যাকাতের বিবরণ
ভূমিকা : ইসলাম মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর কল্যাণকর এক পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলাম মানুষের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবীয় মূল্যবোধের সাথে সমন্বিত ও ভারসাম্য মূলক আর্থ-সামাজিক জীবন পদ্ধতি উপহার দিয়েছে বিশ্ব মানবতাকে। ইসলাম সুখী সমৃদ্ধ কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন সুস্থ রাজনৈতিক বিধান দিয়েছে তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছে ইনসাফপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থা। সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাতক প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্তকরণ এবং ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করার জন্য অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। তাই আর্থ সামাজিক ভারসাম্য সংরক্ষণে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে যেমন একদিকে সম্পদের পরিশুদ্ধি ঘটে তেমনি বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্পদের ঘাটতি হলে ও পরিণামে তা হয় বৃদ্ধি প্রাপ্ত।
যাকাতের শরয়ী মর্যাদা
যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন বা স্তম্ভ। ইসলামের মধ্যে ঈমানের পরে সালাতের আর সালাতের পরেই যাকাতের স্থান। যাকাত হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার একটি সুন্দর সমাধান। যাকাত দ্বীনের এমন রুকন যা অস্বীকার করা কুফরী। সালাত ও যাকাত প্রকৃত পক্ষে গোটা দ্বীনের প্রতিনিধিত্বকারী দু’টি ইবাদত। দৈহিক ইবাদতে নামায সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে। আর আর্থিক ইবাদতে যাকাত সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে।
সালাত দ্বারা অপরাধ ও দুর্নীতি মুক্ত সুশীল সমাজ বিনির্মিত হয় আর যাকাত দ্বারা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মুক্ত আর্থিক সমাজ গঠিত হয়। বস্তুত ইসলামের মধ্যে সালাত ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করার কোন সুযোগই নেই। সুতরাং কেউ যদি যাকাতের ফরযিয়াত বা বাধ্যবাধকতা কে অস্বীকার করে, সে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে, যদি ও সে নিয়মিত নামায আদায় করে।
যাকাতের পরিচিতি
(زكواة)যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা, পরিশুদ্ধিতা, বিশুদ্ধ হওয়া, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য, বেড়ে যওয়া, বিকশিত হওয়া, বরকতময় হওয়া, উপযুক্ত হওয়া প্রভৃতি। {মুজমাউল লুগাল আল আরাবিয়্যাহ, আল মু’আজামুল অসীত্ব।}
কেননা যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র।
ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় প্রত্যেক সাহিবে নেসাব মুসলমান তার জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে শরীয়াতে নির্ধারিত অংশটুকু আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়।
সুতরাং যাকাত হচ্ছে, বিত্তবানদের ধন-সম্পদের সেই অপরিহার্য অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা বিধান, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করা হয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. বলেন: যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত আদায়কারীর মন ও আত্মা পবিত্র হয়, বৃদ্ধি পায় তার ধন ও সম্পদ। এই ক্রমবৃদ্ধি ও পবিত্রতা কেবল ধন মালের মধ্যেই সীমিত থাকেনা, বরং তা যাকাত প্রদান কারীর মন-মানসিকতা ও ধ্যান ধারণায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
সম্ভবত এ দিকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ خُـذْ مِـنْ اَمْـوَالـِهِمْ صَدَ قَـةً تُـطَـهِّـرُهُمْ وَتُـزَكِّـيْـهِمْ بِهَا
‘হে নবী আপনি তাদের ধন সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করুন, এবং এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করবেন’। {সূরা আত -তাওবা-১০৩}
অনুরূপ যাকাত দানকারীর মাল বর্ধিত হওয়ার বিষয়ে ও মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন ঃ وَمَا اتَـيْـتُمْ مِنْ زَكَواةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَأُولئِـكَ هُمُ الْـمُضْعِـفُوْنَ
‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা যাকাতদানকারী তার সম্পদ বর্ধিত করে’। {সূরা আর রূম-৩৯}
সুতরাং মহান অনুগ্রহকারী আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সমাজের সামর্থবান লোকদের উপর তার সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্র ও অসহায় লোকদের মাঝে দান করা অপরিহার্য।
যাকাতের গুরুত্ব
সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
১. যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন বা স্তম্ভ।
২. যাকাত প্রদানের অকাট্য নির্দেশ।
৩. যাকাত উসুল করার নির্দেশ।
৪. যাকাত মুমিনদের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য।
৫. যাকাত মুসলমানদের জামায়াতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার একটি অপরিহার্য শর্ত।
৬. যাকাত আত্মা ও সম্পদের পবিত্রতা সাধন করে।
৭. যাকাত সম্পদের বৃদ্ধি সাধন করে।
৮. যাকাত আদায় না করা মুশরিকদের কাজ।
৯. যাকাত অস্বীকারকারীর নামায কবুল হয় না।
১০. যাকাত অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ।
১১. যাকাত অনায়দায়কারীর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা রাসূল সা. এর।
১২. যাকাত আদায় না করায় ইহলৌকিক ও পরলৌকিক ভয়াবহ শাস্তির বিধান।
বিস্তারিত বিবরণ :
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এর উপরই ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মেরুদন্ড স্বরূপ। আল কুরআনে সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইরশাদ হচ্ছে اَقِـيْمُوْا الصَّـلوةَ وَ ا تُـوْا الزَّكواةَ
“সালাত প্রতিষ্ঠ করো এবং যাকাত আদায় করো”।{সূরা আল বাকারা-৩৯}
এভাবে আলকুরআনে মোট ১৯টি সূরায় ২৯ আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়। এর মধ্যে ৯টি মাক্কী সূরা এবং ১০টি মাদানী সূরা। মাক্কী সূরায় যাকাতকে মুমিনদের একটি মহৎ গুণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজ সমষ্টির কোন দায়িত্বের কথা তাতে বলা হয়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাদানী সূরা সমূহে।
নবী করীম সা. তার বহু সংখ্যক হাদীসের মাধ্যমে ইসলামে যাকাতের স্থান ও গুরুত্ব স্পষ্ট করেছেন। তিনি তা আদায় করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন তার উম্মাহকে এবং যারা তা দিতে অস্বীকার করে তাদের জন্য সাবধান বানী উচ্চারণ করেছেন। সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীস সমূহে যাকাতকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাই নবী করীম সা. বিভিন্ন স্থানে গভর্নর/প্রশাসক প্রেরণের সময় তাদেরকে যাকাত সম্পর্কিত কুরআনী গুরুত্ব স্বরণ করিয়ে দিতেন। যেমন তিনি হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. কে ইয়ামনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণকালে বলেছিলেন যখন তুমি ইয়ামানে আহলে কিতাবদের নিকট আগমন করবে, তাদের তুমি দাওয়াত দিবে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এর সাক্ষ্য দানের জন্য। তারা যদি তা মেনে নেয়, তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহতায়ালা তাদের উপর ফরয করেছেন দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। তারা তা মেনে নিলে তাদের জানাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর সাদাকা তথা যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদেরই গরীবদের মাঝে বন্টন করা হবে। তারা একথা মেনে নিলে তারপর তোমাকে সতর্কতা অবল্বন করতে হবে যে, তাদের ধন মালের উত্তম অংশ তুমি নিয়ে না নাও, আর মাজলুমের ফরিয়াদকে অবশ্যই ভয় করবে। কেননা তার এবং আল্লাহর মাঝে কোন আবরণ থাকে না। এ হাদীসে সালাত এবং যাকাত আদায়ের জন্য নবী করীম সা. বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
ঈমানের সাক্ষ্য দেয়ার পর সালাত এবং যাকাতকে ভ্রাতৃত্ববোধের সেতু বন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসংঙ্গে আল্লাহ তায়া’লা নিজেই বলেন
فَاِنْ تَابُـوْا وَاَ قَـامُوْا الصَّلواةَ وَاتَوُا الزَّكواةَ فَاِخْوَانُـكُمْ فِـى الدِّيْـنِ
‘‘তারা যদি (কুফর ও র্শিক) তাওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই’’।{ সূরা-আত তাওবা-১১}
যাকাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এতো বেশি যে আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে সমস্ত প্রতিনিধি দল নবী করীম সা. এর নিকট সাক্ষাতের জন্য আগমন করত তিনি তাদের প্রত্যেককেই সালাত কায়েমের পাশাপাশি যাকাত প্রদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। এ প্রসঙ্গে জাবির ইবনে আবদুল্লাহর রা.বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন
بَايَـعْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلى اِقَامِ الصَّلوةِ وَاِيْتَاءِ الزَّكواةِ وَالـنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ
‘‘ আমি নবী করীম সা. এর হাতে সালাত কায়েম যাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য উপদেশ দেয়ার বায়আত করেছি’’।{সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম}
রাসূলে করীম সা. যাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করানের জন্য এর অনাদায়কে যুদ্ধের কারন হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সর্তকবাণী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ
اُمِرْتُ اَنْ اُقَاتِل النَّاسَ حَتّي يَشْهَدَ اَنْ لَّااِلهَ اِلَّا اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ وَيُقِيْمُوْا الصَّلوةَ وَيُؤ تُوْا الزَكواةَ
“আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে”।
যাকাত শুধু এই উম্মতের উপরই ফরয নয় বরং পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতের উপর এটি ধর্মীয় ফরয রূপে প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপ ছিল।
এমন কোন উম্মতই অতিবাহিত হয়নি যাদের প্রতি দরিদ্রকে সাহায্য ও স্বজাতির সেবা করার আদেশ দেয়া হয়নি। কিন্তু এ বিষয়ে ইসলামের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, ইসলাম কেবল মাত্র সাহায্য-সেবার আদেশ প্রদান করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং ধনবান মুসলিমের উপর যাকাত ফরয করে সকল আয় পুংখানুপুঙ্খরূপে হিসাব করতঃ প্রতি বছর আদায় করা অবশ্যই কর্তব্যরূপে ঘোষণা দিয়েছে।
এছাড়া ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় সম্পদ বন্টনের সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে যাকাতকে গণ্য করা হয়েছে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান পার্থক্য হ্রাসের জন্য যকাত একটি অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার।
কিন্তু যাকাত কোন স্বেচ্ছা মূলক দান নয় যা দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদেরকে দয়া করে দেয়া হয়। যাকাত হলো ধন-সম্পদ থেকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় এর নির্দিষ্ট অংশ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন
وَفـِىْ اَمْوَ الِـهِمْ حَقٌّ لّـِلسَّـائِـلِ وَالْـمَحْرُوْمِ
“আর তাদের সম্পদে রয়েছে নিঃস্ব ও বঞ্চিতদের অধিকার”।
যাকাতের মর্মকথা
সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিক হচ্ছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। ইরশাদ হচ্ছে للهِ مُلْكُ السَّموتِ وَالْاَرْضِ وَمَا فِيْهِنَّ
“আসমান যমীন ও এর মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার একচ্ছত্র মলিকানা আল্লাহ তায়া’লার”।
সুতরাং তিনি অত্যন্ত অনুকম্পা দেখিয়ে শুধু মাত্র পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাঁরই মালিকানা এই সম্পদকে বান্দাদের ভিতরে বন্টন করেছেন । তাদেরকে এই সকল সম্পদের তাঁরই প্রতিনিধি করেছেন।
আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেছেন - وَاَنْفِقُوْا ِمـمَّا جَعَـلَـكُمْ مُسْتَخْلِـفِـيْـنَ فِـيْـهِ
“এবং যার উপর তোমাদেরকে তিনি প্রতিনিধি বানিয়েছেন তা থেকে তোমরা খরচ করো”।
তা হলে একথা স্পষ্ট যে, প্রথিবীতে যে ব্যক্তি সম্পদের মালিক, মুলত - আল্লাহর দয়া-অনুগ্রহেই সে ঐ গুলোর মালিক হয়েছে। এ সকল সম্পদের যাকাত দানের মাধ্যমে আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও অনুকম্পার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়। সাথে সাথে ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর সম্পদের ভালোবাসা যাতে বান্দাদেরকে আচ্ছন্ন করে চিরস্থায়ী আখিরাত বিমুখ না করে তোলো, তাই যাকাত ও সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সেই শিক্ষাকে যাকাত দাতার মনে লালনের সুযোগ করে দেয়।
উল্লেখ্য যে, মানুষের সাথে দুই শ্রেণীর অধিকার জড়িত থাকে। একটি হুকুকুল্লাহ বা আল্লাহর হক। অপরটি হচ্ছে হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক। যাকাত মুলতঃ বান্দার হক আদায়ের অন্যতম মাধ্যম।
যাকাত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য
যাকাত ব্যবস্থা প্রকৃত পক্ষে মুমিনের অন্তর থেকে দুনিয়ার মহব্বত ও তার দিল থেকে উৎপন্ন যাবতীয় অলিক চিন্তা ও কুমন্ত্রণা পরিস্কার করে সেখানে আল্লাহর মহব্বত সৃষ্টি করতে চায়। এটা তখনই সম্ভব যখন একজন মুমিন বান্দা যাকাত আদায়ের সাথে যাকাতের সে প্রাণশক্তি নিজের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা করে এবং মনে করে আমার কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর । সে সব তাঁরই পথে খরচ করেই তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা যেতে পারে।
মূলত যাকাত ব্যবস্থা গোটা ইসলামী সমাজকে কৃপণতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, মনের কাঠিন্য এবং শোষণ করার সূক্ষè প্রবণতা থেকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে।
যাকাত আদায়ের প্রতি অবহেলা এবং আদায় না করার ভয়াবহ পরিণাম :
যাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির জন্য যেমন পরকালীন শাস্তি রয়েছে তেমনি তার জন্য রয়েছে বৈষয়িক শাস্তি। এ শাস্তি যেমন শরীয়ত সম্মত তেমনি পরিণামগত।
পরকালীন শাস্তি ঃ
১. পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছেঃ
وَلَا يَـحْسَبَنَّ الّذِيْنَ يَـبْـخَلُوْنَ بِـمَا اتَـهُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِه هُوَ خَيْرً الَّـهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّـهُمْ سَيُـطَـوَّقُـوْنَ مَا بَـخِلُوْا بِـه يَوْمَ الْـقِـيَامَةِ
“যে সব লোক কে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে ধন-দৌলত দিয়েছেন, তারা এগুলোকে নিয়ে কৃপণতা করে যেন মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল জনক। বরং এটা হচ্ছে তাদের জন্য খুবই খারাপ বিষয়। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছে, তা কেয়ামতের দিন হাঁসুলী বানিয়ে তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে”।
২. যাকাত না দেয়ার ভয়ংকর পরিণতির কথা আরো পরিস্কার ভাষায় আলকুরআনে ঘোষিত হয়েছে ঃ
وَالَّذِيْـنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَايُـنْـفِـقُوْنَـهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَـذَابٍ أَلِيِـمْ- يَوْمَ يُـحْمـى عَلَيْـهَا فِىْ نَاِر جَهَـنَّمَ فَتُكْوى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُـنُـوْبُـهُمْ وَظُـهُـوْرُهُمْ- هذَا مَا كَنَـزْتُمْ لِأِنْـفُسِكُمْ فَذُوْقُـوْا مَا كُـنْـتُمْ تَـكْـنِـزُوْنَ
“যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরক যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। এমন একদিন আসবে যে দিন জাহান্নামের আগুনে এসব স্বর্ণ ও রৌপ্যেকে উত্তপ্ত করে তা দিয়ে তাদের চেহারা, মুখমন্ডল, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে , এবং বলা হবে এ হচ্ছে সেই ধনসম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। অতএব এখন তোমাদের সঞ্চয় করা সম্পদের স্বাদ আস্বাদন করো”।
৩. একদিন নবী করীম সা. দু’জন মহিলাকে স্বর্ণের চুড়ি পরিধান অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এগুলোর যাকাত দাও? তারা বললো, না। তিনি বললেন তাহলে তোমরা কি এটা চাও যে এসবের পরিবর্তে তোমাদের আগুনের চুড়ি পরানো হোক ? তারা বললো না না কখনোই না। তখন নবী করীম সা. বললেন তাহলে এ সবের যাকাত দিতে থাকো।
৪. রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যে ব্যক্তিকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন অথচ সে তার যাকাত প্রদান করে না তাকে কিয়ামতের দিন টাক পড়া গোলাকৃতি চোঁখে দুটি চিহ্ণ বিশিষ্ট বিষধর সাপ গলায় বেড়ী আকারে পরানো হবে। এবং ঐ ব্যক্তির দু’চোয়ালে তার বিষধর দাঁত বসিয়ে বলবে আমি তোমার ধন-সম্পদ।
দুনিয়াবী শাস্তি ঃ
১. যাকাত না দেয়া খরা দূর্ভিক্ষের কারণ বলে রাসূলুল্লাহ সা. হুশিয়ারী দিয়ে বলেছেন ঃ مَا مَـنَـعَ قَوْمٌ الزَّكواةَ اِلَّاحَبَسَ اللهُ عَـنْـهُمْ الْـمَطَرَ
“যে সব লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানাবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করবেন এবং তারা অনাবৃষ্টির কবলে পড়বে”।
২. নবী করীম সা. বলেছেন ঃ مَا تُـلِـفَ مَالٌ فِىْ بَرٍّ وَلَابَـحْرٍ اِلَّا بِـحَبْسِ الزَّكواةِ
“যাকাত আটকে রাখার কারণে স্থল ও জল ভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয়”।
ইসলামের সকল বিধান পালন করার পরেও শুধু যাকাত না দেয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা. এর যুদ্ধ ঘোষণা মূলতঃ ইসলামে যাকাতের সীমাহীন মর্যাদারই বাস্তব প্রমাণ। এ প্রসংঙ্গে তাঁর ঐতিহাসিক বাণী ছিলঃ
وَاللهِ لَاُقَـاِتـلَـنَّ مَنْ فَـرَّقَ بَيـْنَ الصَّلواةَ وَالزَّكواةَ- فَاِنْ الزَّكواةَ حَقُ الْـمَالِ – وَاللهِ لَوْ مَـنَـعُـوْنِىْ عِـنَاقًا كَانُوْا يُـؤَ دُّوْنَـهَا إِلى رَسُوْلِ اللهِ لَـقَا تَلْـتُـهُمْ عَلى مَـنْـعَهَا
“আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব সেই লোকের বিরুদ্ধে, যে নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে। কেননা যাকাত হলো ধন-সম্পদের হক। আল্লাহর শপথ, এক বছরের কম বয়সের দুম্বার বাচ্চা যা তারা রাসূল সা. এর নিকট যাকাত হিসেবে পাঠাত, তা থেকে তারা বিরত থাকলে, অবশ্যই আমি এই বিরত থাকার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো”।