আমি একজন হ্যাকার, আমি অনেক সাইট ভেংগে ফেলেছি, ওদের ওয়েব পেজে উল্টাপাল্টা ছবি দিয়েছি, ওদের তথ্যগুলিকে জোক্স দিয়ে রিপ্লেস করেছি, ওমুক এ্যাপ্লিকেশন ক্রাক্ করে বাজারে ছেড়ে দিয়ে অমুকের ব্যাবসা নষ্ট করেছি ইত্যাদি নানা ধরনের কথা বলে গর্ব বোধ করে অনেক হ্যাকার। (বড় বড় হ্যাকিং এর কথা বাদই দিলাম।) বন্ধুদের মাঝে অনেক আলোচিত হয়, বন্ধুরা বলতে গেলে একটু আধটু ভয়ও পায় তাদের হ্যাকার বন্ধুটিকে। কিন্তু হ্যাকিং করে যারা অন্যের ক্ষতি করে তারা একবারও ভাবেনা যে তারা আসলে অন্যায় কাজ করছে। আর ১০টি অন্যায় কাজের মতো হ্যাকিং করে অন্যের ক্ষতি করাটাও একটা অপরাধ।
আমি একজন সফ্টওয়্যার টেষ্টার। সফ্টওয়্যার টেষ্টিং করে এর বাগ/ত্রুটি ধরা এবং সম্ভাবনাময় সমাধান দেয়া আমার কাজ। আমার প্রফেশনের পাশাপাশি, সখের বসে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও এ্যাপ্লিকেশন টেস্ট করে সেটার বাগ্গুলি ও সেগুলির সম্ভাবনাময় সমাধানগুলি সাইট ওনারকে বা প্রোগ্রামারকে জানিয়ে দেই। এতো বছরে হয়তো শত খানের সাইটের জন্য এমন সেবা দিয়েছি সখের বসে। কাজটি করতে আমার খুব ভালো লাগে। অধিকাংশ সাইট ওনার/এ্যাপ্লিকেশন ওনার শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়ে থাকেন আমার রিপোর্ট করা বাগ্ পেয়ে, যা আমার ভালো লাগে! হালকা পরিচয় হয়, নিজের দেশ নিয়ে কথা হয়, ইত্যাদি। বেশ ভালই লাগে যখন বুঝতে পারি তারা আমার রিপোর্টেড্ বাগের উপর কাজ করছে।
প্রায় দু'বছর আগে একটা কোম্পানী এতোই খুশি হয়েছিল আমার বাগ্ রিপোর্টে যে আমাকে টি-শার্ট গিফ্ট করেছিল (আরো দু-তিনটি গিফ্ট মিস করেছি আমাদের পোষ্টাল সার্ভিসের লোভের কারনে)। মুলত হয়তোবা তারা আমার বাগ্ রিপোর্টে নয় বরং আমার এ্যাটিচিউডে খুশি হয়ে এমনটি করেছেন। মানে আমি হয়তো পারতাম তাদের ত্রুটিগুলির মাধ্যমে তাদের সাইটেকে পরিবর্তন করে দিতে কিন্তু তা না করে বরং তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি যে তাদের কিছু সমস্যার সমাধান করা উচিত। আর তাই হয়তো তারাও ছোট্ট গিফ্টের মাধ্যমে সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল বিভিন্ন সময়ে।
সম্প্রতি আমি all my notes organizer নামে একটি এ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করে ইউজ করি। টুলটি আমার ভালো লাগে ও দরকারও হয়ে পড়ে। কিন্তু পাশাপাশি এ্যাপ্লিকেশনটির বেশ কিছু বাগ্ও পাই। যথারিতি আমার শখের বশেই সেই বাগ্গুলিকে কোম্পানীর মালিককে জানিয়ে দেই। সাথে আরো কিছু পরামর্শ দেই যা করলে তার এ্যাপ্লিকেশনটি আরো ষ্ট্রং হবে। ইউক্রেইনে থাকা Volodymyr Frytskyy নামের এই প্রোগ্রামার (সাথে তিনি তার কোম্পানীর মালিকও বটে) আমার এই ধরনের এ্যাটিচিউডে খুবই খুশি হন এবং আমার পাঠানো বাগ্গুলির কোন প্রকার উত্তর না দিয়ে আগে তার এ্যাপ্লিকেশনটির আজীবন মেয়াদি লাইসেন্স-কী দিয়ে দেন গিফ্ট হিসাবে। উল্লেখ থাকে যে আমি ট্রায়াল ভার্সন ইউজ করছিলাম। আমি তার গিফ্ট পেয়ে আরো খুশি হই! কারন তার এ্যাপ্লিকেশনটি আমার অনেক কাজে লাগবে আর মাত্র কয়েকদিনেই ট্রায়াল ভার্সনটির মেয়াদ শেষ হয়ে যেতো।
এখানেই শেষ নয়। Volodymyr তার ওয়েব সাইটে আমার নাম প্রকাশ করে দেয় QA/Testers এর লিস্টে (Click This Link) (ভালো কথা, আমার নাম সব সময় থাকবেই সেটা কিন্তু নিশ্চিত নয়। যতো দিন কাজ করবো ততো দিন থাকবে)। নিজের নাম সুদুর বিদেশের এক ওয়েব সাইটে স্থান পাওয়া সত্যিই খুব আনন্দের বিষয়। আর যখন সেটা কিনা হয় শুধুই ভালোবেসে, তখনতো আনন্দের শেষ থাকেনা।
ওখানেও শেষ নয়। আমি বাংলাদেশের ছেলে জেনে, সে বাংলাদেশ নিয়ে নেট থেকে একটু আধটু জানা শোনাও করে। তারপর সে আমাকে আরো সারপ্রাইজ দেয় তার হোম পেজে একটি নতুন জিনিষ দিয়ে। আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে এমন অবাক করার মতো কান্ড সে ঘটাবে! শুধুমাত্র বাংলাদেশীদের জন্য সে ৭১% ডিসকাউন্টে তার এ্যাপ্লিকেশনটি বিক্রির ঘোষণা দেয়। আমি মুগ্ধ হয়ে যাই যে, হয়তো শুধুই আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি এই কাজটি করেছেন। আমার দেশের পতাকা সহ, আমার নাম সহ, ৭১ (১৯৭১) সংখ্যাটি সহ লোগোটি দেখতে আমার খুবই আনন্দ হয়! হোম পেজ্: http://www.vladonai.com/
এই হল একটি ঘটনা যা হয়তো বিরাট কিছু নয়। যা হয়তো কোন মাধ্যমে প্রচারের কিছুই নয়। কিন্তু আমি এই পুরো বিষয়টির সবচেয়ে বড় যে জিনিষটি তুলে ধরতে চেয়েছি সেটা এই যে, আমাদের নতুন প্রজন্মের যারা হ্যাকিং করে অন্যের ক্ষতি করে আনন্দ পাচ্ছে তারা চাইলেই ক্ষতিটা না করে বরং উপকার করে বিশ্বের নানা জায়গা থেকে অনেক ভালোবাসা পেতে পারে। আর সেই সাথে নিজের দেশ ও জাতিকে তুলে ধরতে পারে আরো উঁচুতে।
Volodymyr আমাকে পুরষ্কৃত করে শুধু আনন্দই দেয়নি সাথে সে আমার উপর নির্ভরশীলও হয়ে গেছে। সে চায় আমিই যেন তার এ্যাপ্লিকেশনটি টেষ্ট করি। আমি মনে করেছি, এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে আমাদের উভয়ের পজিটিভ্ আচরন ও রেস্পন্স এর মাধ্যমে।
আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা হ্যাকিং করে অন্যের অনেক ক্ষতি করছেন। সর্বনাস করছেন কারো তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসার। মজা পাচ্ছে এটা দেখে যখন তারা হ্যাকারের আক্রমনকে ঠেকাতে পারছেনা এবং বারে বারে তাদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে, দয়াকরে আপনার (হ্যাকাররা) ট্যালেন্টকে পজিটিভ্ ভাবে ব্যাবহার করুন। দেখবেন দেশ ও বিশ্বের নানা জায়গা থেকে প্রচুর ভালোবাসা পাচ্ছেন। আর কে জানে আপনার প্রতি সেই ভালোবাসা হয়তো পুরো দেশেটাই পেয়ে যাবে।
শিবলী মেহেদী
নোট: পাঠক যতোদিনে গিয়ে এটি পড়ছেন, ততোদিনে উপরোক্ত ছবি ও তথ্য পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ১০:৪০