সুহানার দাফন হয়েছিল ১৯ শে শ্রাবণ বৃষ্টির দিনে । তার প্রিয় শহরেই । সুহানা তার জন্ম ও বেড়ে উঠার শহরকে সুন্দর একটা নাম দিয়েছিল “ ঝুম বৃষ্টির দেশ”।
আমি যখনই গাড়ি চালিয়ে দীর্ঘঘণ্টার যাত্রা শুরু করতাম সুহানা
সুর করে বলত ঝুম বৃষ্টির দেশে যাই রে ...
সুহানা অবশ্য সব কিছুরই একটা গালভরা নাম দিত । আমারও একটা গালভরা নাম দিয়েছিল “ টিন্নিপুটুস” ।
প্রায় সবসময়ই আমার আগে ঘুম থেকে উঠত সে । আমার ঠোঁটে ছোট করে চুমু খেয়ে বলত ,
টিন্নিপুটুসটা উঠ তো ।
আমার ব্যাংকার শ্বশুরমশাইয়ের অত্যন্ত আদরের মেয়ে ছিল সে । তিনি সুহানাকে এতটাই ভালবাসতেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সুহানা যখন ঢাকায় চলে এসেছিলো সেই থেকে আর মুরগির মাংস খান নি তিনি । মুরগির মাংস সুহানার খুব প্রিয় ছিল যে !
সুহানার সাথে আমার পরিচয় টাও হয়েছিল অন্যরকমভাবে । আমি তখন মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষে । আমি টুটুল নামে যে ছাত্রটিকে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি পড়াতাম তার হাতে একদিন দেখলাম কিছু বাংলা নোট । জানতে পারলাম ওটা ওর বাংলা ম্যাডাম তৈরি করেছেন ।
এত সুন্দর হাতের লেখা ও উপস্থাপন আমি কমই দেখেছি । লেখক ম্যাডামকে দেখার এক সুপ্ত বাসনা তৈরি হল । মনে মনে তার একটা ছবিও আঁকলাম। ছাত্রের অভিভাবককে বললাম যে ছাত্রের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দু’জন শিক্ষকের একত্রে বসে আলোচনা করা দরকার । ছাত্রের অভিভাবককও ছাত্রের ভবিষ্যতের চিন্তায় আমাদের দুজনকে মিটিং এ বসিয়ে দিল ।
এবং তাকে দেখলাম আমি , মধ্যম গড়নের , লম্বা চুল , ফর্সা রঙ , স্বচ্ছ দৃষ্টি । তার সৌন্দর্যের অধিকাংশ ই ঢেকে রেখেছে তার শালীন পোশাক । কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে তার বুদ্ধিমত্তা । কথা শুনেই বুঝলাম যে মেয়েটি অজস্র বই পড়েছে এবং শিল্প সংস্কৃতিতে তার জ্ঞান সাঙ্ঘাতিক তীক্ষ্ণ ।
কথার মাঝখানে কি কারণে সে হেসে উঠল আর আমি তার নামের সার্থকতা পেলাম “সুহানা”।
ছাত্রের ভবিষ্যত নিয়ে মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতাম তার সাথে । আস্তে আস্তে ছাত্র আর ছাত্রের ভবিষ্যতের জায়গায় কথার বিষয়বস্তুতে আমি আর আমার ভবিষ্যত এসে জায়গা করে নিল ।
কেমন জানি একটা বুক ঢিপঢিপ অনুভূতি নিয়ে সে আমার সমস্ত সত্তায় মিশে গেল। তাকে দেখার ইচ্ছা আর তার সাথে কথা বলার তৃষ্ণা সবকিছু মিলে আমি বুঝলাম , আমার হয়ে গেছে ।
তাকে প্রভাবিত করার কোন উপলক্ষ বাদ দিতাম না । ঈদ, শবে কদর , মেরাজ , সরস্বতী পূজা , মাঘী পূর্ণিমা আর বাংলাদেশের খেলা জেতা ,সব কিছুতেই মেসেজ পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানাতাম ।
সুহানা সবসময় একটা মার্জিত দূরত্ব বজায় রাখত। আর আমার চেষ্টা ছিল সেটা অতিক্রমের ।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডবের পর সুহানার বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার মেডিক্যাল কলেজের টীম তৈরি হল । এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমি সুহানার সারল্য আর পবিত্রতা অনুভব করতে লাগলাম । এ যেন এক সাক্ষাত দেবী ।
এই আরাধ্যকে আমার পেতেই হবে । আস্তে আস্তে জানলাম আমি একা নই , তাকে চাওয়ার তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ । তার মধ্যে আমার বেশ কজন বন্ধুও আছে ।
অবশেষে তাকে আমি পেলাম । এবং কিভাবে পেলাম সে কাহিনী দিয়ে কমপক্ষে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছিনেমা বানানো যাবে । তাকে প্রথম চুম্বনটি করেছিলাম শ্রাবণের দিনে ঝুম বৃষ্টিতে রিকশায় । গাঢ় চুম্বন আর প্রগাঢ় আলিঙ্গনে সুহানাকে সম্পূর্ণ করে পাওয়ার ইচ্ছা তৈরি হল । খুবই দ্রুত বিয়ে করলাম তাকে । ভাবলে অবাক লাগে একটা স্বাক্ষর আর কিছু দোয়া দরূদ পাঠের পর সুহানার পাশে ঘুমানোর অনুমতি পেলাম আমি ।
আমি এক প্রচণ্ড সুপুরুষ , সুহানা এক উচ্ছল হরিণীর মত , আমাদের দাম্পত্য জীবন সে এক নিরবিচ্ছিন্ন সুখের গল্প ।
সুহানার ভাগ্য নাকি আমার জানি না , বিয়ের পর আমি দ্রুত এফসিপিএস শেষ করলাম । আমার হাতযশ চারদিকে ছড়িয়ে গেল । বড় হসপিটালে কাজের সুযোগ হল আমার । আমিও অর্থ আয়ে আর আমার কেরিয়ারে মননিবেশ করলাম ।
আমার আন্ডারওয়্যার থেকে শুরু করে পঞ্চাশ কেজি চালের বস্তা , চেম্বারের দেয়ালের রঙ থেকে শুরু করে আমার পড়ার বিষয়বস্তু ইন্টারনেট থেকে নামানো , সবই সে করত সুনিপুনভাবে । এমনকি আমার খুঁতখুঁতে মা আর পাগলাটে বাবা সবাইকে মানিয়ে চলার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার । আমার আত্মীয় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের দায়িত্বও নিয়ে নিয়েছিল সে । সে যেন ছিল এক সৌর জগতের কেন্দ্র । আমার ভাল লাগত আবার হিংসেও হত খুব ।
সংসার সামলেও সে এক উজ্জ্বল ফলাফল নিয়ে বের হল ।
সমস্যাটা তৈরি হল ক্যারিয়ার নিয়ে । ঘরের বউকে বাইরে কাজ করতে দিলে ঘর কে সামলাবে ? তাছাড়া অধিকাংশ কর্মজীবী মায়েদের সন্তানরা মানুষ হয় না আমি তাকে বোঝালাম । সে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিগুলোর কথা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল । আমি শক্ত রইলাম পাইন গাছের মত, আমার পরিবারও আমার পাশে রইল এই যুক্তিতে যে মেয়েদের সংসারেই মানায় ।
সুহানা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায় প্রতিদিন । বাচ্চা হলে এমনিতেই আটকে যাবে , মা আমায় বলল ।
আমি বীজ বুনে দিলাম । কিছুদিনের মধ্যেই সন্তানসম্ভবা হল সুহানা । কিন্তু ক্যারিয়ার বিষয়ে তার ভাবনার কোন পরিবর্তন নেই ।
আমি প্রচণ্ড একগুঁয়ে জেদি , সুহানাও আমায় যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করত যাতে আমি বিষয়টি মেনে নেই । কিন্তু খুব রাগ হয় আমার, বেঁকে যাই আমি । বাবার কাছ থেকে জীনগতভাবে একগুঁয়েমি আর জিদ পেয়েছি আমি , আমার বাবা আমার মাকে খুব মারতেন , মারতে মারতে মেরেই ফেলতেন এমন।
এক ১৮ ই শ্রাবণে, আমি অনেক পরিশ্রম করে বাসায় ফিরলাম । সুহানা চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এমনটা হয় । আমরা একে বলি ব্লু ম্যাটারনিটি টাইম ।
আমি কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আবার পুরনো রেকর্ডটা বাজাতে শুরু করল । আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না । পিঠ বরাবর এক ঘুষি লাগিয়ে দিলাম । বিস্ময়ে আতঙ্কে সুহানা ঘুরে গেল ।ঘুষিটা সজোরে গিয়ে ওর পেটে লাগল । সাড়ে চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা পেট আঘাতটি সইতে পারল না । চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে গিয়ে সদ্য কাটা মুরগির মত লাফাতে লাগলো । হসপিটালে গিয়েও কোন লাভ হল না । রাত সাড়ে চারটায় মারা গেল সুহানা ।
আমি পাথর হয়ে গেলাম । আমার মা আমার মুখ বন্ধ রাখতে বলল । প্রসুতি অবস্থায় এরকম কত মেয়ে মারা যায় ! শ্বশুরবাড়িতে আমি চুপ রইলাম কাঠের পুতুলের মত । সুহানার বাবা মা আর ভাইয়ের চোখের পানি ওই দিনের শ্রাবণের বৃষ্টিকে হার মানিয়ে দিল ।
শুনেছি আমার শ্বশুরের নাকি মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে ।
সুহানার কথা খুব মনে পড়ে আমার । বারান্দায় ওর লাগানো হাস্নাহেনা গাছটায় এখন ফুল ফোটে । ওর বইগুলো এখনও শোকেস ভর্তি । মাঝে মাঝে ওর ডাইরি খুলে পড়ি । আমার মা আমায় সাহস দেয় প্রতিদিন । অতীতকে মনে রাখতে নেই বাবা । আমিও টোলপড়া সেই হাসিমুখটা ভুলে যেতে চাই , কাটা মুরগীর মত মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর কিম্বা মৃত নিথর সব রকম সুহানাকে ভুলে যেতে চাই আমি,
সৃষ্টিকর্তা তুমি আমায় সাহায্য কোরো ।