সুনীল সমুদ্র দাদা খুবই কম লেখেন ব্লগে। সব মিলে ৩৫টির মতো পোস্ট হবে হয়তো। তবে যাই লিখেন তা হৃদয় ছুঁয়ে যায় সকল পাঠকের। ঘুরেফিরে বারবার পড়তে ইচ্ছে করে, অনেকদিন পর আবার পড়তে ইচ্ছে করে। তাঁর কবিতার রোমান্টিকতা, ভালোবাসা, বিরহ, কষ্ট, যন্ত্রণা আপ্লুত করে রাখে মনের গভীরটাকে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কষ্টকর জীবনের গাঁথা বা কবি হেলাল হাফিজের লাল-নীল কষ্ট ভর করে তাঁর কবিতায়। তাঁর পরিপক্ক হাতে গন্দছন্দের নিটোল গাঁথুনিতে প্রতিটি কবিতা হয়ে উঠে ঠোঁটে ঠোঁটে আবৃত্তির স্বর। কবিতাগুলো পড়তে গেলে একটি বার্তা কানে বাজে স্পষ্ট- এটা সুনীল সমুদ্রের কবিতা। একমাত্র সুনীল সমুদ্রই পারে এরকম কবিতা লিখতে!
মানুষের প্রতি ভালোবাসা সুনীল সমুদ্রের কবিতার ভিত্তিভূমি। এ ভালোবাসাই বারবার তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে কবিতা লিখতে। আপন অন্তরের মহিমায় তিনি সে ভালোবাসার মালা গাঁথেন শব্দের ফুলে। তাঁর কবিতায় একে একে উঠে এসেছে প্রাপ্তি, সারিয়া তাসনিম, কালপুরুষ, কৌশিক, রাগ ইমন, সাদিক মোহাম্মদ আলম, ঝরাপাতা, শাহানা, হাসিন এবং সদ্যপ্রয়াত আমাদের প্রিয় কবি শামসুর রাহমান। প্রাপ্তিকে নিয়ে তাঁর সমসাময়িক পোস্ট আমার কাছে মনে হয় ব্লগে শ্রেষ্ঠ অনুভূতির গল্প। কী আশ্চর্যভাবে তিনি হৃদয় নিংড়ে তুলে আনেন প্রাপ্তিকে নিয়ে মিলন মেলার শাব্দিক উচ্চারণ- ‘অপরূপ অন্য আলোয় প্রাপ্তির জন্মদিন’ কিংবা ‘কোথায় রাখবে তুমি সরিয়ে ‘প্রাপ্তি’-কে, আর কতদূর..?’। সাদিক-কে তাঁর পোস্টের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন হৃদয়ের কথায়-
প্রিয় আইল্যান্ড, বলছি তোমার কথাই আজ-
আর কতোবার বদলে যাবে তুমি শহরের বুকে?
আর কতোবার ছিন্ন ভিন্ন করে
তোমার নিত্য-নতুন আঙ্গিকের পাথর দাবিয়ে
রক্তাক্ত করে দিতে চাও শহরের বুক?
এতোবার বদলে যাবার পরেও তোমার আকার-আকৃতি কোনদিন
একবিন্দুতে হবেনা স্থির?
একবারও দেখতে পাবোনা তোমাকে একাগ্রে কিছুদিন
অবিরাম আগের মতো এক আঙ্গিকে অবিকল?....
কিংবা রাগ ইমন-কে তাঁর শব্দভাবনার শুভেচ্ছায়-
যে শব্দই লিখি না কেন আজ,
ধেয়ে যাবে তোমার দিকেই।
তোমার দিকেই যাবে শুভেচ্ছার শুভ্র যতো মেঘ
অনবদ্য ভবিষ্যত প্রার্থনায় নেমে আসা বিপুল বৃষ্টি
কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়া
স্বর্গীয় সুখের কান্নায় ভাসানো অনিন্দ্য এক হাওয়া।....
প্রিয় কবি শামসুর রাহমান-এ প্রয়াণে তিনি লিখেছিলেন-
তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি
হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল
ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ করেছি বিচরণ
উজাড় বাগানে,
তবু কোন সৌন্দর্য্য আমার ঘরে আসেনি,
আজ অবধি হয়নি গড়া মেঘলোকে মনোজ নিবাস।....
এভাবেই চলে আসে মানুষের প্রতি ভালোবাসার শব্দোৎসব কবি সুনীল সমুদ্রের কবিতার পরতে পরতে। তিনি প্রিয় কবির মৃত্যুতে বেদনাক্রান্ত হন, আবার কাছের মানুষকে তাঁর ভালোবাসার উপঢৌকনে পাঠান জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
কবি সুনীল সমুদ্রের কবিতার সবচেয়ে বড়ো দিক একেবারে ভিতর থেকে উঠে ভালোবাসা, বিরহ, কষ্টের শব্দগুলো সাবলীলভাবে শব্দের গাঁথুনিতে গেঁথে ফেলা। যেমন তাঁর নিজের জন্মদিনে-
এই দিনটির কথা আমি লুকাতে পারিনি।
তুমি না জানলেও জেনেছে প্রকৃতি।
জেনেছে বৃষ্টি , বৃক্ষ আর বিরহী এক নদী।
প্রকৃতির চেয়ে প্রকৃত বন্ধু - কে আর জীবনে ছিল বলো?
আকাশ আর সমুদ্রের চেয়ে বেশী ব্যাকুলতায়
কে আর পেরেছে বলো- আমার কষ্টগুলো শুষে নিতে?
আমি তাই চুপি চুপি তাদের বলেছি।
বলেছি বরষা-ভেজা হে বিষন্ন আকাশ
কেবল তুমিই জেনে রাখো-
আজ আমার জন্মদিন ছিল।....
অথবা এ কবিতাটিতে-
বিশ্বাসে তুলে নাও চন্দনা
অনন্ত প্রীতির রাত,
বৃষ্টির ভীষণ তান্ডব
সহস্র বছর পরে শান্তির
এমন অজানা এক -ঘুম।...
বিশ্বাসে তুলে নাও চন্দনা
যাবোনা সীমান্তে ফেলে, কোনদিন
যদি দুঃসময়, কখনো মুখোমুখী হয়
দীর্ঘ অনলে।
রেখে যাচ্ছি তোমার চাওয়ার চারিদিকে, সব চূড়ায়
অমলিন আমার এ
দৃপ্ত অঙ্গীকার।
সুনীল সমুদ্র তাঁর আশাকে কখনও বিসর্জন দেন না। বৈষয়িক জীবনের নানা বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও জাগিয়ে রাখেন তাঁর আশার দিপালী। তাই তিনি লেখেন-
আমি ভালো, কারণ
নিঃশব্দে জেনে গেছি
নষ্ট হয়ে গেলে এই নদী, নীলাকাশ আর নক্ষত্রের সাথে
আরো বেশী কষ্ট পাবে
নীল নয়না এক নারী।
আমি ভালো, কারণ নষ্ট হতে গেলে
তোমার আর্তচীৎকারে মুহুর্তেই ভেসে যায়
আমার ভুল করে ছোঁয়া- নষ্ট জীবাণুর
সেই সব ভ্রষ্ট-নীল, জঘণ্য নীল যতো পাতা।
আমি ভালো, কারণ নষ্ট হতে গেলে
তোমার আকুলতা অসম্ভব দৃঢ়তায় সব পথ আগলে দাড়ায়
বৃষ্টির মতো বুকে নিয়ে যেন বলে ওঠে-
থাকতেই হবে..., থাকতেই হবে, অন্ততঃ, আমার জন্য,
চিরকাল এইভাবে-
অনন্ত অবিরাম ভালো ।
এক নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ কবি সুনীল সমুদ্র। এ কথার সত্যতা খুঁজে পাই কবিতার এতো বিশাল ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও তিনি পোস্ট দিয়েছেন নিতান্তই কম। এখনও বাজারে তাঁর কোনো বই নেই। অথচ তাঁর যে বিশাল ভান্ডার এ ব্লগ ভাসানো যেতো পোস্টে, তা তিনি করেননি। দু’চারটে বই বের করাও অসম্ভব ছিলো না। ব্লগের কমেন্টে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তি দেখুন-
“আমাদের লেখালেখির স্বর্ণ-যুগের সেইসব দিনগুলোতে সামহয়্যারইন ব্লগ-তো দূরের কথা, ইন্টারনেটেরও তেমন প্রচলন ছিলোনা...। আমি যখন নটরডেম কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের ছাত্র, তখনই শুধূ লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলাম।.... কর্মজীবনে আর সেভাবে লেখা হয়নি।...
বই আকারে প্রকাশ না করলেও, আমার নিজের হাতে লিখে... ফটোকপি করে ... বই আকারে বাধাই করে রাখা একান্ত আপন কাব্য-সংকলন আছে চারটি।.. কাব্য-সংকলন চারটির নাম-
(১) বিধ্বস্ত রোদ, বিবর্ণ চাঁদ (২০ টি কবিতা)
(২) এখন প্রলয় (১১৫ টি কবিতা)
(৩) ভ্যাকেশান মেমোরীজ (১৫টি কবিতা)
(৪) ভালবাসায় ২৮ অনুভব (২৮টি কবিতা)
কাব্য-সংকলন গুলোকে একান্ত আপন বলাটা বোধহয় ঠিক হলোনা। এগুলো কেউ পড়েনি, তা কিন্তু নয়।.. বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব বহুলভাবে পঠিত হয়েছে আমার সংকলন- ভালবাসায় ২৮ অনুভব।....ভালবাসার আটাশ রকমের আটাশটি অনুভব নিয়ে লেখা এ সংকলনটি বই আকারে প্রকাশিত না হলেও এর ফটোকপি পৌছে গিয়েছিলো অনেকের হাতে হাতেই।...সারিয়া, খুব বেশী নষ্টালজিক হয়ে পড়ছি।... নাহ, পুরনো দিনের কথা আর নয়।....”
এই ভান্ডারের মধ্য থেকে কিছু লিরিক পোস্ট দিলে আমাদের পিপাসার্ত প্রাণকে ঠান্ডা করতে পারতো। কিন্তু কবি দাদা আমাদেরক তা থেকে বঞ্চিত করেছেন। অনেক সময় দীর্ঘ কবিতার সাথে গদ্য আমাকে সময় দেয়নি তাঁর সব লেখা পড়তে। আমি অনেক সময শুধু কবিতা পড়েই ব্লগ ছেড়ে বের হয়ে এসেছি। প্রয়োজন অনুভব করেছি বর্তমানের ছোট্ট আঙ্গিকের আধুনিক কবিতার। তিনি আমার প্রিয় থেকে গেছেন তবুও- আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন সামহোয়্যারইনব্লগের কবি সুনীল সমুদ্র। ব্লগে তিনি রাজনৈতিক ক্যাচালে জড়ান না। রাজনৈতিক বিতর্কের পোস্টও তিনি দেন না। কিন্তু কী আশ্চর্য তাঁর রাজনৈতিক চেতনা দেখুন এই কবিতায়-
তোমরা কি সত্যিই অপেক্ষায় থাকো ?
খুব কি অবাক হয়ে ভাবো-
একটি সুন্দর সকালের প্রত্যাশায়- আর কতোবার
প্রতিটি ১৬ ই ডিসেম্বরে-এসে দাঁড়াবে আমাদের
নতমুখ-লজ্জিত দরোজায়?
আসলে অপেক্ষায় আমরাও থাকি-
অপেক্ষায় থাকে গণতন্ত্রী বিশ্বের উন্মুখ শত কোটি চোখ-
একটি ফুলকে বাঁচানোর সংগ্রাম
তবুও কেবলই - দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যায় -
কিছু আগ্রাসী অন্ধ বিবেক, আয়েশে ঘুমন্ত থাকে-
নিজের আখের গুছিয়ে, সুনসান, নিরিবিলি।
সুনীল সমুদ্র দাদাকে আমি তাঁর ব্লগে গিয়ে বারবার তাগাদ দেই- বেশি বেশি কবিতা পোস্ট দেবার জন্য। সামহোয়্যারইনব্লগের প্রতি কীসের অভিমান তাঁর এতো? নাকি বাস্তবতার করাঘাত তাঁকে দেয় না সময়!? তাঁর বিশাল ভান্ডারের থেকে কিছু পোস্ট দিলে আমাদের পাঠকদের মন ভরাতে পারে অনায়াসেই। নিয়ে যেতে পারে আকাশের নীলিমায়, সমুদ্রের গভীরে, ভালোবাসার বাসায়। কারণ-
আসলেই সবাই পারেনা-
সবাই পারেনা ফেরাতে মুখ-
পেছনের ফেলে আসা পথে-
পারেনা বিরহী শব্দমালায় গেঁথে-ফেলে আসা একটি ঝিঁনুক
কুঁড়িয়ে ফিরতে ঘরে- এতো বেশী বিষন্ন , একা একা।...
সুনীল সমুদ্র দাদা নিয়মিত আসুন ব্লগে। কবিতাপ্রিয় আমরা সকলে তাঁর কবিতার মিষ্টি স্বাদ গ্রহণ করি প্রতিদিন- এটাই কাম্য হোক প্রতিটি ব্লগারের।
২৬.১২.২০০৬
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ সকাল ১১:৩৮