বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বিদায়ী হজ্বের ভাষণ নিছক একটি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা মালাই নয়। এ ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিধৃত রয়েছে চিরন্তন হেদায়াতের অমীয় বাণী।
ইমাম মুসলিম সংকলিত নবীজির (সাঃ) প্রিয় সাথী হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত সে ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নে প্রদত্ত হলঃ
১। আল বিদা বা বিদায়ী সম্বোধনঃ
“হে মানব মন্ডলী!
তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ কর। আমি জানিনা, আগামী বছর এ সময়ে, এ-স্থানে, এ-নগরীতে সম্ভবত তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ আর নাও হতে পারে।
২। জাহেলী যুগের প্রথা পদদলিতঃ
“হে মানব সকল!
সাবধান! সকল প্রকার জাহেলিয়াত কে আমার দুপায়ের নিচে পিষ্ঠ করে যাচ্ছি। নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করেছে, হুযাইল তাকে হত্যা করেছে।
৩। সুদ নিষিদ্ধ ঘোষণাঃ
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ’সুদ’ কে চির দিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
৪। মানবাধিকার (জানমালের ইজ্জতের নিরাপত্তা) প্রসঙ্গে
হে লোক সকল!
বল আজ কোন দিন? সকলে বলল “আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্বের বড় দিন” সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মত, এই হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত।
৫। আমানত ও ঋণ আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপঃ সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে।
৬। ইসলামে জাতি, শ্রেণীভেদ ও বর্ণ বৈষম্য নেই। মর্যাদার ভিত্তি একমাত্র তাকওয়াঃ
হে মানব সকল!
নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম (আঃ)। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।
৭। নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রসঙ্গেঃ
হে লোক সকল!
পুরুষদেরকে নারী জাতীর উপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের উপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষদের উপর রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে নারীরা স্বামীর গৃহে ও তার সতীত্বের মধ্যে অন্য কাউকেও শরিক করবেনা, যদি কোন নারী এ ব্যপারে সীমা লংঘন করে, তবে স্বামীদেরকে এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে, তারা স্ত্রীদের থেকে বিছানা আলাদা করবে ও দৈহিক শাস্তি দেবে, তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না। আর নারীগণ স্বামী থেকে উত্তম ভরণ পোষণের অধিকার লাভ করবে, তোমরা তাদেরকে উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে।
৯। সম্পদের অধিকার সংরক্ষণ ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রসঙ্গেঃ
হে উপস্থিতি!
মুমিনেরা পরষ্পর ভাই আর তারা সকলে মিলে এক অখন্ড মুসলিম ভ্রাতৃ সমাজ। এক ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবেনা।
১০। গুনাহের মাধ্যমে শয়তানের আনুগত্য না করার হুশিয়ারীঃ
হে মানুষেরা!
শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথ ভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না, তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সর্তক থাকবে ও তার অনুসারী হবেনা।
১১। ইসলামের রুকন সমুহ যথাযথ ভাবে পালনের নির্দেশঃ
তোমরা আল্লাহর বন্দেগী করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, যাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে, তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে।
১২। অধীনস্থদের অধিকার প্রসঙ্গেঃ
সাবধান!
তোমাদের গোলাম ও অধীনস্তদের বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে তাদেরকেও সে ভাবে পরতে দেবে।
১৩। নবীজি নিজ দায়িত্ব (রিসালাতের দায়িত্ব) সর্ম্পকে উম্মত থেকে সাক্ষ্য নিলেন
হে লোক সকল!
আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার পয়গাম পৌছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, “হ্যা” তিনি বললেন “ আমার বিষয়ে তোমাদের জিঞ্জাসা করা হবে, সে দিন তোমরা কি সাক্ষ্য দিবে, সকলে এক বাক্যে বললেন, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, উম্মতকে সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সমস্ত গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছেন এবং অহীর আমানত পরিপূর্ণ ভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন” অত:পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ শাহাদাত আঙ্গুলি আকাশে তুলে তিনবার বললেন, “হে আল্লাহ তা’আলা আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি স্বাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন”।
১৪। আল্লাহ প্রত্যেকের অর্থনৈতিক অধিকার র্নিদিষ্ট করে দিয়েছেনঃ
হে মানুষেরা!
আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সম্পদের মিরাস নির্দিষ্টভাবে বন্টন করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশী করবেনা। সাবধান! সম্পদের তিন ভাগের এক অংশের চেয়ে অতিরিক্ত কোন অসিয়ত বৈধ নয়।
১৫। সন্তানদের পরিচয় প্রসঙ্গেঃ
সন্তান যার বিছনায় জন্ম গ্রহণ করবে, সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত। (অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা বিবাহিত দম্পতির হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই।) যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানব জাতির অভিশাপ এবং তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না।
১৬। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমলের (কর্মের) জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেঃ
হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা!
তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না কর। কেননা আমি আল্লাহর আযাবের মোকাবিলায় তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো না। তোমাদের দেখেই লোকেরা আমল করে থাকবে।
১৭। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মের জবাবদিহি করতে হবেঃ
মনে রেখ!
সকলকে একদিন আল্লাহ তা’আলার নিকট হাজির হতে হবে। সে দিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। “তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবেনা।
১৮। খতমে নবুয়াত প্রসঙ্গেঃ
আমি আখেরী নবী, আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমার সাথে অহীর পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।
১৯। সামগ্রিক পথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ভাষণেঃ
হে মানুষেরা!
আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি যতদিন তোমরা এই দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসূলের (সঃ) সুন্নাহ।
২০। আমির বা নেতার আনুগত্য প্রসঙ্গেঃ
হে মানব মন্ডলী!
তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তাঁর কথা শুনবে, তাঁর নির্দেশ মানবে ও তাঁর প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন থেকে তাঁর কথাও শুনবেনা এবং তাঁর আনুগত্যও করা যাবেনা।
২১। দ্বীনের ব্যাপারে কোন বাড়াবাড়ি নেই/ধর্মীয় স্বাধীনতা দান প্রসঙ্গেঃ
সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। (এ নির্দেশনাটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোন বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোরজবস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া যাবে না। তবে একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জীন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই।)
২২। দাওয়াতে দ্বীন ও তাবলীগে দ্বীনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে/ বা উম্মতের দায়িত্ব ও করণীয় প্রসঙ্গেঃ
আবার বললেন, আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিয়েছি? সকলে বললেন, “নিশ্চয়ই”। হে উপস্থিতগণ! অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ পয়গাম পৌছে দেবে। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের উপর তোমাদের চেয়ে বেশী গুরুত্বের সাথে আমল করবে। “তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক” বিদায়।
ভাষণের গুরুত্বঃ
১০ম হিজরী সনে ৯ই যিলহজ্জ জুমাবার বেলা প্রায় দেড়প্রহরে কসওয়া নামক উটের পিঠে ১ লক্ষ ২৪ হাজার সাহাবার সামনে ঐতিহাসিক ভাষণটি পেশ করেছিলেনঃ
মহানবী (সাঃ) এর বিদায়ী ভাষণ নিছক একটি বক্তৃতামালা নয়, এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য মানব জাতির দিক নির্দেশিকা। এ ভাষণে মানব জাতির বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ ভাষণের বলার পদ্বতি, আবেগ, শব্দ চয়ন, গাম্ভীর্য সব কিছুই অনন্য, অনবদ্য, বে-নজীর ও বেমেছাল। এ ভাষণ গ্রহণ যোগ্যতার দৃষ্টিকোনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণই শুধু নয়, মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও মানবধিকারের মহা সনদ হিসেবে বিবেচিত। আসুন আমরা এ ভাষণের আলোকে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ কে সাজাই। আল্লাহ আমাদের জানার ও মানার তৌফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা-আমিন। ইয়ারাব্বাল আলামিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৬