উশর (ফল ও ফসলের যাকাত) এর বিবরণ :
উশরের অর্থ:
উশরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এক দশমাংশ। পারিভাষায়- উশর হলো উৎপাদিত শস্যের দশভাগের একভাগ এবং কোন জমির বিশভাগের একভাগ যা যাকাত হিসেবে নির্ধািরত হকদারকে দিয়ে দেয়া হয়। অন্য কথায়, উৎপাদিত ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ বলা হয়।
উশরের শরয়ী হুকুম:
উশর যাকাতের মতই ফরয।
প্রথমত: আল-কুরআনের দলীল: মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
ياَ يُّهَا الَّذِيْنَ امَـنُـوْا اَنْـفِقُـوْا مِنْ طَيِّـبَـاتِ مَا كَسَبْـتُمْ وَمـِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْاَرْضِ
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপার্জনের উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং তার মধ্য থেকেও যা তোমাদের জন্যে আমি জমীন থেকে উৎপন্ন করেছি”। { সূরা আল বাকারা-২৭৬।}
মহান আল্লাহ বাগান ও শস্যক্ষেত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: وَاتُوْاحَقَّه يَوْمَ حَصَادِه وَلَا تُسْرْفُوْا إِنَّه لَا يُحِبُّ الْـمُسْرِفِيْنَ
“আর কর্তনের সময় এর হক দান কর এবং অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না”।{ সূরা আনআ’ম-১৪১।}
(অর্থাৎ, আল্লাহর পথে ব্যয়ও সুষম হওয়া চাই, যাতে সবার প্রাপ্য পরিশোধ করা সম্ভব হয়)।{ মা আ’রেফুল কুরআন।}
তাফসীরকারগণের এ ব্যাপারে ঐক্যমত যে, এর অর্থ হলো উৎপন্ন ফসলের যাকাত তথা উশর।
দ্বিতীয়ত: আল হাদিসের দলীল :
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত। নবী করীম সা. বলেছেন,
فـِيْمَـا سَـقَـتِ السَّمَاء ُ وَالْـعُـيُـوْنُ أَوْكَانَ عُشْرِيًّا اَلْـعُـشْرُ- وَفِيْـمَا سُقـِىَ بِـا لـنَّـضْحِ نِصْفُ الْـعُشْرِ
“আকাশের পানি, ঝর্ণা-খাল অথবা জমির আদ্রতা দ্বারা জমির উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ, আর সেচের পানি দ্বারা জমির উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশের অর্ধেক তথা বিশভাগের একভাগ যাকাত তথা উশর দিতে হবে”। { সহীহ আল বুখারী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ।}
তৃতীয়ত: ইজমার দলীল : মোটামুটি জমির যা ফসল হবে তাতে ওশর বা অর্ধ উশর ফরয হওয়া সম্পর্কে ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিস্তারিত ও খুটিনাটি ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ আছে। { ‘ফিকহুয যাকাত’ ড. ইউসুফ আল কারযাভী (বাংলা সংস্করণ-৩২০ পৃষ্ঠা)।}
উশর ও খারাজ :
বিজিত অমুসলিম নাগরিকদের জমি যা বল প্রয়োগ বা সন্ধির দ্বারা অর্জিত হয়। তা সাধারণ মানুষের হয়ে যায় দান হিসেবে ও সন্তানাদির খাদ্য যোগানের সূত্র হিসেবে। সে জমির উপরই খারাজ নির্ধাারিত হয়। তাকেই বলে খারাজী জমি। এই খারাজী জমির উৎপাদিত ফসলের উশর ওয়াজিব হবে না। এছাড়া যত জমি রয়েছে সবই উশরী জমি, তার উপরই উশর দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জমির খাজনা বা কর দিতে হয় বিধায় এখানে জমির উৎপাদিত ফসলের উশর দিতে হবে না বলে অনেকেই মতামত দিয়ে থাকেন। আসলে এই খাজনা বা কর এবং খারাজ এক নয়। কারণ, খারাজী জমির তিনটি শর্তপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন, আর তাহলো:
১. তা বিজিত অমুসলিম নাগরিকদের জমি দিতে হবে।
২. খারাজ ফিকহের দৃষ্টিতে নির্ধারণ হতে হবে, যা মূলত: উশরের চেয়ে পরিমাণে বেশী হয়ে থাকে।
৩. উক্ত খারাজ ইসলামী সরকার কর্তৃক আদায় ও ইসলামী মতে তা ব্যয় হতে হবে।
সত্যি বলতে কি! এ তিনটির কোন শর্তই আমাদের দেশে পূর্ণ হয়না, সে জন্য এখানে জমির উৎপাদিত ফসলের উশর দিতে হবে না, এটা কোন ক্রমেই ঠিক নয়। বরং বাংলাদেশের জমির উৎপাদিত ফসলের উশর দিতে হবে।
উশরী জমি ছয় প্রকার :
১. সমস্ত আরব দেশ।
২. যে দেশের লোকজন সানন্দে মুসলমান হয়েছে।
৩. যে দেশ বিজয় করার পর মুজাহিদদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়েছে।
৪. সেই পতিত জমি যা উশরী পানি দ্বারা সেঁচ দিয়ে চাষাবাদ যোগ্য করা হয়েছে।
৫. সেই খারাজী ভূমি যা উশরী পানি দ্বারা সিঞ্চিত করা হয়েছে।
৬. মুসলমান তার যে ঘরকে বাগানে পরিণত করে উশরী পানি দ্বারা সিঞ্চিত করেছে।
উশরের নিসাবের পরিমাণ :
নূন্যতম পাঁচ ওসাক (প্রতি ওসাক= ৫মন ১০ সের) বা ২৬ মন ১০ সের ফসল উৎপাদন হলে তার উপর উশর দিতে হবে। অন্য বর্ণনায় ২৮মন ৩৬ সের ৪ ছটাক। { সহীহ আল বুখারী।}
উশরের বিভিন্ন মাসায়েল :
১.উৎপাদিত সকল ফসলের উপরই উশর ধার্য হয়ে থাকে। বৎসরে ফসল যতবার হবে ততবারই পৃথক পৃথক ভাবে উশর আদায় করতে হবে। কেননা যাকাতের মতো উশরে বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত নেই।
২.ওয়াকফ করা জমি চাষ করলে চাষীর উপর উশর ওয়াজিব হবে।
৩.উশর ফসলের আকারে ও দেয়া যায় অথবা তার মূল্যও দেয়া যায়।
৪.জমির খাজনা বা ট্যাক্স দিলেও উশর মাফ হয় না।
৫.যাকাত যে সব খাতে ব্যয় করা হয় , উশরও সেই সব খাতে ব্যয় করতে হবে।
৬.দু‘জন মিলে চাষাবাদ করলে উশর উভয়জনের উপর ওয়াজিব হবে।
মধু ও প্রাণী উৎপাদনের যাকাতের বিবরণ :
ইমাম আবু হানিফা র. ও তার সঙ্গী শাগরিদদের মতে মধুর যাকাত দেয়া ফরয। নবী করীম সা. বলেছেন- أَدُّوْا الْعُشْرَ فِى الْعَسْلِ মধুর উশর দাও।{ বায়হাকী।}
মধুর যাকাতের নিসাব ও পরিমাণ :
পাঁচ ওসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। শরীয়তের বিধানদাতা কৃষি ফসল ও ফলের নিসাব নির্ধারণ করেছেন পাঁচ ওসাক। মধুর নিসাব ও তাই হবে এবং সেই পরিমাণ হলে তার দশ ভাগের এক ভাগ উশর হিসেবে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, যাবতীয় ব্যয় ও শ্রমের মূল্য বাদ দিয়ে অবশিষ্ট থেকে উশর দিতে হবে।
প্রাণীজাত সম্পদের যাকাত :
আল্লামা ইফসুফ আল কারযাভী বলেন:- এসব ক্ষেত্রে মৌলনীতি হচ্ছে, যার মূল্যের উপর যাকাত ধার্য নয়, তার উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির উপর যাকাত ধার্য হবে, যেমন জমির উৎপাদন কৃষি ফসল মৌমাছির উৎপাদন মধু, চতুষ্পদ জন্তুর দুগ্ধ, মুরগীর ডিম এবং গুটি পোকার উৎপাদন রেশন। সুতরাং প্রাণীজাত দ্রব্যাদির উপর যাকাত দিতে হবে। { ‘ফিকহুয যাকাত’ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী।}
রিকায বা গুপ্ত সম্পদের যাকাতের বিবরণ :
মাটির নীচে রক্ষিত সম্পদকে ইসলামের পরিভাষায় রিকায (ركاز) বলা হয়। ফিকাহ্বিদগণের মতে রিকায বা গুপ্ত ধনের এক পঞ্চমাংশ বাইতুলমালে দেয়া ফরয। যে পাবে তার উপর এ ফরয কার্যকর হবে। নবী করীম সা. বলেছেন- فى الركاز الخمس অর্থাৎ গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশ বাইতুলমালে দেয়া ফরয। ইমাম আবু হানিফা রাহ. এর মতে তা রাষ্ট্রের সাধারণ বাজেটভূক্ত হয়ে ব্যয় হবে।
খনিজ সম্পদের যাকাতের বিবরণ :
আধুনিক কালের ফিকাহ্বিদগণের মতে স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ, তামা, সীসা, ফিরোজা ,হীরা, ইয়াকুত, জুমররদ, সবুজ বর্ণের জুমররদ, সুরমা সহ সব ধরনের খনিজ পদাথ। চাই জমাট বাধা হোক বা তরল পদার্থ হোক যেমন, তেল, পেট্রোল, গ্যাস ইত্যাদি। এসবখনি থেকে যা উত্তোলিত হবে, তার যাকাত দিতে হবে।
নিসাব ও পরিমাণ :
ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং ছাহেবাইনের মতে এক পঞ্চমাংশ যাকাত হিসেবে দেয়া ফরয। আর খনিজ সম্পদের পরিমাণ কম হোক বেশি হোক তার হক দিতে হবে, কোন রূপ নিসাবের হিসাব ছাড়াই। তার এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার শর্তও নেই। বরং খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও অর্জন সমাপ্ত এবং তা পরিচ্ছন্নকরণ ও পৃথকীকরণ হলেই যাকাত দেয়া ফরয হয়ে যাবে।
সমুদ্র থেকে পাওয়া সম্পদের মাসআলা : ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং ছাহেবাইনদের মতে তাতে কিছুই ফরয হবে না।
যাকাত ও উশরের হিসাব করার পদ্ধতি
সম্পদের প্রকৃতি অনুযায়ী যাকাতের হার ভিন্ন ভিন্ন হবেঃ
১.স্বর্ণ-রৌপ্য নগদ টাকা ব্যবসায়িক মালামাল, আয়, লভ্যাংশ ইত্যাদির উপর ২.৫% যাকাত হিসাব করতে হবে।
২.ফল ও ফসল উৎপাদনে যান্ত্রিক সেচ সুবিধা গ্রহণ করলে ৫% যাকাত হিসাব করতে হবে।
৩.ফল ও ফসল উৎপাদনে জমি প্রাকৃতিক ভাবে সিক্ত হলে ১০% যাকাত হিসাবে করতে হবে।
৪.প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের উপর ২০% যাকাত দিতে হবে।
পশুর যাকাতের হিসাব :
১. উট ৫টিতে ১টি একবছরের ছাগল দিতে হবে।
২. গরু-মহিষে ৩০ টিতে ১টি একবছরের বাছুর দিতে হবে।
৩. ছাগল-ভেড়া, দুম্বা ৪০ টিতে ১টি ১টি ছাগল অথবা একটি ভেড়া দিতে হবে।
যাকাত হিসাবের ছক
২.৫% হারে চন্দ্র বৎসর অথবা সৌর বৎসর হিসাবে নি¤েœাক্ত ছক অনুযায়ী হিসাব করবেন।
ক. ব্যক্তিগত সম্পদ :
১. স্বর্ণ-রূপা ও অলংকারাদি---------------------=
২. শেয়ার বিনিয়োগ---------------------------=
৩. সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ: ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার,বন্ড,সঞ্চয় পত্র, ট্রেজারি বন্ড ইত্যাদি-------=
৪. বীমা, ডিপিএস, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি---------=
৫. স্থায়ী সম্পত্তির উপর নিট আয় (গৃহ,দোকান, দালান-কোঠা, জমি যন্ত্রপাতি,গাড়ি,যানবাহন ইত্যাদি ভাড়া বাবদ নিট আয়)------------------------------=
৬. বৈদেশিক মুদ্রা: নগদ ও ব্যাংকে জমা, বন্ড, টিসি ইত্যাদি (বিনিময় হারে = টাকা)-----------------=
৭. ব্যাংকে জমা: ফিক্সড, সঞ্চয়ী, চলতি, বিশেষ জমা, পোষ্টাল সেভিংস ইত্যাদি-------------------------=
৮. ঋণ/ পাওনা আদায়------------------------=
৯. অন্যান্য----------------------------------=
১০. হাতে নগদ-------------------------------=
মোট----------------------=
@ বাদ: বাদ যোগ্য ঋণ, বকেয়া কিস্তি ও অন্যান্য দেনা (যাহা সত্বর পরিশোধযোগ্য)----------=
@যাকাত যোগ্য সম্পদ---------------------------------=
খ. ব্যবসায়িক সম্পদ :
১.বিক্রির জন্য দোকানে,গুদামে ও বিক্রিয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) কাছে রাখা পণ্যদ্রব্য--------------------=
২. পরিবহন ও ট্রানজিট পণ্য--------------------=
৩. উৎপাদিত পণ্য----------------------------=
৪. উৎপাদন প্রক্রিয়াধীন বা অসম্পূর্ণ পণ্য----------=
৫. মজুত কাঁচামাল ও প্যাকিং সামগ্রী--------------=
৬. বাকী বিক্রির পাওনা------------------------=
৭. পাওনা আয়, বিল ও অন্যান্য পাওনাহিসাব-------=
৮. অগ্রিম ও ফেরৎ যোগ্য জমা ইত্যাদি------------=
৯.ব্যবসায়ে নিয়োজিত নগদ টাকা----------------=
১০.ব্যংকে জমা-------------------------------=
১১.হাতে নগদ--------------------------------=
১২.অন্যান্য----------------------------------=
মোট----------------------------------=
# বাদ: বাদ যোগ্য ঋণ, বকেয়া কিস্তি, পাওনাদার, প্রদেয় বিল ও
অন্যান্য বাদ যোগ্য দেনা (যা সত্বর পরিশোধ যোগ্য)---------------------------------------=
@যাকাত যোগ্য সম্পদ----------------------------------------=
@সর্বমোট যাকাত যোগ্য সম্পদ (ক+খ)--------------------------------------=
ইসলামের যাকাত ও উশর ব্যবস্থা এবং মুসলিম উম্মাহ্র করণীয় :
ধনী ও দরিদ্র, সমাজে দু’ধরনের লোককে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সম্ভবত ইবাদতের দু’টি মৌলিক ধারা সৃষ্টিই এর মূল রহস্য। একটি সবর, অন্যটি শোকর। এ দু’য়ের সমন্বয়ে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টি এবং সৃষ্টির সাথে সৃষ্টির পারস্পরিক নৈকট্য অর্জনের ব্যবস্থা রচিত হয়েছে। আর এর পদ্ধতি হলো: ধনবান ব্যক্তিগণ অস্বচ্ছল ব্যক্তির প্রতি তার কষ্টার্জিত সম্পদ-সামর্থ নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, যার আরেক নাম হলো “যাকাত”।
আর বঞ্চিত ও প্রার্থীরা কতৃজ্ঞতার সাথে তা গ্রহণ করবে। এরই মাধ্যমে ধনী-গরীবের মধ্যে গড়ে উঠবে যোগসূত্র। মানুষ হবে দারিদ্র্য মুক্ত এবং দেশ হবে স্বনির্ভর ও নিরাপত্তাপূর্ণ। আর মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে সৃষ্টি হবে ঐক্য ও সংহতি।
কিন্তু আজ চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ মুসলিম উম্মাহ্ তথা বিশ্ব সভ্যতার বর্তমান অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিলে এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পাবে সেখানে ক্ষুধা ও দরিদ্র্যতার কষাঘাতে মানবতার আজ করুণ পরিণতি। যেমন : এক গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে -
* গোটা পৃথিবীর ৬০০ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের অভাবে দারিদ্র্যর কষাঘাতে ধুকে ধুকে মরছে।
*দুই বিলিয়ন মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের নীচে। যখন বিশ্বের তাবৎ সম্পদের ৮০% ভোগ করছে মাত্র ২০% মানুষ। আর বাকী মাত্র ২০% সম্পদ ভোগ করছে পৃথিবীর অবশিষ্ট ৬০% মানুষ।
*বিনা চিকিৎসায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যুবরণ করছে মানবতার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
*যে কোমলমতি শিশুর শিক্ষানিকেতনে আলোকময় পরিবেশে থেকে নিজেকে আলোকিত মানুষ রূপে গড়ে তোলার কথা ছিল, দারিদ্র্যের কারণে আজ তাকে দেখা যাচ্ছে হাটে-বাজারে, রাস্তায়, ষ্টেশনে শ্রম বিক্রয় করতে। কেউ কেউ আবার ভিক্ষা করছে। এদের অনেককে নালা-নর্দমা ও ডাষ্টবিনে ফেলে দেয়া পঁচা খাবার তুলেও খেতে দেখা যায়।
*দারিদ্র্যের কারণে অশিক্ষিত রয়ে যাচ্ছে সমাজের একটি বিশাল অংশ, যে কারণে বেকারত্ব বাড়ছে আলোর গতিতে। দারিদ্র্য ও বেকারত্বের অমানিশায় পতিত হয়ে হতাশা কাটানোর জন্যে যুবসমাজ আজ মাদকের ভয়াল গহব্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজনি, খুন, ধর্ষন, ইভটিজিং, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনাময় নবপ্রজন্ম। এসব অপরাধ বাড়ার কারণে জনমনে সৃষ্টি হচ্ছে আতংক, কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে নাগরিক জীবন যাপন, আইন শৃংখলার অবনতি সহ যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড। জাতীয় অগ্রগতি হচ্ছে বাধাগ্রস্থ, পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর্ন্তজাতিক ভাবে নিন্দিত হচ্ছে দেশ ও জাতি।
*ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে পরম মর্যাদাবান মাতৃসমাজকে আজ সতীত্ব বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। পতিতা বৃত্তির মত চরম ঘৃনিত কাজ পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ফলে মনুষ্যত্ব বোধের চরম অধঃপতনের সাথে সাথে বেড়ে চলছে সিফিলিস, গনরিয়া, এইডস সহ মারাত্মক মরণ ব্যধি।
*সুদ ভিত্তিক দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থার দারস্থ হয়ে স্বর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সুদের কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, আবার ভিটে মাটি বিক্রি করে বাস্তুহারার কাতারে শামিল হতেও দেখা যাচ্ছে অনেক কে।
* আবার কেউ কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে ঈমানের বিনিময়ে দায়মুক্তি নিচ্ছে বলে ও পত্র পত্রিকায় খবর প্রকাশ পেয়েছে।
*এ সুযোগে অনেক আর্ন্তজাতিক ফোরাম দেশে বিভিন্ন নামে সংস্থা খুলে সাহায্য তথা দারিদ্র্য বিমোচনের নামে অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছে মহা সমারোহে। ফলে সংস্কৃতির নামে চর্চা হচ্ছে নগ্নতা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার। মুক্ত সংস্কৃতির নামে যৌনতা নির্ভর চলচিত্র নির্মাণ, ফ্যাশন শো ইত্যাদির মাধ্যমে কেড়ে নিচ্ছে শত বছর থেকে চর্চিত সভ্যতা সংস্কৃতির ধারা। যার ফল শ্রুতিতে শালীনতা, ভদ্রতা ও নৈতিকতা পবিত্রতার মহৌষধ পর্দা ব্যবস্থা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
*দারিদ্র্যকে পূঁজি করে শিক্ষা সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার মুসলিম শিশুকে ইসলাম বিদ্বেষী চেতনায় দীক্ষিত করা হচ্ছে। তাই যে শিশু হওয়ার কথা ছিল মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ, আল্লাহপ্রেমী, ঈমানদীপ্ত খাঁটি মুসলিম, সে শিশু হচ্ছে আধুনিকতার নামে উগ্র , মুক্তমনার নামে দিকভ্রান্ত, নাস্তিক। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাবে আমাদের তাহযীব তামাদ্দুন, কৃষ্টিকালচারে মুসলমানিত্ব বলতে আর কিছুই থাকবে না। এক কথায় দারিদ্র্যের কারণে আজ আমাদের ঈমান-আকীদা ও স্বকীয়তা স্বাধীনতা সবই হুমকির সম্মুখীন।
এই অনিবার্য ধ্বংসের হাতছানি থেকে মুক্তি সাধনের জন্য মুসলিম উম্মাহ্র একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে মহান স্রষ্টা প্রদত্ত সামগ্রীক জীবনব্যবস্থা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। বিশেষ ভাবে যাকাত ও উশর ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা।
কেননা মানব জীবনে আর্থ সামাজিক সমস্যার সমাধানে যাকাত ও উশরের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন এবং মানব কল্যাণমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে তা বস্তবায়ন করলে সমাজে ধনী ও গরিবের মাঝে যে বিস্তার ব্যবধান রয়েছে তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
এ ছাড়া পুঁজিবাদী আগ্রাসনে সমাজে দীনতা ও অভাবের ফলে যে অপরাধ প্রবনতা দেখা দিয়েছে তা মুলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। আজকে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত এবং উশর সহ সকল প্রকার সাদাকাহ সংগ্রহ করে দরিদ্র, দুঃস্থ, ফকীর, মিসকীন, বেকার লোকদের সচ্ছলতা দানের উদ্দেশ্যে তাদের জন্য বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা ও কল্যাণমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবী। এতে করে সমাজে বেকার সমস্যার সমাধান ঘটবে এবং সমাজ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ। দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রধান দিক হলো পল্লী জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন। কারণ, দেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী পল্লী অঞ্চলে বসবাস করে থাকে। তাই দারিদ্র্য দূর করতে হলে সর্ব প্রথমে পল্লী অঞ্চলের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান দেশী-বিদেশী অনেক এন.জি.ও সহ দেশের সরকারী ও অর্ধ-সরকারী বহু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে ঋণদানে এগিয়ে আসলেও এখানে ঋণ সুদভিত্তিক হওয়ায় পল্লী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়ন বহুলাংশে ব্যর্থ হচ্ছে । তাই রাষ্ট্রীয় ভাবে যাকাত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এর অর্থ গরীব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনা সুদে বিনিয়োগ করা হলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব।
তাই গোটা মুসলিম উম্মাহ্ কে একাজের পূর্ণতা দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক ভাবে যাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।
যাকাত সিরিজের সব গুলো পোষ্ট -----
১ম কিস্তি------যাকাতের পরিচয়----- Click This Link
২য় কিস্তি------আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন সহ মানব কল্যাণে যাকাত ও উশরের ভূমিকা------ Click This Link
৩য় কিস্তি------যাকাত ও উশরের নিসাব ও পরিমাণ নির্ধারণ------ Click This Link
৪র্থ কিস্তি------যাকাতের বিস্তারিত মাসায়েল ------ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:৫৯