রাজপুত্র হন, অথবা উচ্চশ্রেণীভুক্ত যে-কেউ হন, তাহলে তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি, তাঁর বিষয় সমস্যা ইত্যাদি যেরকম হবে, তা নিশ্চয় নিম্নশ্রেণীভূক্ত সাধারণ দরিদ্র কোনো লেখকের হবে না। দুজনের জগৎ আলাদা, অথচ দুজনের অভিজ্ঞতাই সামাজিক সত্য। কিন্তু সত্য হলেও দুই সত্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। রাজপুত্র বা জমিদার বা উচ্চশ্রেণীর লেখকের অভিজ্ঞতা খুব সীমাবদ্ধ। সমাজের একজনও যেহেতু তাঁদের শ্রেণীভূক্ত নন সেই জন্য সমাজের নিরানব্বুইজনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতার যথেষ্ট গরমিল থাকার কথা। তাহলে সত্য কোনটাকে বলব? শতকরা নব্বুইজনের মুখ দিয়ে যিনি কথা বলছেন এবং ১৮০ টা হাতের প্রতিভূ একটি হাত দিয়ে যিনি লিখছেন, তাঁর কথা কি সামাজিক সত্য হিসেবে আরও অনেক বড় সত্য নয়? আমেরিকার নিগ্রো লেখকের মতো আমাদের দেশের কোনো হরিজন লেখক যদি ভারতীয় সমাজের নিদারুণ অবিচার অনাচার অত্যাচার সম্বন্ধে লেখেন এবং তাঁর লেখার মধ্যে যদি তিনি অত্যাচারীতের বিরুদ্ধে তাঁর মনের ঘৃণা ক্রোধ ও প্রতিহিংসার ভাব নির্মমভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে কি তাঁর লেখা মন্দ বা নিন্দনীয় বলে গণ্য হবে? কথাটা একটু ভাববার মতো। হয়ত হরিজন লেখকের শিক্ষাদীক্ষা চর্চা কোনো উচ্চশ্রেণীর লেখকের মতো পরিশীলিত না হতে পারে, প্রকাশভঙ্গি ও ভাষার মধ্যে রূঢ়তা গ্রাম্যতা থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য তাঁর লেখা কি ব্যর্থ হবে? শ্রীচৈতন্যপন্থী অথবা বিনবাপন্থী অথবা করুণাময়ী মাদার তেরেজাপন্থী কোনো উচ্চশ্রেণীর সুশিক্ষিত লেখক সুন্দর মার্জিত ভাষায় যদি তাঁর ভাবনাচিন্তা খুব দক্ষ কলাকুশলীর মতো প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁর লেখা কি হরিজন লেখকের চাইতে কেবল কলাকুশলতার জন্য উৎকৃষ্ট বলে স্বীকার করতে হবে? হরিজন লেখক ঘৃণা ও হিংসার ভাব প্রকাশ করেন এবং বিদগ্ধ উচ্চশ্রেণীর লেখক অহিংসা প্রেম প্রভৃতি উচ্চভাব প্রকাশ করেন। দুজনের মধ্যে সত্য প্রকাশের কৃতিত্ব কার এবং সাহস কার? সোজা উত্তর হল, হরিজন লেখকের। কারণ হরিজন লেখক যে সত্যকে সমাজের মানুষের কাছে প্রকাশ করতে চান, তার সত্যতা অন্য শ্রেণীর লেখকের তুলনায় শতগুণ বেশী। শুধু তাই নয়, হরিজন লেখক তাঁর জীবনের সত্যকে প্রকাশ করার জন্য যে স্বাধীনতার (freedom) আশ্রয় নিয়েছেন, তার মধ্যে তাঁর অসাধারণ সততা ও দুঃসাহস প্রকাশ পেয়েছে। রূঢ় ও অমার্জিত হলেও তাঁর লেখা থেকে বোঝা যায় যে তিনি জীবন পণ করে স্বাধীনভাবে লেখার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। লেখকের কাছে এই স্বাধীনতাই শ্রেষ্ঠ কাম্য, যে স্বাধীনতার আশ্রয় নিয়ে তিনি জীবনের ও সমাজের শ্রেষ্ঠ সত্য নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারেন। Thus, whether he is an essayist, a pamphleteer, a satirist, or a novelist, whether he speaks only of individual passions or whether he attacks the social order, the writer, a freeman addressing freeman, has only one subject-freedom.’ (Sartre)
লেখকের নিজের স্বাধীনতার সঙ্গে মানুষের স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ বলা চলে এবং মানুষ মানে সমাজের অধিকাংশ মানুষ, মুষ্টিমেয় কয়েকজন দ্বিপদ ম্যমাল-মানুষ নয়। হরিজন- লেখক যখন নিপীড়িত শোষিত হরিজনদের প্রতি যুগ-যুগব্যাপী অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন, তখন হরিজনদের ভিতর দিয়ে সমগ্র নিপীড়িত মানবজাতির পক্ষেই তিনি লেখেন, আমেরিকান নিগ্রো আর ভারতীয় হরিজনদের মধ্যে তখন কোনো পার্থক্য থাকে না। ভারতের হরিজনদের নিগ্রহের কথা আমেরিকার নিগ্রোদেরও মর্ম স্পর্শ করে এবং তখনই সেটি অনায়াসে বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়। তা যদি না হয় তা হলে হাজার দামামা বাজিয়েও কাউকে বিশ্বকবি বা বিশ্ব শিল্পী বানানো যায় না। দামামার শব্দ একদিন স্তব্ধ হয়ে যায়, বিশ্বশিল্পীর বাইরের মুখোশও খসে পড়ে।
তাই স্বাধীন শিল্পী, স্বাধীন লেখক হওয়া সহজ নয়। উৎকেন্দ্রতা, স্বৈরাচারীর দাসত্ব করা, স্বাধীনতা নয়। বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীর সমস্ত ন্যায্য অধিকারের স্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা, আসল গণতন্ত্র। ফ্যাশিস্ট রাজত্বেও স্বাধীনতা থাকে, সামরিক একনায়কতন্ত্রেও স্বাধীনতা থাকে, ইমার্জেন্সির সময়ও স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু কাদের জন্য সেই স্বাধীনতা? যারা ফ্যাশিস্টদের ও স্বৈরাচারীদের গোলামী করে, তাদের স্বাধীনতা। তারা কারা? সমাজের শতকরা দু'চারজন লোক। এই গোলামির স্বাধীনতা লেখকের জন্য নয়। লেখকের স্বাধীনতা যেহেতু সকল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা, তাই তাঁকে সেই স্বাধীনতা ‘defend’ করতে হয়, কারণ সেই স্বাধীনতা বিপন্ন হলে লেখাও বিপন্ন হয়। এমন ঐতিহাসিক অবস্থারও উদ্ভব হতে পারে এবং যখন হয় তখন কেবল কলম দিয়ে তাকে রক্ষা করা যায় না।‘A day comes when the pen is forced to stop and the writer must then take up arms. Thus, however you might have come to it, whatever the opinions you might have professed, literature throws you into battle. Writing is certain way of wanting freedom; once you have begun, you are commited willy-nilly.’ (Sartre)
এমন দিন যদি লেখকের জীবনে আসে যখন লেখনী ছেড়ে অস্ত্র ধরা ছাড়া উপায় নেই, তখন তাই তাঁকে করতে হবে, তাঁর নিজের স্বাধীনতা, তাঁর পাঠকদের ও বৃহত্তম মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য। লেখার জন্য, আমার জন্য লেখা, চিরন্তন সত্যের জন্য লেখা, এসব আগডোম-বাগডোম কথার কোনো মূল্য নেই, ইতিহাসে নেই, মানুষের জীবনে নেই, মানুষের সমাজে নেই। 'চিরন্তন সত্য' ইত্যাদি চিরন্তন অত্যাচারী অমানুষদের মুখের বুলি।
* উদ্ধৃতিগুলো Jean-Paul Sartre এর What is literature?থেকে গৃহীত।