১.
রিক্সা ভাড়া দিয়ে অরণ্য নারিকেল
গাছের নিচে দাড়িয়ে থাকল ।
পকেটে টাকা দূরে থাক
একটা পয়সাও
নেই । বাংলাদেশে যদি এখনও পাঁচ
পয়সা থাকতো অরণ্যর পকেটে এখন
সেটাও থাকতো না । অরণ্য
দাড়িয়ে আছে লাবণীর জন্য ।
লাবণী ভার্সিটি থেকে বের
হবে কিছুক্ষণ পর । কিছুক্ষণ
অরণ্যর সাথে রাস্তায় রাস্তায়
ঘুরে তারপর বাসায় যাবে । রাস্তায়
সারা দুনিয়ার কথা বলবে । ভাগ্য
খারাপ হলে অরণ্য কিছু
বকা এমনকি মারও খেতে পারে ।
লাবণী অনেক সহজ একটা মেয়ে ।
যা বলার খুব
সহজে গুছিয়ে বলে দিতে পারে ।
অরণ্যকে অনেক বড় বড় লেকচার
দিবে যার আগা-মাথা কিছুই
লাবণী নিজে মানে না কিন্তু
অরণ্যকে মানতে হবে । অরণ্য
কিছুক্ষণ যুক্তি দিয়ে ওর কথার
ভুল দেখাতে চাইবে পরে হাল
ছেড়ে দেয় । তারপর রিকশায়
করে বাসায় চলে যাবে । যাবার
আগে রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার টাকাও
দিয়ে দিবে এবং অরণ্যকে বাসায়
পৌঁছে দিতে বলবে । ওরা কিন্তু
প্রেমিক প্রেমিকা না , শুধুই বন্ধু ।
পরানের বন্ধু , বসম ফ্রেন্ড ।
লাবণী ভার্সিটি থেকে বের হল ।
প্রথমেই ওর হাসির শব্দ
শুনা গেলো ।
বান্ধবীদের
সাথে কি নিয়ে জানি হাসছে । অনেক
সুন্দর হাসি । দেখলে শুধু
তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে ।
অরণ্যকে দেখেই বান্ধবীদের
বিদায়
জানিয়ে ওর কাছে চলে আসতে লাগল
।
কিছুক্ষণ
এসে একটা মুচকি হাসি দিল ।
অরণ্য
চিন্তা করতে লাগল ,
ওকে হেসে দেখল নাকি দেখে হাসল ।
কিরে ছাগলা তর চেহারার এই
অবস্থা কেন ? কয়দিন ধরে গোসল
করিস না ? আর এই লম্বা চুল
কাটিস না কেন ? ঘোড়ার লেজের মত
এই চুল কি তর মনে ফ্যাশন ?
আজকেই চুল কাটবি , শেভ
করবি তারপর বাসায় গিয়ে গরম
পানি দিয়ে গোসল করবি ।
মানুষে আমাকে দেখলে কি বলবে ?
কি আর বলবে !
বলবে দেখো লাবণীর
বন্ধুর চুল ঘোড়ার লেজের মত ।
গোসল কয়দিন ধরে করেনা ,
গায়ে পাঁঠার গন্ধ ।
লাবণী ভার্সিটির পর এই ছাগলের
সাথে কিভাবে যে ঘুরে এক আল্লাহ
মালিক জানেন ।
লাবণীর রাগান্বিত মুখ
হাসিতে ভরে গেলো । বলল ,
মশকরা করিস আমার সঙ্গে ? মানুষ
এইসব কেন বলবে ।
তুই না একটু আগে আমাকে এইসব
বললি । তাহলে মানুষ কেন
বলতে পারবেনা ।
আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি বলেছি ।
আমার
দোস্তকে আমি যা ইচ্ছা তা বলব ।
ছাগল বলব না গরু বলব । মানুষ
একবার বলে দেখুক নাক
ফাটিয়ে ফেলব জ্যাকি চেনের
ঘুসি মেরে । কত্ত বড় সাহস
তরে এইসব বলবে , হু !
২.
লাবণী আর অরণ্য পার্কের গাছের
নিচ ধরে হাঁটাহাঁটি করছে ।
আস্তে আস্তে হাঁটা ।
যে হাঁটা কখনো না ফুরালেই
পথিকের
মনে শান্তি । দুজন দুজনার
হাতে হাত
ধরেও নেই আবার অনেক দূরেও নেই ।
গায়ে গা ঘেঁষার থেকে সামান্য দূর ।
কিরে ছাগল কিছু বল । বোবার মত
চুপ হয়ে আছিস কেনো ?
অরণ্য লাবণীর
দিকে তাকিয়ে বলল ,
তকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে ।
অনেক । মনে হচ্ছে আকাশের কোন
পরী ভুলে ভুলে পৃথিবীতে নেমে এসে
আমার মত ছাগলের
সাথে পার্কে হাঁটছে ।
অরণ্য লাবণীর
দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ ।
অপূর্ব এক সৃষ্টি । ঘন মেঘের মত
কালো চুল পিঠ
বেয়ে নিচে নেমে গেছে ।
কপালে একটা ছোট নীল টিপ । বড়
বড় , টানা টানা চোখ । লম্বা চোখের
পল্লব । ঠোঁটের
উপরে হালকা গোলাপি রঙের
একটা তিল । চোখে অনাবিল এক
সুখের মেলা । সারাদিন
তাকিয়ে থাকলেও তৃষ্ণা মিটবেনা ।
লাবণী একটু লজ্জা পেল । চোখ
নিচে নামিয়ে ফেলল । গালে লাল
আভা ছড়িয়ে গেলো । তারপর
অরণ্যর
পিঠে একটা আস্তে করে ঘুসি দিয়ে
বলল , সুন্দরী মেয়ে পেয়ে লাইন
মারিস নাকিরে ছাগল ?
অরণ্য লজ্জিত হয়ে বলল ,
না মানে সুন্দর লাগছে তো তাই
বললাম । প্রতিদিন তো আর
বলি না । আর তর সাথে লাইন
মেরে কি আমি মরবো নাকি ।
এমনিতেই যে মার মারিস , লাইন
মারলে যদি পটে যাস
তাহলে তো আমি জিন্দা লাশ
হয়ে থাকব ।
হয়েছে হয়েছে আর
ব্যাখ্যা করতে হবে না ।
বুঝি বুঝি সবই বুঝি ।
কি বুঝস ? কিছুই বুঝস না ।
লাবণী আবার লজ্জা পেল । টপিক
বদলানোর জন্য বলল ওই দেখ
গাছটা কত সুন্দর , চল
নিচে গিয়ে বসি ।
অরণ্য বলল , তারচেয়ে বরং বাসায়
যা । আজকে বৃষ্টি হবে ।
বৃষ্টি হবে কিভাবে জানলি ? আকাশ
তো পুরাই ফকফকা , গাধা ।
সবসময় বাহির দেখে ভিতর
বুঝা যায় না ।
আকাশের আবার ভিতর বাহির
কিরে ছাগল ?
আমি অন্যকিছুর কথা বলছিলাম ।
৩.
এক ঘণ্টা পর লাবণী উঠল বাসায়
যাবে বলে । ঠিক সেই মুহূর্তেই
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত
বিনা মেঘে বৃষ্টি । লাবণী অবাক
হয়ে অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল
তর কথা তো ঠিক হয়েছেরে , ঠিকই
বৃষ্টি পড়ছে ।
অরণ্য
একটা হাসি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে বল
গাছের নিচ থেকে বেড়িয়ে গেলো ।
প্রায় ২ মিনিটের মত আকাশের
দিকে চেয়ে থাকল । আর পুরো শরীর
ভিজে চলল । তারপর লাবণীর
দিকে তাকাল । লাবণী অবাক
হয়ে ওর কাণ্ড দেখছে ।
তর কি জ্বর বাঁধানোর ইচ্ছা ?
পরে ডাক্তার কে দেখাবে ?
এক্ষনি গাছের নিচে আয় ।
বৃষ্টিতে ভিজছিস কোন দুঃখে ?
ছাগল কোথাকার ।
অরণ্য ওর কথা কানে নিলোনা ।
ভিজতে থাকল ।
লাবণী গাছের নিচ
থেকে বেড়িয়ে এসে অরণ্যর হাত
ধরে গাছের নিচে নিয়ে এলো ।
তারপর
বলল , এই ছাগলের ছাগল একবার
বলছি ভিজবিনা শুনিস নাই ?
একটা থাপ্পড় দিব আর তর বৃষ্টি-
বিলাস সারা জীবনের জন্য শেষ
হয়ে যাবে । এই লম্বা চুলে বৃষ্টির
পানি জমে থাকলে কি অবস্থা হবে
জানিস ? ১০০
ডিগ্রী জ্বরে দিনরাত
ঘরে কাপতে থাকবি । তখন
আমি কার সাথে ঘুরব ? আমার কোন
খেয়াল আছে ? বলে লাবণীর ওড়নার
মাথা দিয়ে অরণ্যর চুল
মুছে দিতে লাগল ।
অরণ্য সবকিছু ভুলে ওড়নার ঘ্রাণ
নিতে লাগল । এত সুন্দর গন্ধ
কোথাও নেই , কোথাও ।
ওড়না দিয়ে মাথা মুছার সময়
লাবণীর নিঃশ্বাস অরণ্যর
মুখে পড়তে লাগল । এত
কাছে লাবণীকে অরণ্য
কখনো পায়নি । অরণ্যর ইচ্ছা করল
লাবণীর হাত ধরে বলতে , আমায়
ছেড়ে কোথাও যাসনে । এই ওড়নার
ঘ্রাণ আমি সারা জীবন পেতে চাই ।
তর এই গরম নিঃশ্বাস যা আমার
হৃদয় ঠাণ্ডা করে দেয়
তা আমি সারাজীবন পেতে চাই ।
ঠিক তখনই লাবণী ওর কাছ
থেকে দূরে সরে গেলো । বিব্রত
পরিস্থিতির
মাঝে পড়ে গেলো লাবণী । অরণ্য
লাবণীর চোখের দিকে অপলক
চেয়ে আছে । লাবণী চোখ
নিচে নামিয়ে ফেলল । নিঃশ্বাস
অতি দ্রুত থেকে দ্রুততর
হতে থাকল এবং গভীর
থেকে গভীরতম । দুজনই নীরব ,
চারদিক নীরব , শুধু বৃষ্টির শব্দ ।
কেউ বলেছিলেন , “ Silence is golden
“ . অরণ্যর
কাছে মনে হচ্ছে কথাটা ভুল ।
বলা উচিত ছিল , “ Silence is
diamond “ . হীরার থেকেও
দামি কিছু থাকতে পারে । এই
মুহূর্তে অরণ্যর তা মনে পরছে না ।
একটা কথাই মনে হল তার , সে এখন
দুনিয়ার সবচে রূপবতী যুবতীর
একদম কাছে তার চোখে চোখ
রেখে দাঁড়িয়ে আছে ।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি কমে গেলো ।
লাবণী নীরবতা ভেঙ্গে বলল অরণ্য
আমি যাই ।
একটা রিক্সা ডেকে দে আর তুই
আজকে হেঁটে যা । স্বাস্থ্যের জন্য
ভাল ।
অরণ্য বলল ,
লাবণী আমি তকে কিছু বলতে চাই ।
লাবণী বলল কি ?
আজ না , কাল বলব । আজকে বাসায়
যা । অনেক দেরি হয়েছে ।
আচ্ছা ।
৪.
পরদিন অরণ্য আবার ভার্সিটির
সামনে দাঁড়িয়ে আছে । লাবণীর
ছুটি হয়েছে প্রায় ১ ঘণ্টার মত
হয়েছে । লাবণী আসেনি । কাল
বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর করল
নাকি অরণ্যর চিন্তা হতে লাগল ।
লাবণীর বাসায় যাওয়া উচিত । এই
সুযোগে আঙ্কেল আন্টিকেও
দেখা হয়ে যাবে ।
অরণ্য কলিং বেল টিপার পর
লাবণীর মা দরজা খুলে দিলেন ।
অরণ্য লাবণীর কথা জিজ্ঞেস
করতেই বললেন , লাবণী জানত
তুমি আজকে আসবে । তোমার
জন্যই
অপেক্ষা করছে । আমি বলেছিলাম
তোমাকে কল দিতে , বলল তোমার
মোবাইল বন্ধ । যাও বাবা ,
ছাদে লাবণী বসে আছে ।
অরণ্য
ছাদে যেতে যেতে চিন্তা করতে লাগল ,
লাবণী কি জন্যে ভার্সিটি যায়নি আ
ওর জন্যই বা কেন অপেক্ষা করছে ।
অরণ্য ছাদে যেতেই লাবণী চিৎকার
দিয়ে বলে উঠল দোস্ত !
মিষ্টি খাবি নাকি আগে বল ?
অনেক
বড় সুখবর আছে ।
অরণ্য বলল কি ?
তুই না কাল
আমাকে কি বলতে চাইছিলি ?
আজকে বল ।
অরণ্য বলল তরটাই আগে শুনি ।
লাবণী বলল আচ্ছা শুন । আমার
বিয়ে ঠিক হয়েছে । পাত্র বিলেত
প্রবাসী । বাপের প্রচুর
টাকা পয়সা ।
তা বাদ দে । তার উপর পাত্র
দেখতে মারাত্মক হ্যান্ড-সাম ।
আমার বড় আপ্পি যে লন্ডন
থাকে সে বলেছে ,
দেখতে নাকি শাহীদ কাপুরের মত ।
শাহীদ কাপুররে চিনস তো ? ওই
যে হিন্দি ছিনেমার সুইট হিরোটা ।
অরণ্য
আগে নিজেকে সামলে নিলো ।
তারপর আস্তে করে বলল ,
হ্যাঁ চিনি ।
লাবণী বলল , ছেলে লন্ডনের
বিখ্যাত ডাক্তারদের মধ্যে একজন
।
ওর একটা দামি ফেরারি আছে ।
বিয়ের পর আমি ওই
ফেরারিতে ঘুরব
।
অরণ্য বলল , ও আচ্ছা । খুব ভাল
পাত্র তো দেখা যায় । অনেক
সুখে থাকবি ।
সুখে কিরে গাধা ! মহাসুখে থাকব ।
পাত্র নাকি অনেক রোমান্টিক
টাইপের । আর শুন আমার বিয়ের
সবকিছু কিন্তু তুই করবি । আমার
গায়ে হলুদের স্টেজ , বিয়ের শাড়ি ,
বাসর সজ্জা ……
লাবণী বলতেই থাকল । অরণ্য কিছু
শুনতে পাচ্ছে না । অরণ্য শুধু বলল ,
“
হ্যা থাকব , অবশ্যই থাকব ”
লাবণী বলল , “ আচ্ছা এখন বল
কি বলতে চাইছিলি ? আমিই
তো এতক্ষণ বকবক করলাম । আর
তর মন খারাপ দেখা যাচ্ছে কেন ? ”
অরণ্য বলল , “ কই কিছু নাতো । ”
লাবণী বলল , “ আচ্ছা বল না ,
কি বলবি । “
অরণ্য লাবণীর চোখের
দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলো ।
ইচ্ছে করল বড় বড় ওই চোখ
দুটিতে ডুবে যেতে ।
কখনো যাতে আর
ভাসতে না হয় । কিন্তু এই চোখ
দুটিতে ডুবার অধিকার এখন
আরেকজনের । ইচ্ছা করলেও
ডুবতে পারবেনা । অরণ্য যা বলত
চাইছিল তা এখন আর
বলতে পারবেনা , বলা ঠিকও হবেনা ।
কি বলবে তাই ভাবছে । শেষে বলল ,
“
দেখ আমি আজকে শেভ করেছি ।
চুলও কেটেছি । তারপর গরম
পানি দিয়ে গোসল
করে দামি পারফিউম লাগিয়েছি ।
আজকে তর ছাগল উন্নতমানের
ছাগল হয়েছে ” ।
বলে অরণ্য
নিজেকে সামলে নিচে নেমে এলো ।
লাবনী অরণ্যকে ডাকল অনেকবার ।
অরণ্য আর ফিরে তাকালনা ।
৫.
অরণ্য আজকে আবার
পার্কে গেলো ।
আজ ও একা । অনেক একা । কালকের
সেই গাছের নিচে বসল । কিছুক্ষণ
পর আজকেও বৃষ্টি নামল । অরণ্য
গাছের নিচ থেকে বের
হয়ে বাইরে গেলো । উপরের
দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল
। আজকে ওকে কেউ থামাবেনা । কেউ
বলবেনা , “জ্বর উঠলে পর আমার
সাথে কে ঘুরবে , আমার খেয়াল কিছু
আছে ?” আজ ও যত
খুশি বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে ।
ভিজার পর কেউ ওর চুল পরম
ভালবাসায় ওড়না দিয়েও
মুছে দিবেনা । আজ অরণ্য দু চোখ
ভাসিয়ে কাঁদলেও কেউ ওর চোখের
জল মুছে দিবেনা । দূরে কোথাও গান
বাজছে ,
“ যদি ডেকে বলি , এসো হাত ধরো
চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে ।
এসো গান করি , মেঘমল্লারে ,
করুণা-ধারা দৃষ্টিতে ।
আসবেনা তুমি ,
জানি আমি জানি …