গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে পাগলা ষাঁড়ের মত ছুটছিল শেয়ারবাজার। লাগামহীন এই উর্ধগতি বড় ধরনের মূল্য সংশোধন অনিবার্য করে তুলছিল। প্রবল ঝুঁকির বিষয়টি নানাভাবে বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও কেউ নিচে তাকিয়ে দেখেনি। যখন তাকিয়েছে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাজারে দর পতন ধসে রূপ নিয়েছে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে সূচক কমেছে ৪০ শতাংশ। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ। ধস ঠেকাতে সূচক পতনের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েও রক্ষা মিলছে না। তীব্র দর পতনে বৃহস্পতিবার লেনদেন শুরুর পাঁচ মিনিটের মাথায় লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের এমন অবস্থায় সর্বস্ব হারানোর ভয়ে দিশেহারা ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী।
২০১০ সালে বাজারে যে অস্বাভাবিক উর্ধগতি ছিল তার মধ্যেই নিহিত ছিল বিপর্যয়ের বীজ। বিনিয়োগকারী ও তারল্য প্রবাহের বিপরীতে শেয়ার সরবরাহ না বাড়ার কারণেই বাজার এমন তপ্ত হয়ে উঠেছিল। সে বছর প্রায় ১৩ লাখ বিনিয়োগকারী বাজারে এসেছেন। অনেকটা আমন্ত্রণ জানিয়েই তাদেরকে বাজারে আনা হয়েছে।
শিল্প খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের হাতে ছিল বিপুল উদ্বৃত্ত অর্থ। বিকল্প বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে এরা শেয়ারবাজারকে বেছে নিয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নজরদারীর সুযোগ নিয়ে শিল্প ঋণের টাকা শেয়ারবাজারে খাটিয়েছেন। অন্যদিকে বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার হ্রাস এবং এর আয়কে করযোগ্য করার মত ভুল সিদ্ধান্তও মানুষকে শেয়ারবাজারমুখী করেছে।
শেয়ার সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত না করেই দেশব্যাপী ব্রোকার হাউজ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের নতুন নতুন শাখা খুলে শেয়ারের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোন খাত থেকেই শেয়ার আনতে পারেনি এসইসি ও ডিএসই। একাধিকবার ঘোষণা দেয়ার পরও ২৬ সরকারি কোম্পানি বাজারে আসেনি। সময়মত ওই কোম্পানীগুলো বাজারে এলে শেয়ারের সংকট এত তীব্র হতো না, দামও বাড়ত না অস্বাভাবিক হারে। তাতে বড় ধরনের মূল্য সংশোধনেরও প্রয়োজন হতো না।
অভিহিত মূল্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও শেয়ারের অতিমূল্যায়নে ভুমিকা রেখেছে। যেসব শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা থেকে ১০ টাকায় রূপান্তর হয়েছে তাদের দাম পাঁচ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি একই রকম দর পতন ডেকে এনেছে।
বেশির ভাগ শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই এক সময় এদের মূল্য সংশোধন শুরু হয়। বার্ষিক হিসাবকে সামনে রেখে নভেম্বর থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ার বিক্রি করতে থাকে। বাজারের এই যখন অবস্থা তখন অপরিনামদর্শীর মত কিছু নির্দেশনা জারী করে পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেয়ারবাজারে চলে যাওয়া যারা শিল্প ঋণের টাকা সঠিক খাতে ওই অর্থ ফিরিয়ে নিতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। হঠাৎ করেই বাড়ানো হয় সিআরআর ও এসএলআর। হঠাৎ করে তারল্যে টান পড়ায় বাজার বড় ধরনের হোঁচট খায়। এতে বিনিয়োগকারীরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শেয়ার বিক্রি শুরু করলে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। এই বিপরীতমুখী টানাপোড়েনই বাজারকে ধসের কিনারায় দাঁড় করায়। এর সঙ্গে সুযোগ সন্ধানী কোন কোন মহলের কারসাজির ভূমিকাও থাকতে পারে।
সংকট উত্তরনে করনীয়
অস্বাভাবিক দর পতনের সর্বনাশা ধারা থেকে বাজারকে বের করে আনার প্রধান উপায় তারল্য ও আস্থার সংকট সংকট দূর করা। আর এর জন্য প্রয়োজন এসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থমন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। অতীতের ভুল-ত্রুটি ভুলে গিয়ে, পারস্পরকে দোষ না দিয়ে এক টেবিলে বসে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজারের সংকট তীব্র হলে এক সময় তা সমাজ এবং অর্থনীতিতেও অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে।
নমনীয় হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে : শেয়ারবাজারে যে তারল্য সংকট চলছে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকই তা দূর করতে পারে। শেয়ারবাজারে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। ব্যাংকভিত্তিক মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউজগুলো সাবসিডিয়ারিতে পরিণত হবার তারল্য সংকটে ভুগছে। এ কারণে তারা নিজেরা যেমন শেয়ার কিনতে পারছে না, তেসনই গ্রাহকদেরকেও শেয়ার কেনার জন্য বর্ধিত ঋণ দেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, কোন ব্যাংক তার সাবসডিয়ারিকে পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। এ কারণে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউজগুলো মূল ব্যাংকের কাছ থেকে চাহিদা মাফিক তহবিল পাচ্ছে না। সাময়িকভাবে এই সীমা ২০ থেকে ২৫ শতাংশে উন্নীত করা যায়। মৌখিক অনুমতিতে ব্যাংকগুলো ভরসা পাবে না, লিখিতভাবে তা অনুমোদন করতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে : কোন কোন ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য থাকা সত্ত্বেও তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ না করে এখন মুদ্রা বাজারে টাকা খাটাচ্ছে। অথচ গত কয়েক বছর এরা শেয়ারবাজার থেকে বিপুল মুনাফা করেছে। এই অবস্থান নৈতিকভাবে কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা তাদের ভেবে দেখা উচিত। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের অবস্থান থেকে সরানোর লক্ষ্যেও কোন কোন ব্যাংক নানাভাবে দর পতনে ইন্ধন যুগিয়েছে। এই আচরণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। বিনিয়োগকারীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের কোন চেষ্টা করে থাকলে নি:সন্দেহে তারা মারাত্মক অপরাধ করেছেন। বিনিয়োগকারী এবং বাজারে পর্যাপ্ত সমর্থন যুগিয়ে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ব করা উচিত।
ট্রিগার সেল থেকে বিরত থাকতে হবে : তীব্র দর পতনে অনেক বিনিয়োগকারীর ইক্যুটি অনেক কমে যাওয়ায় এদের অনেকেই ট্রিগার সেলের (মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউজের ঋণ সমন্বয়ের লক্ষ্যে বিনিয়োগকারীর অনুমতি ছাড়াই তার শেয়ার বিক্রি) ঝুঁকিতে পড়েছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রিগার সেল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরত থাকা প্রয়োজন। কারণ ট্রিগার সেল বাজারে বিক্রির চাপ বাড়াবে, যাতে আরও দর পতন হবে। আবার দর পতন হলে নতুন করে অনেক বিনিয়োগকারী ট্রিগার সেলের মুখে পড়বেন। চক্রাকারে এটি চলতে থাকলে বাজার কোনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পাবে না।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে, বাজারের এই অবস্থায় সাময়িক। বাজার আবার স্বাভাবিক হবে। গ্রাহকদেরকে ততটুকু সময় দেয়া গেলে এরা বিশাল লোকসান থেকে রক্ষা পাবেন।
ট্রিগার সেলে না গেলে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারহাউজগুলোর কিছুটা আর্থিক তির ঝুঁকি থাকতে পারে। তবে বৃহত্তর স্বার্থে সম্ভাব্য এই ক্ষতির ঝুঁকি মেনে নেয়া উচিত। এসব সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ঋণ দিয়ে গত বছরগুলোতে সুদ ও কমিশন বাবদ তারা শত শত কোটি টাকা আয় করেছেন। এই আয়ের একটা অংশ সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) বাবদ ব্যয় তারা করতেই পারে। তাছাড়া এখন একটু সমর্থন না পাবার কারণে বিনিয়োগকারীরা যদি নি:স্ব হয়ে পড়েন তাহলে আগামী দিনে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করার সুযোগও পাবেন না।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে হবে : বাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোও দায়িত্বশীল আচরণ করেনি। মিউচুয়াল ফান্ডের কাজ উর্ধমুখী বাজারে শেয়ার বিক্রি এবং নিম্নগামী সময়ে শেয়ার কিনে ভারসাম্য বজায় রাখা। কিন্তু ফান্ডগুলো করছে না। ফান্ডগুলোর সক্রিয়তা বাড়াতে সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেশ কিছু প্রণোদনাও দিয়েছে। কিন্তু তার পরও এরা বাজারে বিনিয়োগ না করে তহবিলের বড় অংশ ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছে বলে জানা যায়। এদের দায়িত্বশীলতা না বাড়লে আগামী দিনে নতুন মিউচুয়াল ফান্ডের অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে কি-না তাও ভেবে দেখতে হবে।
শেয়ার কিনতে পারে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো : সাধারণ বীমা ও জীবন বীমাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক ব্যাংকের কাছে বিপুল উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এর একটা অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের নির্দেশ দিতে পারে সরকার। এর জন্য কোন ভর্তুকী দিতে হবে না। বরং বাজার স্বাভাবিক হলে ওই শেয়ার থেকে তারা ভাল মুনাফা পাবে।
দায়িত্বহীন বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে : টানা দর পতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা যখন নড়বড়ে তখন কয়েকজন নীতিনির্ধারকের অবিবেচনা প্রসূত বক্তব্য অবস্থাকে আরও নাজুক করেছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের একটি বক্তব্য বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তিনি বলেছেন, শেয়ারবাজার অর্থনীতিতে কোন অবদান রাখে না। এই বাজারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রতি তার কোন সহানুভুতি নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি। এর আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও দুয়েকটি বেফাঁস মন্তব্য করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন। এই ধরনের বক্তব্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
তবে শুক্রবার অর্থমন্ত্রী বাজারের এই সংকটের জন্য এসইসি ও তার কিছু ভুল আছে বলে যে মন্তব্য করেছেন তাকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীরা কিছু আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
ভাল লভ্যাংশ দিতে পারে কোম্পানিগুলো : বাজারের এই পরিস্থিতিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যেসব কোম্পানির হিসাব বছর শেষ তারা একটু আগে আগে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে। ভাল লভ্যাংশের ঘোষণা আসতে থাকলে তাও বিনিয়োগকারীদেরকে কিছুটা উজ্জীবিত করবে।
প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ : বাজার পরিস্থিতি অনেক বেশি নাজুক হয়ে পড়ায় একক কোন উদোগের মাধ্যমে একে স্বাভাবিক করা দুরুহ হয়ে পড়বে। তাই সংশ্লিষ্ট সবাই এক সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
Click This Link