গত বছর জুলাই থেকে অক্টোবর মেয়াদে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে চীনা সংবাদ সংস'া সিনহুয়া এ খবর দেয়। ২০১০-২০১১ পুরো অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর একমাত্র অবলম্বন প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। এ ধরনের পরিসি'তিতে রফতানি আয় বাড়ানোর সম্ভাব্য ক্ষেত্র খুঁজতে হবে। জাহাজ নির্মাণ শিল্প আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে জাহাজ নির্মাণের ব্যাপারে বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে বিদেশ থেকে। জাহাজ নির্মাতা হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের নামটি জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশী শিপইয়ার্ডগুলোতে কেবল জাহাজের হাল (বডি) নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি মূলত ঝালাই করে কতগুলো স্টিল প্লেট জোড়া লাগানো। জাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রায় সব যন্ত্রপাতি ও আসবাব বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। ফলে কনট্রাক্ট মানির বেশির ভাগ আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমাদের বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে কতটা আমরা ব্যবহার করতে পারব, তা নির্ভর করছে এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, আসবাব এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি জিনিসপত্র নির্মাণে সক্ষমতার ওপর। যদিও মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন, পাম্প ও কমেপ্রসরের মতো উচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় জিনিস এ মূহূর্তে আমরা নির্মাণ করতে সক্ষম নই। আরো অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ রয়েছে যেমন- স্টিল প্লেট, পাইপ, ভাল্ব, বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক তার, সুইচবোর্ড, ট্রান্সফরমার মোটর ইত্যাদি। এগুলো এখনই নির্মাণ করা যেতে পারে। এর জন্য দরকার উদ্যোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।
একটি মধ্যম আকারের জাহাজের নির্মাণ খরচ দুই কোটি ডলার। এর মধ্যে শ্রমিক বাবদ ব্যয় এবং শিপইয়ার্ডের অল্প কিছু লাভ ছাড়া বাকি অর্থ স্টিল প্লেট, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কিনতে গিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, চট্টগ্রামে আমাদের একমাত্র স্টিল মিলটি কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যথায় এটি এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারত। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর কাছে এখন ২০ থেকে ৩০টি জাহাজ নির্মাণের অর্ডার রয়েছে। প্রত্যেকটি জাহাজে গড়ে দুই হাজার টন স্টিল প্লেট দরকার। এই স্টিল টনপ্রতি এক হাজার ডলারে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। অর্থাৎ নির্মিতব্য প্রতিটি জাহাজের স্টিল প্লেট বাবদই প্রায় ২০ লাখ ডলার দেশের বাইরে চলে যায়।
শিল্পায়ন ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি হয়নি। জাহাজ নির্মাণ শুরু করার মাধ্যমে আমরা আশার আলোকচ্ছটা দেখছি। কেউ এটাকে বাস্তবতা থেকে দূরের বলে মনে করতে পারেন। আমরা যদি দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে দেখাবো, কয়েক দশক আগেও তারা ছিল হতদরিদ্র। একটি জাহাজ নির্মাতা দেশ হিসেবে তাদের উত্থান হয়েছে। জাহাজ নির্মাণ তাদের অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগিয়েছে। তারা এখন এশিয়ার অল্প ক’টি ধনী দেশের মধ্যে একটি। জাহাজ নির্মাণ শিল্প আমাদের সে পথে নিয়ে যেতে পারে।
ঢাকার আনন্দ, মেঘনা, খান ব্রাদার্স, এসইএসএল শিপইয়ার্ড এবং চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন ও কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড জাহাজ নির্মাণের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো শিপইয়ার্ডটি খুলনায়। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছোট জাহাজ নির্মাণ করে আসছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য। জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রধানত রফতানিনির্ভর। তবে অভ্যন্তরীণ বাজার কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ২০০০ টন ওজনের ১২টি ট্যাঙ্কার ভেসেল তৈরি করছে। জার্মেনিশার লয়েডের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশী নেভাল আর্কিটেক্টরা নকশা করেছেন এগুলোর। চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন অল্প সময়ের মধ্যে ভালো করেছে। এক বছরের মধ্যে কোম্পানিটি বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানিকে ৮টি জাহাজ সরবরাহ করে এ দেশে নতুন নজির তৈরি করেছে। জাহাজগুলোর এক-একটি পাঁচ হাজার দু’শ টন মালামাল বহন করতে পারবে। ওয়েস্টার্নের এ সাফল্য অন্য অনেককে পথ দেখাতে পারে। এটি সম্ভব হয়েছে কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক ও দেশপ্রেমিক প্রকৌশলীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে। আর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির গতিশীল উদ্যোক্তারা। স্টিল পাইপ, স্যানিটারি সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক মোটর, সুইচবোর্ড, ট্রান্সফরমারসহ জাহাজের প্রয়োজনীয় আরো অনেক উপাদান বাংলাদেশে সহজে তৈরি করা যায়। যদিও এগুলোর নিশ্চয়তার জন্য আন্তর্জাতিক শিপ ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির সনদ দরকার। এ সোসাইটির স'ানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ অনুমোদন নেয়া যেতে পারে। কেউ যদি স্টিল দিয়ে জাহাজের দরজা-জানালা তৈরি করতে চান, তার দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ক্লাসিফিকেশন সোসাইটিকে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। সোসাইটি ওয়ার্কশপে কাজের পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির পর্যাপ্ততা দেখবে। ওয়েল্ডারদের দক্ষতার লেভেল ও শ্রমিকদের অবস'া যাচাই করবে। প্রকৌশলীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রয়োজনীয় মাত্রায় রয়েছে কি না, তা দেখা হবে। ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির নির্ধারিত শর্ত যদি পূরণ করতে পারে সেই কারখানাটি এখনই সংশ্লিষ্ট সাজসরঞ্জাম তৈরি করতে পারবে এবং শিপইয়ার্ড তার কাছ থেকে সেসব সাজসরঞ্জাম কিনবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। উদাহরণস্বরূপ, এয়ার পাইপের কথা বলা যায়। জ্বালানি ও পানির ট্যাঙ্কে এগুলো শুধু বাতাস প্রবাহিত করে, কিন' সমুদ্র থেকে পানি প্রবেশে বাধা দেয়। অত্যন্ত সাধারণ এ যন্ত্রটিও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ এ পাইপগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামে অনেক কারখানাতেই সহজে তৈরি করা যায়। ইলেকট্রিক সুইচবোর্ড, ট্রান্সফরমার, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক্যাল তারের মতো আরো বেশ কিছু জিনিস সহজে ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির অনুমোদন পেতে পারে। আমরা আশা করছি, এ বিষয়ে উৎসাহী উদ্যোক্তারা ভাববেন। যেসব যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জাম তারা তৈরি করতে পারবেন সেগুলোর অনুমোদন নেয়ার জন্য ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির প্রতি অনুরোধ জানাতে পারেন। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় এমন বহু কিছুই অনেক উদ্যোক্তার কারখানায় তৈরি হওয়ার উপযুক্ত। বাংলাদেশে চারটি ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি কাজ করে থাকে। এগুলো হলো, জার্মেনিশার লয়েড, ব্যুরো ভেরিতাস, আমেরিকান ব্যুরো অব শিপিং ও আরআইএনএ। জাহাজ নির্মাণ শিল্প অল্প সময়েই অনেক দূর এগিয়েছে। সবচেয়ে আশার ব্যাপার হলো, কিছু দূরদর্শী প্রত্যয়ী উদ্যোক্তা এর পেছনে নিরলস শ্রম দিচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য এখনো উল্লেখ করার মতো নয়। ভারী শিল্পের এ পথ চলাকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তাদের অদম্য প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার, ইন্টারন্যাশনাল শিপস ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি
সূত্র: নয়া দিগন্ত
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন