ফুলির ছেলেটাকে ফুলি বেশ বড় লোকের ছেলের মত রাখতে চায় , এ নিয়ে অনেকে ঠাট্টা ইয়ার্কি করে । কেউ কেউ বলে চেয়ারম্যান কাজ করতে করতে ফুলির
ভিতরে একটা বড় লোকই ভাব এসে গেছে , কেউ বলে চেয়ারম্যানত আঁটকুড়ে , ওই পোলাই একদিন চেয়ারম্যানের হয়ে যাবে , যে যাই বলে ফুলি ওসব গায়ে মাখে না । ফুলির সব চেয়ে বড় সাহস চেয়ারম্যান আর বেগম সাহেবা , তারা তাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেন । ছেলে তার কলেজে পড়ছে , ছেলেকে নিয়ে ফুলির স্বপ্নের শেষ নাই । ছেলে তার অনেক মেধাবি, সবাই বলে তোর ছেলে একদিন অনেক লেখাপড়া করে বড় চাকরি করবে তখন তোকে কেউ আর অবজ্ঞা অবহেলা করবে না । ফুলির তখন খুব ভাল লাগে, অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণা এই পাওয়ার আনন্দে ভরে ওঠে ।অনেকে তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করে কিরে ফুলি তোর পোলা যে দিন দিন চেয়ারম্যানার খাইয়া চেয়ারম্যানের লাহান হইতাছে , ফুলি হাসে আর বলে দোয়া কর যেন চেয়ারম্যান সাবের তনও বড় হইতে পারে । এ প্রসঙ্গ ফুলি বরাবর এভাবেই সামাল দেয় ।
চেয়ারম্যানের সাহেব এখন অধিকাংশ সময় ঢাকায় থাকেন । বেগম সাহেবও ঢাকায় থাকেন , বছরে হয়তবা একবার দুবার বাড়িতে আসেন , তখন ফুলির অনেক
ব্যাস্ত সময় কাটে নতুন ধানের গুড়ি করে পিঠা বানান , রকম সকম রান্না , ঘর দোর সাফ করা আরও কত কাজ ফুলির ।আজকাল আর সাহেব বেগম সাহেবকে আগের মত খুশী খুশী লাগে না । ক্যামনে লাগবে ? বিয়া হইছে আজ প্রায় ২০ বছর হইল অথচ সংসারে আর কেউ আসল না এত ধন সম্পদ কাকে দিয়ে যাবে । কত ডাক্তার দেখাইল কিছুই হ্ল না । লোকে তাকে আঁটকুড়ে বলে ,শুনতে ফুলির খারাপ লাগে , ফুলি কি কোন প্রমান দিয়ে বলতে পারবে , না চেয়ারম্যান সাহেব আঁটকুড়ে নয় - তা সে পারবেনা । এ সমাজে এরকম কত সত্যইতো মিথ্যার ভীড়ে হারিয়ে যায় আর কত মিথ্যাকে আজীবন মানুষ সত্য বলে কাটিয়ে দিচ্ছে ।
চেয়ারম্যান সাহেব ফুলির ছেলেকে অনেক ভালবাসেন , এত বছর ধরে তো লেখাপড়ার খরচ উনিই দিয়ে যাচ্ছেন । আবার বলেছেন ইন্টারমেডিয়েট পাস করলে
আবুকে তাঁর শহরের বাসায় নিয়ে যাবেন , ওখানেই আবুকে আরও পড়াবেন । আবু লেখা পড়ায় ভাল , ওর জন্য খরচ করলে জলে যাবে না ও আমাদের রত্ন ।
ফুলি চেয়ারম্যানের কথা শুনে চমকে ওঠে ।
জীবনটা আসলে চলচিত্রের মতই , নাহ , আসলে প্রতিটা জীবনই এক একটা চলচিত্র । চেয়ারম্যান ফুলিকে কত আপন জন মনে করে অথচ ফুলি তাকেই বেশি ঘৃণা করে । সেই কবেকার ঘটনা ফুলি তখন কিশোরী কন্যা , মায়ের সাথে কাজ করে চেয়ারম্যান বাড়ীতে , মা মারা যাওয়ার পরে ফুলিই হয়ে ওঠে সকল কাজের মানুষ সকলে তাকে খুব স্নেহ করে , দরিদ্র পরিবারের মেয়ে যাবে কোথায় , আমাদের কাছেই থাকবে আমরাই সময় হলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিব । ফুলি চেয়ারম্যানকে বড় বাপ ডাকতো ।চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলে সুলতান , চেয়ারম্যান সাহেবে ভাবতেন তার অবসর নেয়ার পরে সুলতানই হবে চেয়ারম্যান তাই লেখাপড়ার চাইতে সঙ্গে সঙ্গে রেখে ছেলেকে চেয়ারম্যেন বানানোর পাট দিচ্ছিলেন ।
ফুলির তখন কল্পলোকে ভেসে বেড়ানোর সময় , যে যা বলে তাই মনে হয় সম্ভব । ফুলির মনে হত ফুলি বোধ হয় কোন রাজকন্যা , কি এক চক্রান্তে সে এই বাড়ির দাসী হয়ে আছে । চেয়ারম্যানের ছেলে সুলতান তাকে চিনতে পেরেছে , তাই তাকে ভাল বাসার ডালি দিয়ে বরন করে নিয়েছে। সুলতান তখন ফুলিকে ভালবাসার গল্প শোনাত , ভালবাসার অর্থ বুঝতো, প্রেম ভালবাসা অর্থ বিবাহ নয় , প্রেম সময়ের বন্ধন নয় ,প্রেম- প্রেম হ্ল হৃদয়ের ব্যাপার ।
ফুলি সুলতানের কথা কিছু বোঝে কিছু বোঝেনা তবে এটুকু বোঝে সুলতান ভাই তারে ভালবাসে । মা হারা মেয়েটি তখন কারনে অকারনে সুলতানের ঘরে আসতো । স্বপ্ন দেখে লাল চেলি পরার, কিন্তু তখনও ফুলি জান্ত না ইজ্জত নিয়ে লাল চেলি পরা তার মত অসহায় মেয়েদের জন্য বড্ড কঠিন । ফুলির শরীরে তখন ভালবাসার কনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে ।ফুলি সবার কাছে ধরা পড়ার আগে ছুটে আসে সুলতানের কাছে , সুলতান ভাই আমার শরীরডা কেমুন কেমুন লাগতাছে , কেউ বুঝনের আগে আমরা পালাইয়া যাই , আমরা বিয়া কইরা ফালাই । কি কিইতাছিস তরে বিয়া করমু আমি ? আমার মান সম্মান আর কিছু থাকব , ফুলি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না । ফুলি শুনেছে বড় লোকের ছেলেরা গরীবের মেয়েদেরকে নিয়ে মিথ্যা ভালবাসার খেলা খেলে আজ সে নিজেই সেই ফাঁদে পড়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি। নির্বোধের মত সুলতানের দিকে তাকিয়ে থাকে । সুলতান একটু সময় চুপ থেকে যেন কিছু ভাবল তারপর বল্ল তুই চিন্তা করিস না , ক্লিনিকে যাইয়া সাফ কইরা ফালা যা টাকা লাগে আমি দিমুনে ।ক্যান সাফ কইরা ফালামু ? তুমি না কও আমারে ভালবাস, ভাল যদি বাস তয় বিয়া করলে দোষ কি ? ফুলিরে ভালবাসা এক জিনিস আর বিয়া করন আর আক জিনিস , আর তুই আমারে কেমন ভাল -বাসলি যে আমার ক্ষেতি করতে চাস ? সুলতান ভাই এইডা তুমি কি কও , আমি তুমার ক্ষেতি করতে চাই ? তুই বুঝচ না তরে বিয়া করলে বাজানেরে আর কেউ ভোট দিব , চেয়ারম্যান বানাইব ? বাজান আমারে ত্যাজ্য কইরা দিব না ? আর আগামীতে আমার যে চেয়ারম্যান হইবার একখান হাউস আছিল তাও বরবাদ হইয়া যাইব । হ - বুঝবার পারছি তোমরা শিক্ষিত মানুষ , তোমরা পয়সাওয়ালা মানুষ , তোমরা কত কিছু বলতে পার, কতকিছু ভুলতে পার, তোমরা মনে কর জীবনটা একটা খাতার পাতা , যা মনে হয় পেন্সিল দিয়া লিখতে পার , আবার ইচ্ছা হইল তো আবার রাবার দিয়া মুইচ্ছা ফালাইতে পার কিন্তু আমি তা পারমুনা , আমি আমার ভালবাসার ফুল কিছুতেই ছিঁড়তে পারুম না । ফুলি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । ফুলি তোরে আমি আগেও কইছি ভাল বাসা বয়স মানে না জাত মানে না কিন্তুক বিয়া! বিয়া হইল গিয়া সমাজের ব্যাপার ।এক বুদ্ধি করন যায় , আব্বারে কইয়া গোঙার লগে তোরে বিয়া দিয়া দি , আমাগো ব্যাপাটাও কেউ বুঝবে না আর তুই আমার কাছে আগের মতই থাকবি , কি তুই রাজী ? ছল ছল দৃষ্টিতে ফুলি মাথা নেড়ে সাই দেয় । সুলতান ফুলির সম্মতি পেয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচে ।
সেই থেকে ফুলি সুলতানের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখেনি । কিন্তু গোঙ্গা ? তাকে কি ফুলি স্বামীর আসন দিয়েছিল ? সমাজের নিয়মে গোঙ্গার সাথে ফুলির বিয়ে হয়ে যায় । গোঙ্গা সুলতানের বাবার একজন বিশ্বস্থ আরদালি কিন্তু তার বাক শক্তি নাই ,লিখাপড়া পারেনা । গোঙ্গা বিয়েরপরে কেমন যেন হয়ে গেল অস্থির আস্তির ভাব , সবাই ভাবল ফুলির সাথে ভাব করতে পারছে না তাই এই পাগলামি করছে । সবাই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করছে কিন্তু গোঙ্গা গোঙ্গা হয়েই রইল । বিয়ের সাত দিন না যেতেই গোঙ্গা কোথায় যেন হারিয়ে গেল । ফুলি গোঙ্গার জন্য অনেক কাঁদল , না ফুলি নিজের জন্য কাঁদছে না অবিচারের জন্য কাঁদছে ।
সময় কার জন্য বসে থেকে না তাই সময়ের সাথে সাঁতার কেটে ফুলির কোলে আসে ফুটফুটে আবু । সবাই আবুকে দেখতে আসে সুলতানও আসে আবু চিৎকার
করে কাঁদে সুলতান ফিস ফিস করে ফুলিকে বলে দেখছত ফুলি, চেয়ারম্যানের রক্ত কেমন গর্জন করতাছে । না চেয়ারম্যানের রক্ত ওর গায়ে নাই অর গায়ে
ফুলির রক্ত । ফুলি তুই আমার লগে এখনও রাগ কইরা আছত , রাগ করস কেন , রাগ করিস না এই দুনিয়াটা এমনি ।
এরই মধ্যে বাড়িতে অনেক ধুমধাম হয়ে সুলতানের বিয়ে হয়ে। সুলতান নতুন বউ কে নিয়ে বাকুম বাকুম করে।ফুলির মনটা কেমন করতে থাকে। অনেক বছর পর ফুলির বাবার কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা মনে পড়ে । ছেলেকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে অনেক ক্ষণ কাঁদে , মনটা হাল্কা হয়ে।
জীবনটা বোধ হয় এরকমই ,পাপের শাস্তি বোধ হয় এভাবেই হয়ে। সুলতানকে সবাই আঁটকুড়ে বলে তবুও সুলতান বলতে পারে না " না আমার একটা পোলা আছে , ফুলির বুকের ওই মেধাবী সন্তানটা গোঙার নয়,আমার।" আবার ফুলি জানে গোঙা তার কেউ নয় ,আবুর কেউ নয়।তবু ফুলি চায় আবু গোঙার পরিচয়ে চলুক। এই হল সমাজ।
ফুলি আজকাল সুলতানকে একদম সহ্য করতে পারে না। যখন সুলতান লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে আবুর দিকে তাকায় ফুলির মনে হয় আকাশ থেকে একটা চিল নেমে আসছে ,আবুকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। ফুলি আজকাল এরকম একটা স্বপ্ন ও দেখে।আকাশ থেকে একটা চিল নেমে ছোঁ মেরে আবুকে নিয়ে যাচ্ছে ।না-না তা হতে পারে না, ফুলি আবুকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবে ।তার সন্তান তার কলঙ্কের কথা জানার আগে হ্যাঁ সকলে তার কলঙ্কের কথা জানার আগে ফুলি পালাবে অনেক অনেক দূরে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৮ দুপুর ১:৫০