হেডস্যার এবং তাহাদের কথা (প্রথম কিস্তি) :
সুবেদার নজর মাহামুদ
সাল ১৯৭১। নায়েক সুবেদার নজর মাহামুদ দাঁড়িয়ে আছেন ভেড়ামারা হাইস্কুলের মাঠের এক পাশে, তাঁকে অনেকটাই বিচলিত মনে হচ্ছে। হেডস্যার মোঃ রুহুল ইসলাম কে কিছুতে মানানে পারছেন। নজর মাহামুদ চান স্কুল চলুক, ছাত্র আসুক। হেডস্যার অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছাত্রদের কে কিকাজে লাগানো হবে। ছাত্রদের কে পাকিস্তানের ইনফরর্মার বানানোর সুক্ষ কৌশল তিনি ধরে ফেলেছেন।
হেডস্যার ইতোমধ্যই মুজাহিদ বাহিনীর নতুন তালিকাটা সাংবাদিক বক্করের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।সাংবাদিক বক্কর তালিকাটা পৌঁছে দিবেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলামের কাছে।
সুবেদার নজর মাহমুদের সামনে বাচ্চা একটা ছেলেকে ধরে আনা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ছেলেটি মুক্তিযোদ্ধার ইনফরমার। ১৩-১৪ বছরের ছেলেটিকে ভীত মনে হচ্ছে না।
-হেডমাস্টার সাব হাম ইসকো ক্যায়া কারেঙ্গে?
-ছেড়ে দাও। এর দোষ কি? একে একটা বিস্কুট দিলে তোমাদের হয়ে কাজ করবে।
ছেলেটিকে ছেড়ে দেয়া হয়।ছেলেটি বেঁচে আছে, তাঁর বয়স এখন ৬০।
হেডস্যারের আচরণে সুবেদার মাহমুদ বিচলিত হচ্ছেন। তিনি হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে আছেন, আসল ইনফরমারকে তিনি তখনো চিনতে পারেননি।
মাওলানা নুরুল ইসলাম
দিনের আলো নিভু নিভু। পাখিরা ঘরে ফিরছে। সব পাখি ঘরে ফেরে না। মওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব কে বাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারী করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি খুব চিন্তিত। তাঁর বড় ছেলে এখনো বাড়ি ফেরেনি। দেশের অবস্থা ভালো না। তাঁর শহর ভেড়ামারার অবস্থাও ভালো না। ভেড়ামারাতে তিনটা পাকিস্তানী আর্মি ক্যাম্প। জিকে কলোনী, সাতবাড়িয়া আর ভেড়ামারা হাই স্কুলে আর্মি ক্যাম্প করেছে।
মওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব ভেড়ামারায় অনেক সন্মানী লোক। পরহেজগার মানুষ। আরবী, ফারসী , ইংরেজী ভাষার উপর খুব ই ভালো দখল আছে। তার ছাত্র ছাত্রীর অভাব নেই। তিনি ভেড়ামারা হাই স্কুল এবং ভেড়ামারা গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। মেয়েরা পড়াশোনা করবে না এটা তিনি মেনে নিতে পারেনি। ভেড়ামারা হাই স্কুলকে এতো দূর নিয়ে আসতেও তাঁর অনেক অবদান।
মওলানা নুরুল ইসলাম সাহেব হোমিও চিকিত্সাও দেন, তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতাও আছে। মওলানা নুরুল ইসলামকে অনেকেই 'পীর সাহেব' বলে ডাকেন।
মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো। তিনি চিন্তিত অবস্থায় পায়চারী করছেন। তাঁর বড় ছেলে হেডমাস্টার এখনো বাড়ি ফেরেনি। বড় ছেলেকে তিনি খুব পছন্দ করেন।
মওলানা সাহেবের কাছে আজ দুপুরে একটা খবর এসেছে। পরহেজগার ঈমানদার মানুষ হিসেবে তাঁর নাকি উচিত ইসলামের পক্ষে কাজ করা, পাকিস্তানীদের সাহায্য করা। তিনি নিজে অথবা তাঁর যেকোন ছেলেকে পাকিস্তানীর 'দোসর' হতে বলা হচ্ছে।
মওলানা নুরুল ইসলামের দ্বারা এই 'ঈমানী' পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করা সম্ভব না।
তিনি তাঁর বড় ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেশের অবস্থা ভালো না। তাঁর বড় ছেলে স্কুল থেকে এখনো বাড়ি ফেরেনি।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। মাগরিবের ওয়াক্ত খুব অল্প সময় থাকে।নামাজ কাজা করা যাবেনা।
পুনশ্চঃ ঈমানী পরীক্ষায় নাম না লেখানোর জন্য তাঁর পরিবার কে বড় খেসারাত দিতে হয়েছিলো। যথাসময়ে আলোচনা করা হবে।
ক্যাপ্টেন সাত্তার
হেডস্যার তাঁর স্কুল রুমে বসে আছেন। বিকাল পাঁচটা, তাঁর বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। দুপুরের খাওয়া হয়নি। দ্বিতীয় তলায় ক্যাপ্টেন সারোয়ার বসেন।সেখানে আছেন ভেড়ামারার বিশিষ্ট তিনজন ভদ্রলোক।
হঠাত্ পাকিস্তানী আর্মিদের একটা জীপ এসে থামলো।ক্যান্টেন সাত্তার কুষ্টিয়া ক্যাম্প থেকে ভেড়ামারা ক্যাম্পে হাজির হলেন।
হেডস্যার বাড়ি যাবেন ভাবছেন। দুপুরের খাওয়া হয়নি। একটা সিঙ্গারা আর এক কাপ চা খেয়েছেন। আজ বাড়িতে পাবদা মাছ রন্না করার কথা। পাবদা মাছের ঝোল তাঁর খুব পছন্দ।
স্কুলে আপাতত তাঁর কোন কাজ নেই। হেডস্যার হিসেবে তাঁর প্রতিদিন স্কুলে আসা লাগে, মুজাহিদ বাহিনীতে কে কে নাম লিখালো তার তালিকা এবং অন্যান্য তথ্য পাকিস্তানী আর্মিদের রেজিঃ খাতায় তুলে রাখেন।
বরাবরের মতই এক কপি তিনি নিজের পকেটে রেখে দিলেন।
তিনি এখন বাড়ি যাবে। বাড়ি গিয়ে ভাত খাবেন, পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত।
স্যার আপনাকে উপরে ক্যাপ্টেন সাত্তার ডাকছেন। হেডস্যার ক্যাপ্টেন সাত্তার কে চেনেন না। একজন সিপাহী এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন। দোতলায় ক্যান্টেন সারোয়ারের অফিস। দরজার সামনে এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক দাঁড়ানো। তাঁকে অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি হেডস্যার কে ইশারায় সরে যেতে বললেন।
হেডস্যারের ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখা গেল, তিনি সরে গেলেন না। ক্যাপ্টেন সাত্তার তাঁর জন্য ভিতরে অপেক্ষা করছেন।
-কেমন আছো হেডমাস্টার সাহেব?
-জ্বী, আল্লাহতায়ালা যেমন রেখেছেন।
- তোমার কথা শুনেছি। তোমার পিতা একজন পরহেজগার আদমী। অনেকেই তাঁকে পীর বলে ডাকে।
-তিনিও একজন শিক্ষক মানুষ। আমি নিজেও তাঁর ছাত্র।
- তোমার পরিবার নিয়ে বলো।
-আমার দুই মেয়ে। দুজনায় ছোট।
-হুমম। তোমাকে আমাদের সাথে যাওয়া লাগবে।
- কোথায়?
-আমরা যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে।
ক্যাপ্টেন সাত্তারের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। তিনি মজা পাচ্ছেন। শোষকরা তুচ্চ কারণেই মজা পায়।
হেডস্যার ভয় পাচ্ছেন না। ভয় পাওয়ার লোক তিনি নন। তিনি এখন ক্যাপ্টেন সাত্তারের দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্যাপ্টেন সাত্তারকে হেডস্যারের ছাত্র মনে হচ্ছে।
- আমি এখন যেতে পারবো না। দুপুরে খাইনি।
- চলো আমাদের সাথে খাবে।
- কোথায়?
- আমরা যেখানে নিয়ে যাবো।
- আমি গোসল করিনি। গোসল না করে আমি খাইনা।
- গোসল না করলে কিছু হয়না। আমারাও কয়েকদিন গোসল করিনি।
- তোমাদের কি হয় না হয় সেটা তোমাদের ব্যাপার। ঠিক আছে চলে, তোমরা যখন নিয়েই যেতে চাচ্ছো। চলো তোমরা যেখানে নিয়ে যেতে চাও।
হেডস্যার পা বাড়ালেন। তাঁর প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। বাসায় পাবদা মাছের ঝোল আর ভাত।
ক্যাপ্টেন সাত্তার উঠে দাঁড়ালেন। সাথে তার সাঙ্গোপাঙ্গো। হেডস্যারের পাশে হাঁটছেন ক্যান্টেন সারোয়ার। তিনি ক্যান্টেন সাত্তার কে জীপে তুলে দিতে যাচ্ছেন।
ক্যাপ্টেন সাত্তার যাবেন মহিষকুন্ডি।সেখানে নাকি এক মুক্তি ধরা পড়েছে। মুক্তির সংথ্যা দিনদিন বাড়ছে, যথাযথ ব্যাবস্থা নিতে হবে।
- মাস্টার সাহেব। আমরা এখন মহিষকুন্ডি যাবো। সেখান থেকে কুষ্টিয়া। তুমি চাইলে বাসা থেকে খেয়ে আসতে পারো।
- না! আমি বাসায় যাবো, গোসল করবো, খাবো অবার একটু বিশ্রাম নেবো। অনেক দেরি হয়ে যাবে। তারচে আমাকে তোমাদের সাথেই নিয়ে চলো।
-ঠিক আছে তাই চলো।
হেডস্যার জীপে উঠার জন্য পা বাড়ালেন। পিছে তার প্রিয় স্কুল। মাঠের কোণে একটা আম গাছ, গাছ গুলো তিনি লাগিয়ে ছিলেন। এখনো বড় হয়নি।
গাড়ি স্টার্ট দেয়া হয়েছে। ক্যাপ্টেন সাত্তার ক্যাপ্টেন সারোয়ারের দিকে হাত বাড়ালেন।
-ওকে ক্যাপ্টেন সারোয়ার। আমি আবার কাল আসবো।
হেডস্যার তখনো গাড়িতে উঠেন নি।
- তোমরা যদি কালকেই আসবে তাহলে আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচরা করছো কেন? তোমাদেরো সময় নষ্ট আমাকেও বিরক্ত করছো।সরাসরি তো আর কুষ্টিয়া যাচ্ছো না। বরং আমাকে রেখে যাও। দরকার হলে পাহারায় রেখে যাও।
- আচ্ছা তুমি বাড়ি চলে যাও। গোসল করো, খাও। কাল দেখা হবে। পীর সাহেব কে সালাম দিও। তাঁর সাথে দেখা করাও জরুরী।
- ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। বহুত বহুত শুকরিয়া!
জীপ ছেড়ে দিয়েছে। ভেতরে তিন বিশিষ্ট ভদ্রলোক বসা। তাঁদের কে অনেকটাই চিন্তা মুক্ত মনে হচ্ছে।
হেডস্যার বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। পকেটে রাখা তালিকাটা সাংবাদিক বক্করের কাছে দিতে হবে।
বক্কর অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। আর স্কুল ল্যাব থেকে পাচার করা রাসায়নিক দ্রব্য গুলোর কি অবস্থা জানতে হবে।
তিনি তাঁর সাধ্যমত করছেন বাঁকিটুকু তাঁর ছাত্ররা করবে।
আমার কথাঃ
লেখাটা শুরু করেছিলাম প্রায় চার
বছর আগে। কাগজ কলম নিয়ে বসা হয়না ইদানীং।
ভেড়ামারার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক
বিস্ময়কর কিছু অজানা তথ্য আমার
কাছে আছে, আমার লেখাটা আস্তে
আস্তে ঐ দিকেই যেতো। আব্বার সাথে
অনেকদিন বসা হচ্ছে না, কাহিনী গুলো
ঝালাই করে নেয়াও হচ্ছে না। সময় আর মন দুটোয় মিলছে না।
লেখাটাও আটকে আছে। আব্বাও বয়স হয়েছে । ইচ্ছা আছে খুব শীঘ্রই বাকিটুকু লিখে ফেলবো। আগামী মাসের আব্বার আসার কথা আছে। আমি অপেক্ষা করছি।আমার লেখার প্রতিটা অংশ আব্বার মুখ থেকে শোনা। আমি শুধু আমার মত করে লিখেছি। ১৯৭১ যখন আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় সেই গল্প যখন আব্বার মুখ থেকে শুনি তখন দৃশ্যপট লেখার অক্ষরে প্রকাশ করতে পারিনা। আশাকরি আমার আশা পূর্ণ হবে। নচেৎ আজন্ম আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হবে আমার।
লেখায় 'হেডস্যার' মানে আমার আব্বার ছবি সংযুক্ত করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:০১