একাত্তরে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত-শিবির দেশজুড়ে জুড়ে যে তাণ্ডব লীলায় মেতে উঠেছে তার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা দিয়েছে উত্তরবঙ্গের শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীতে। একেরপর এক হিংসাত্মক ঘটনায় যে প্রশ্নটা সব চেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল_ রেশম নগরী তথা সিল্ক সিটি রাজশাহী কি ‘শিবির সিটি’? রাজশাহী রয়েছে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে শত বছরের ইতিহাস। শিল্প-সাহিত্যে এক অনন্য অবস্থান। সেই জনপদটা কি প্রতিক্রিয়াশীলদের চারণভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে?
রক্তাত্ত রাবি তারপর
১৯৮০ সালের গোঁড়ার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবির কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময়ে ক্যাম্পাসের প্রধান ছাত্রসংগঠন ছিল ছাত্রমৈত্রী। শিবির ক্যাম্পাস দখলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে মসজিদভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় মেস করে বসবাস করে। স্থানীয় লোকজনের বাড়িতে শিবিরকর্মীদের লজিং রাখা হয়। এদের কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে বিয়ে করে আত্মীয়তার সম্পর্ক পর্যন্ত তৈরি করে। লবিং-গ্রুপিং করে চাকরিতে যোগ দেয় অনেকে। নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন কট্টর জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত ইউসুফ আলী। সে সময় শিবির প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের ‘জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবির ক্যাম্পাসে তাদের প্রকাশ্য কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই দিন শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবলা চত্বরে আয়োজন করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান। শিবিরের ওই কর্মসূচিতে সম্মিলিতভাবে বাধা দেয় তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন। সেদিন শিবির এবং বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মারা যান তিন ছাত্র। আহত হন উভয় দলের অনেক নেতা-কর্মী। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম প্রকাশ্য হয়। রাবিতে শিবিরের উত্থানের পেছনে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটনা ঘটেছে। এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ছাত্র, স্থানীয় বিরোধী নেতা থেকে শুরু করে শিক্ষকরাও। তারপরও থেমে থাকেনি শিবিরের সন্ত্রাস। স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতায় বিভিন্ন সরকারের সমর্থনে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আধিপত্যের শিকড় বিস্তৃত করে গেছে। মতিহারের সবুজ প্রান্তর এক সময় হয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জামাত-শিবিরের দুর্গ। কায়েম করে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, আবাসিক হলে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির একক রাজত্ব।
রাবি তে শিবির পরিকল্পিত ভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে চাইলেও জামাত-শিবির মুক্ত করা সম্ভব না। তাই শিবিরের নির্মমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ও প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলি। রাবির পরে শিবির রাজশাহীর অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে। তারপর এখন আন্দোলনের নামে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে রাজশাহী জুড়ে। লক্ষ্য, রাবির মত রাজশাহীবাসীও যেন শিবিরের নির্মমতার ভয়ে আত্মসমর্পণ করে।
ভোটের চালচিত্র
স্বৈরাচার পতনের পরে ১৯৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন জামাত ২২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৮টি সংসদীয় আসন জিতে। প্রাপ্ত ভোট ১২.১৩ শতাংশ। রাজশাহীর ৫টি আসনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চারটিতে। ভোট প্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে: রাজশাহী-১ (তানোর- গোদাগাড়ি) আসনে সাবেক সাংসদ মো: মুজিবুর রহমান পায় ২৫.০৩ শতাংশ ভোট, রাজশাহী-২ (পবা- বোয়ালিয়া-রাজপাড়া-মতিহার-শাহমখদুম) আসনে মো. আতাউর রহমান ২১.৫ শতাংশ, রাজশাহী-৩ (মোহনপুর-বাগমারা) আসনে মো. আ: আহাদ কবিরাজ ২৬.২১ শতাংশ এবং রাজশাহী-৫ (চারঘাট-বাঘা) আসনে মো. আবদুল মান্নান ১৪.৯৭ শতাংশ। এই নির্বচনের ফলাফল জামাতা কে করে দেয় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।
ফলে ১৩ জুন, ১৯৯৬-এ সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামাত ৩০০টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনের ফলাফল জামাতের জন্য হয়ে দাঁড়ায় দুঃস্বপ্ন। আসন জিতে মাত্র তিনটি। ভোট পায় ৮.৬১ শতাংশ। ভোটের সাথে সাথে জামানত হারায় ২২৫টা আসনে। তার মধ্যে রাজশাহীতেই ছিল দুটি। জামাতের রাজশাহীতে ভোট প্রাপ্তির হারও অনুরূপ নিম্নমুখী। রাজশাহী-১ আসনে জামাতের হেভিওয়েট প্রার্থী মো. মুজিবুর রহমানের ভোট নেমে আসে ১৬.১৬ শতাংশতে, রাজশাহী-২ আসনে মো. আতাউর রহমানের ভোট ১৬.৯৪ শতাংশে; রাজশাহী-৩ আসনে মো. আব্দুল আহাদ কবিরাজ ১৭.০৭ শতাংশে ও রাজশাহী-৫ আসনে মো: আবদুল মান্নাফ ৯.২৪ শতাংশ ভোট পায়। নতুন ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা রাজশাহী-৪ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে জামাতের মো: মোখসেদ আলি ১১.৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জামানত হারায়।
পয়লা অক্টোবর ২০০১-এ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামাত চারদলীয় জোটে শোয়ার হয়ে ৩১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ১৭টি আসনে জয় লাভ করলেও জামানত হারায় চারটি আসনে। প্রাপ্ত ভোট এসে দাঁড়ায় প্রদত্ত ভোটের ৪.২৮শতাংশে। রাজশাহীতে শক্তিশালী অবস্থান দাবি করলেও জোট থেকে রাজশাহীর একটিও আসন থেকে মনোনয়ন জুটাতে পরে না। ২০০১-এ বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসলে রাজশাহীজুড়ে নিজেদের অবস্থান অনেক সুসংহত করে।
১/১১-এর পরে, ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহীর সংসদীয় আসন একটি বেড়ে দাঁড়ায় ছয়টিতে। ফলে জামাত জোটের কাছে রাজশাহীতে অন্তত একটি আসনে মনোনয়ন দাবি করে। জোট নিরাস করলে একটি মাত্র আসনে একক ভাবে নির্বচনের সিদ্ধান্ত হয়। রাজশাহী শহর সংলগ্ন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে জামাতের হেভিওয়েট প্রার্থী মো. আতাউর রহমান দাঁড়িপাল্লা প্রতি নিয়ে নির্বাচন করে। জামাত-শিবির নেতাকর্মীদের প্রবল চেষ্টার পরেও জুটে মাত্র ১২.০৩ শতাংশ ভোট_ হারায় জামানত। আরা সারা দেশে জামাতের ফলাফল ছিল ৩৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুইটি আসনে জয় লাভ, দুটিতে জামানত বায়েজাপ্ত। আর প্রাপ্ত ভোট ৪.৭০ শতাংশ।
এখানে দেখার মত বিষয় হল দিনদিন রাজশাহী জামাত শিবিরের ‘ঘাঁটি’ বিশেষণ পেলেও। দেশ অন্যান্য স্থানের মত রাজশাহীতেও জামাতে ভোট কমেছে। উদাহরণ হিসাবে দেখা যায়_ রাজশাহী মহানগর জামাতের আমীর আতাউর রহমান ১৯৯১-এ ভোট পেয়েছিল ২১.৫ শতাংশ, ১৯৯৬-এ এসে তা হল ১৬.৯৪ শতাংশ আর সর্বশেষ ২০০৮-এ ১২.০৩ শতাংশ। ভোটের নিম্নমুখী সূচক এটাই বোঝা, রাজশাহীতে বহিরাগত জামাত-শিবিরের তৎপরতা বাড়লেও ভোটার ও জনসমর্থন ক্রমান্বয়ে কমেছে।
নেই এর নগরী রাজশাহী
পদ্মার পানির মত হারাচ্ছে রাজশাহীর জৌলুস। প্রাপ্তি থেকে অপ্রাপ্তির খতিয়ানে বাড়ছে জের। ‘উন্নয়ন’ শব্দটা স্রেফে নির্বাচনী ফাঁকা বুলি। ‘কেও কথা রাখেনি’-এই চিত্রটাই সর্বত্র। অবহেলা-বঞ্চনায় শ্রীহীন ‘বিভাগীয় শহর’ ‘মেট্রোপলিটন সিটি’-এর সাইনবোর্ড এক নির্মম রসিকতা। অভাগা এই জনপদের জন্য ‘নয় মণ ঘিও পুড়ে না, রাধাও নাচেনা’। তাই ভাগ্য অন্বেষণকারীদের জন্য রাজশাহীর রাজভাণ্ডার শূন্য। সেই নেই এর নগরীতে আছে জামাত-শিবির। যাদের কাছে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’, এই আর্থিক নিরাপত্তা বিনিময়ে দলভারি করছে। এর সাথে রয়েছে ধর্মীয় বিধিবিধানের অপব্যাখ্যা দিয়ে মগজ ধোলায়। আরো রয়েছে ‘ভারত ফ্যাক্টর’। ফারাক্কা বাঁধের জন্য উত্তাল পদ্মা এখন ধু ধু বালু চর। রাজশাহীর প্রাকৃতিক পরিবেশ দিনদিন হয়ে পড়ছে রুক্ষ। বাড়ছে পানির সঙ্কট। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত সীমান্ত পেরিয়ে অবাধে আসছে আসছে মাদক। বাড়ছে মাদক সংক্রান্ত নানা ধরণের অপরাধ। এ সবের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জামাত-শিবির ‘ক্লিন ইমেজ’ ধারণ করে গড়ছে শক্তিশালী ঘাঁটি। নেতৃত্বের অভাবটাও রাজশাহীতে প্রকাণ্ড। জাতীয় চার নেতার অন্যতম ‘বরেন্দ্রবন্ধু’ এ.এইচ.এম কামরুজ্জামানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আজও নেতৃত্ব শূন্যতা পুরন হয়নি।
জামাত-শিবিরের লক্ষ্য
সামনে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন_ তাই ক্ষমতাসীন জোটের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ভাবে জামাত-শিবিরের মোকাবেলা না করে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতে আগ্রহী। ওদিকে প্রধানবিরোধীদলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জোট ও ভোটের খাতিরে দিয়ে রেখেছে ‘নৈতিক সমর্থন’। ফলে ‘ফাঁকা মাঠে’ জামাত শিবির প্রতিপক্ষ করেছে পুলিশকে, আক্রমণের লক্ষ্য সরকারী সম্পত্তি আর সরকারদলীয় নেতাকর্মী। বিগত নির্বাচনগুলিতে রাজশাহীবাসী পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে_ রাজশাহীতে ভোটে জেতা জামাতের পক্ষে সম্ভব না। তাই টিকে থাকার জন্য জামাত-শিবির নেমে পড়েছে গুন্ডাগিরিতে। জামাত-শিবির প্রকাশ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত-দ-প্রাপ্ত নেতাদের মুক্তির দাবিতে ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড চালালেও _তার মূল কারণ কিন্তু নিজেদের পেট আর পিঠ বাঁচানোর। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামাত নিষিদ্ধ হলে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়বে সংগঠনটির ক্যাডারা। হারাবে দলীয় প্রতিষ্ঠানের চাকুরী থেকে শুরু করে প্রাপ্ত সকল সুযোগসুবিধা। তাই নিজেদের রুটি-রুজি বাঁচতে মারিয়া জামাত-শিবির কর্মীরা। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে, অরক্ষিত জনপদটিতে জনমনে ভীতি সঞ্চার করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সামনে জামাত-শিবির আরো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড পরিচালন করবে। এতে একদিকে স্থানীয় পর্যায়ে যেমন দরকষাকষিতে ভাল অবস্থানে যাবে তেমনি সরকারকে বার্তা দিতে পারবে, নিষিদ্ধ হলে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে যাবে জামাত-শিবির।