আজ পহেলা বৈশাখ। দেশজুড়ে নানা আয়োজন চলছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে। সাম্প্রতিককালে পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের উত্সবের প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে এখন শহুরে নব্য ধনিক ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মাতামাতির শেষ নেই। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ শহরের অলিগলি, রাজপথ, পার্ক থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেলে বিক্রি হচ্ছে পান্তা-ইলিশ। অভিজাত হোটেলগুলোতে এদিন পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন একশ্রেণীর মানুষের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু আবহমানকাল থেকেই পহেলা বৈশাখের সঙ্গে এই পান্তা-ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা শহুরে নব্য বাঙালিদের আবিষ্কার। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান জানানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন
দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং সাহিত্যিকরা। তারা বলেছেন, পহেলা বৈশাখে গ্রামের মানুষ ইলিশ মাছ কিনে পান্তাভাত তৈরি করে খায়—এমনটা আমরা কখনও দেখিনি এবং শুনিনি। শহরের যেসব ধনী লোক পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খায়, তারা কৃষকের জীবনযাত্রা দেখেনি এবং গ্রামের সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের সঠিক কোনো ধারণা নেই। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, পহেলা বৈশাখের উত্সবে গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে খাবারের আয়োজনের মধ্যে থাকত চিড়া, মুড়ি, সাধারণ খই, বিভিন্ন ধানের খই, দই, খেজুরের গুড়, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। সকালবেলা নাশতার আয়োজনে থাকত চিড়া, মুড়ি, খই, লুচি, দই, খেজুর গুড় ইত্যাদি। আর দুপুরবেলা থাকত খিচুড়ি এবং বড় কই ভাজা, বড় রুই মাছের পেটি ভাজা, বড় পুঁটি মাছ ভাজা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি। রাতেও এসব খাবার খাওয়া হতো। কিন্তু গ্রামের গরিব বা সাধারণ পরিবারে এমন ধরনের আয়োজন হতো না। তবে তারাও সাধ্যমত উত্সব আয়োজনে মেতে উঠত।
সম্প্রতি প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং ছড়াকার ফয়েজ আহ্মদ পহেলা বৈশাখের উত্সব আয়োজন সম্পর্কে একাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ এবং সাক্ষাত্কারে উল্লেখ করেছেন যে, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কোনো গরিব মানুষের খাবার নয়। গ্রামের মানুষ ইলিশ মাছ কিনে পান্তাভাত তৈরি করে খায়—এটা আমি গ্রামে কখনও দেখিনি, শুনিনি। শহরের যেসব ধনী লোক বর্তমান সময়ে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খায়, তারা কৃষকের জীবনযাত্রা দেখেনি এবং গ্রামের সংস্কৃতি বিষয়ে তাদের সঠিক কোনো ধারণা নেই। তারা এখন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পান্তা-ইলিশ খাচ্ছে এবং একশ্রেণীর মানুষ এটা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে পহেলা বৈশাখে নানা ধরনের আয়োজন করা হতো এবং বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হতো। পহেলা বৈশাখের দিনের আয়োজনের মধ্যে থাকত চিড়া, মুড়ি, সাধারণ খই, বিন্নিধানের খই, দই, ছানার সন্দেশ, খিচুড়ি, বড় কই মাছ, বড় রুই মাছ ইত্যাদি। সকালবেলা নাশতার আয়োজনে থাকত চিড়া, মুড়ি, খই, দই, খেজুরের গুড় ইত্যাদি। আর দুপুরবেলা থাকত খিচুড়ি এবং বড় কই ভাজা, বড় রুই মাছের পেটি ভাজা, বড় পুঁটি মাছ ভাজা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাজি। রাতেও এসব খাবার খাওয়া হতো। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তখন রসগোল্লা এবং পানতোয়া তেমন একটা খেত না কেউ। তবে ছানার তৈরি সন্দেশ খাওয়ার রীতি ছিল। গ্রামের অবস্থাপন্ন এবং ধনী পরিবারে পহেলা বৈশাখে এসব খাবারের আয়োজন করা হতো। কিন্তু আমাদের বিক্রমপুরের শ্রীনগর এলাকায় গরিব সাধারণ হিন্দু-মুসলমান পরিবারে এ ধরনের আয়োজন হতো না। আমাদের এলাকায় তখন ১০-১২টি বাজার বসতো এবং সেখানে মাঝে মাঝে ইলিশ মাছও পাওয়া যেত—যা কেনার জন্য ভিড়ও যথেষ্ট হতো। তবে আমরা কখনও কেউ শুনিনি তখন পান্তা-ইলিশ দিয়ে পহেলা বৈশাখ শুরু করেছে। আর তখন গরিব মানুষের দু’টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনে বিলাসিতা করার সুযোগ ছিল কম। তবে পহেলা বৈশাখে উত্সব হতো—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তখন পহেলা বৈশাখে বিক্রমপুরে ১০টি বাজারে মেলা বসত। মেলায় হাঁড়ি-পাতিল, ছুরি ও দা, বাচ্চাদের খেলনা, ঘুড়ি, বার্ষিক উত্পাদিত ফসল ইত্যাদি বিক্রি হতো। শ্রীনগরের মেলা ছিল অন্যতম। শ্রীনগরকে ঘিরে একটি উত্সব রচিত হতো। এ মেলার বড় আকর্ষণ ছিল দুটি। সকালে শখের ক্রয়টাই ছিল প্রধান, আর বিকালে ঘোড়দৌড়। শ্রীনগর থেকে ১০ মাইল পর্যন্ত রাস্তায় ঘোড়দৌড় হতো। আর শতাধিক বর্ণিল ঘুড়ি উড়ত আকাশে। আমরা যে কেউ সেই ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারতাম। ঘুড়ি কাটাকাটি ছিল উত্সবের প্রধান দিক। আর বাচ্চাদের খেলনা ক্রয়ের মধ্যে ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পুতুল ‘আল্লাদি’। প্রায় সবাই কিনত এ পুতুল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোড়দৌড় চলত এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে পুরস্কারও দেয়া হতো।
প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি, ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পান্তাভাত গরিব মানুষের খাবার। রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত রাখার কোনো উপায় ছিল না; তাই পানি দিয়ে রাখা হতো এবং সকালে আলুভর্তা, পোড়া শুকনো মরিচ ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হতো। আমিও ছোটবেলায় খেয়েছি। কিন্তু এখন পান্তা-ইলিশ ধনী লোকের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে এবং এটা দুর্মূল্যও বটে—যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতিকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। পান্তাভাত একদিন নয়, সারা বছরই খাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন ছিল না। আমরা চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় যেতাম এবং বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনতাম। পহেলা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠানে যেতাম। তখন এসব অনুষ্ঠান ছিল স্বত্বঃস্ফূর্ত। এর মধ্যে কোনো বাণিজ্যিকতা ছিল না। কিন্তু এখানে বৈশাখী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যিকতা ঢুকেছে এবং বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে বড়লোকের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন শুরু হওয়ার পর থেকে পহেলা বৈশাখে জমিদাররা খাজনা সংগ্রহ করতেন। যারা খাজনা দিতে আসতেন, জমিদাররা তাদের মিষ্টি, পান ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় জমিদার বাড়িতে মেলার আয়োজন শুরু হয় এবং মাসব্যাপী চলত এসব মেলা। এক পর্যায়ে এই মেলার সঙ্গে বিভিন্ন দেবদেবীকে যুক্ত করা হয়। কারণ তখন অধিকাংশ জমিদার হিন্দু হওয়ায় সামাজিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে ধর্ম যুক্ত হয়। তিনি বলেন, সম্প্রতি পহেলা বৈশাখের উত্সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রীতি। এই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন আগে ছিল না।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক আমজাদ হোসেন বলেন, পহেলা বৈশাখে ইলিশ-পান্তার কালচার একদমই নতুন প্রজন্মের। যারা শালিধান কিংবা জলমুকুট ধানের নাম জানে না, যারা এই শহরের হাসপাতালে জন্মেছে, বড় হয়েছে কবুতরের খুপরির মতো একটা রুমে, আমাদের শেকড়ের কথা যারা জানে না, যারা এই ঢাকা শহরের তরুণ নাগরিক, ইরি ধানের আমলে তারাই পান্তা-ইলিশ নিয়ে নগরের রাস্তায় রাস্তায় পান্তা-ইলিশ কালচার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আজকাল আমরা পহেলা বৈশাখের দিন ভাতের আয়োজন করি। পান্তাভাত নিয়ে বাড়াবাড়ি কম হচ্ছে না। কবে কোন ফাইভস্টার হোটেল বলে ফেলবে, আমাদের কাছে পাওয়া যাবে স্ট্রবেরি ফ্লেভারড —আমি সে অপেক্ষায় আছি। এভাবে আমাদের সংস্কৃতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।