১
বাসায় ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পেলাম আব্বা আমার নিতু আপুদের বাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন ।
২
সব ছেলেদের জীবনেই সম্ভবত একজন আপু থাকেন । কেউ একজন থাকেন যাকে দেখে একটা দীর্ঘ সময় অবুঝ অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকে সে । আমার সেই আপুটি ছিলেন নিতু আপু । তখন খুব বেশি বয়স ছিলো না আমার । রোদ এলেই শিশির শুকিয়ে যাবে জেনেও বুকের গহীনে তাকে লুকানোর ঘাসের আপ্রান চেষ্টা দেখে ব্যাথা পেতে শিখেছি আমি । খুব বিকেলে যখন শেষবারের মতো আবীর মেখে নেয় নির্জন গোধূলি তখন অপার্থিব হাহাকারে চোখ ভেজাতে শুরু করেছি আমার । হঠাৎ ঠোঁটের নীচে জেগে ওঠা গোঁফের সরু রেখা আর ভেঙ্গে যাওয়া কণ্ঠস্বর লুকাতে গুটিয়ে নিচ্ছি শামুকের মতো । আমার প্রিয়তম কৈশোর সুতো কেটে উড়ে যাওয়া ঘুড়ির মতো উদ্দাম হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে খুব গোপনে । আমার তখন উটভট এক কল্পরাজ্য ছিলো , ছিলো কাঁটায় কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত হওয়ার স্বাধীনতা আর নিতু আপু । আচ্ছা, নিতু আপুকে আমি নিতু আপুই বলবো নাকি আমার কল্পরাজ্জ্যের যে ডাকনাম ছিলো সেই নাম ?? না থাক, সেই নাম থাক । বরং সুত্র দেই, আপু ছিলেন আমার কাছে এক তীব্র দীঘি । যে দীঘিতে আমার সাঁতরাবার অধিকার নেই বলে মাছরাংগার মতো উড়ে বেড়াই তাকে ঘিরে । আপু কি বুঝতে পারতেন?? আমি জানি না । আপু ছিলেন ছোট বেলার সেই পাজলের মতো যার সবকটা ঘর কখনই একসাথে মিলে না । অথচ কি দুর্বোধ্য আকর্ষণ ছিলো তার প্রতি । যতক্ষণ পাশে থাকতাম কি যে হাহাকার লাগতো । কেবলই মনে হতো কি জানি নেই কি জানি নেই । যখন দূরে থাকতাম তখন তার কাছেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করতো সবকিছু রেখে । কেটে ছিঁড়ে একাকার হতে ইচ্ছে করতো , ইচ্ছে করতো ঘড়ির কাঁটার মতো হারিয়ে যাই সময়ের অতলান্তে, ইচ্ছে করতো মরে যাই । নিতু আপু কি সব জানতেন?? তিনি আমাকে ডেকে বলতেন, এই ছেলে আমাকে কেমন লাগেরে তোর?? বিয়ে করবি আমাকে?? আমি লজ্জায় মাথা নিচু করতাম । আপু বলতো, ইশ আমার লাজুক জামাইরে ! তুই কবে বড় হবি বলতো ! মাঝে মাঝে হুট করে পাশে দাঁড় করিয়ে বলতেন, ইশ তুই বড় হতে হতে আমি বুড়ি হয়ে যাবো ! তখন কি আর আমাকে ভালো লাগবে রে তোর । অথবা কোনও দিন আইসক্রিম পার্লারে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে চট করে আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতেন, বলতেন, মাঝে মাঝে হবু বউকে না খাওয়ালে সে তো অন্যের সাথে ভেগে যাবে রে । কখনও কলেজে ডাকতেন । তারপর হেঁটে হেঁটে বহুদূর, অচেনা কোনও পথে । শব্দহীন সেসব দীর্ঘ পথচলায় অশান্ত হতো চোরা অনুভুতিরা । নীতিহীন কল্পনায় ডুব দিয়ে তুলে আনতাম বিষণ্ণতার নিনাদ । একসময় ক্লান্ত কণ্ঠে আপু বলতেন, চল ফিরে যাই । আমি কিচ্ছু বলতাম না, কিছু বলার সাহসই বা কই পাই?? আমার কথা জানতো কেবল আমার বাঁধাই করা নোট খাতা । আমার কথা জানতো লুকিয়ে রাখা কবিতার একেকটি শব্দ । ঘুম না আসা রাতগুলো কেবলই দীর্ঘ হতো , অনুভুতির অংকগুলো জটিল হতো আরও । তবে আমার জটিলতা যেমন কেউ জানতো না, আপুর জটিলতাও আমি জানতাম না । কোনও কোনও দিন ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে আপু বলতেন, আমি এখন কাঁদবো তুই আমার পাশে চুপচাপ বসে থাকবি । আমি দেখতাম আপু কাঁদছে । তার চিবুক, তার একেলা ছায়া, কিছু শিরোনামহীন শব্দ আর সারা জীবন পাঁজরে বেঁধে থাকা মুহূর্ত । আমি ভাবতাম, এর সাথে যদি জুড়ে যেতো আমার নিয়তি । ভেবে ভেবে ব্যাথা পেতাম। কাঁদা শেষ হলে নিতু আপু বলতো, একটা গান শুনা তো, প্রেমের গান । আমি গান ধরতাম আর আপু খিলখিল করে হাসতো । বলতো , যদি কোনোদিন প্রেম করিস তাহলে ভুলেও প্রেমিকাকে গান শুনাবি না , সাথে সাথে ভেগে যাবে ।
৩
আমাদের পাড়ায় নিতু আপুর একজন নীরব প্রেমিক ছিলো , নয়ন ভাইয়া । গোল গোল চোখ , নিতু আপু ছিলো তারও ধ্যান জ্ঞান । পাড়ার ভালো ছেলেরা সাধারণত তাদের ভালো লাগার কথা মেয়েদের বলতে পারে না । নয়ন ভাই পাড়ার ভালো ছেলে, তিনিও বলতে পারতেন না । তাই শেষমেশ আমাকে বেছে নিলেন ডাকপিয়ন হিসেবে । খুব রাগ হলো আমার , বুকের ভিতরটা পুড়ে গেলো ভয়ে, যদি নয়ন ভাইকে নিতু আপু পছন্দ করে ফেলে । হলো উল্টো, চিঠি পড়ে তো আপু হেসেই কুটিকুটি , আমিও টাকশাল থেকে বের হওয়া পাঁচ পয়সার মুদ্রার মতো ঝকঝকে হয়ে উঠলাম । প্রতিবার নয়ন ভাই এর চিঠি নিয়ে যাই দুরুদুরু বুকে, এইবার বুঝি নিতু আপু তাকে পছন্দ করে ফেললো , প্রতিবার ফিরে আসি সুখী হয়ে । নিতু আপু যেনও নয়ন ভাইয়াকে পছন্দ না করেন সে জন্য মাঝে মাঝে তার নামে উল্টা পাল্টা বলি । আপু চোখ বড় বড় করে বলেন, যাহ্ তুই বানিয়ে বলছিস তাই না?? আমার হতচকিত চেহারা দেখে আপু রহস্যময় হাসি দিতেন । আমি মাথা নিচু করতাম । তিনি আমার থুতনি ধরে বলতেন, চিন্তা করিস না, আমি তো তোরই আছি ! আচ্ছা, আমি আপুর কাছে কি ছিলাম?? খেলার পুতুল?? এমন কেউ যাকে ইচ্ছেপূরণের খেলায় ইচ্ছে মতো ভাঙ্গাচড়া যায় ?? নাকি এমন কেউ যাকে ইচ্ছেপূরণের কাটাকুটি খেলায় মেলানো যায়না কোনোকিছুর সাথেই?? আজ এতোদিন পর মনে হয়, আসলে মানুষের জীবনে কেউ কেউ এমন থাকে যাকে দুই এর সাথে দুই মিলিয়ে সরলীকরণ করা যায় না । কোনও কোনও সম্পর্ক এমন হয় যেখানে দুই এর সাথে দুই মেলালে হয় চারের চেয়ে কিছু কম, অথবা বেশি । এই কম বেশির দুর্বোধ্যতা নিয়ে কেটে যায় দুইজনের সারাটি জীবন । অথচ তখন আমারও ইচ্ছে করতো নিতু আপুকে কার্নিশে টাঙ্গানো রোদের গল্প বলতে । বলতে ইচ্ছে করতো , শেষ বিকেলের নিঃসঙ্গতার কথা । বলা হয়নি । শেষমেশ মধ্যরাতের বানানো রুপকথাগুলো মরে যায় ভোরবেলার বৃথা চাঁদের আবয়বে । এই পৃথিবী বৃষ্টি শেষে ভেজা দাঁড়কাকের ব্যাথা বোঝে কিন্তু এক কিশোরের চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাকুলতা বোঝে না ।
৪
বোঝেনি আমার সমবয়সীরাও । তারা ভেবেছিলো নিতু আপুর নগ্ন শরীর আমাকে আনন্দ দিবে । মাত্র দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ডের ভিডিও ছিলো ওটা । বিছানায় দেবীর মতো পড়ে থাকা নিতু আপু । তাতে উপগত একজন পুরুষ , অচেনা , হয়তো তার আসল প্রেমিক যার কথা জানা হয়নি আমার কোনোদিন । অনুভুতিশূন্য আমি তাকিয়েছিলাম, নিতু আপুর মুক্তো দানার মতো শরীর, এই আপুকে আমি চিনিনা। আপুর প্রেমিকের উত্থিত শিশ্ন, তীব্র শীৎকার আমার শরীরের প্রতিটি কোষ খুঁজে খুঁজে আঁচড়ে দিচ্ছিলো । নিতু আপুর পরিতৃপ্ত চোখমুখের নীচে গড়িয়ে যাচ্ছে আমার অপরিনত অনুভুতিগুচ্ছ । ওরা আপুর প্রতিটা অংশ নিয়ে মন্তব্য ছুঁড়েছিলো, ওরা আমাকে আনন্দ দিতে চেয়েছিলো । আর ওদের কথাতেই অনুভুতি ফিরে পেয়েছিলাম আমি , আছাড় দিয়ে ভেঙ্গেছিলাম মোবাইলটা । ওরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো । সৎবিৎ ফিরে পেতেই ইচ্ছেমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আমার উপরে । এক কলঙ্কিত নারীর পিছে দাঁড়িয়েছিলাম আমি । ওরা আমাকে ক্ষমা করবে কেনও । একটু আগে আমাকে আনন্দ দিতে চাওয়া ওরাই আমাকে রক্তাক্ত করে পেতে চায় বঞ্চনার শোধ । আমি বাঁধা দেইনি । কারন আমাকে পিটিয়ে রাস্তায় শুইয়ে দেওয়া বা আমাকে “নিতু আপুর ব্যর্থ প্রেমিক” বলে উপহাস কোনওটাই কষ্ট দেয়নি । অথচ আমার মনে হচ্ছিলো কেউ একজন আমাকে টেনে টেনে ছিঁড়ছে, আমার আত্মাটাকে নির্মম হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে নিঃসীমে । আহ ! এতো কষ্ট ! এতো কষ্ট সহ্য করেও মানুষ বেঁচে থাকে ! কেনও??
৫
-আমার শরীরটা পছন্দ হয়েছে তোর??
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি । শেষ সন্ধ্যার তারার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশের চওড়া জমিনে । তবুও যেনও অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসে । আমি আপুকে দেখতে পাই না । আপু আবার জিজ্ঞেস করে, তুই আমাকে বিয়ে করবি তো?? নাকি অন্যপুরুষকে শরীর দিয়েছি বলে এখন আমাকে ঘৃণা করবি??
আমি চোখে কান্নার ছায়া পড়ে । আপু অন্ধকারে দেখতে পায় না । নীরবতা অসহ্য লাগে । আপু আবার বলে, জানি পারবি না আর আমাকে ভালোবাসতে । চেনা আছে তোদের । এর চেয়ে নয়ন ঢের ভালো । নয়ন কি বলেছে জানিস??
আমি তাকাই আপুর দিকে । “ নয়ন বলেছে, সে আমাকে নিয়ে বহুদূর চলে যাবে । যেখানে আমার কলঙ্কের ছায়া থাকবেনা । আমাকে কেউ চিনবে না । আবার নতুন করে শুরু করবো আমরা” । এই প্রথম নয়ন ভাইকে হিংসা হলোনা আমার । এই প্রথম নয়ন ভাইকে আমার একটুও হিংসে হলো না । মনে হলো, এটাই হওয়া উচিৎ । মনে হলো, আপু তুমি চলে যাও যতদূর তোমার স্মৃতিও তোমার কাছে পৌঁছাবে না । নিতু আপু হাহাহাহাহা করে হাসতে থাকে । বলে, যার আর কিছুই দেওয়ার নেই সে কি নিয়ে হারিয়ে যাবে বলতে পারিস । যা কিছু ছাই হয়ে গেছে, হীরে দিয়ে সাজালেও তা কি আর ফিরবে ?? আপুর হাসি থামে না । আমি রাস্তায় নেমে আসি । এরপরে বহুদিন কেটে গেছে । মানুষের নিষ্ঠুরতা বারবার নিঃস্ব করেছে আমাকে, বারবার মিশিয়ে দিয়েছে ধুলোয়, অনুভব করিয়েছে আমার অতল শূন্যতা । কিন্তু সেদিন যে অনিঃশেষ অনুভবহীনতা অনুভব করেছিলাম তা হয়তো সমস্ত জীবনে মানুষ একবারই অনুভব করে । একসময় বাসায় ফিরলাম । কিছুক্ষণ পর জানলাম পাড়ার লোকজন নিতু আপুদের সাথে সম্পর্ক গুটিয়ে নিচ্ছে । আমরাও । আব্বা আমাকে ডেকে বললেন আমি যেনও নিতু আপুদের বাসার আশেপাশে পা না রাখি । আমি মেনে নিলাম।
৬
আব্বা কোনোদিনও জানতে পারেননি নিতু আপু যে ঘুমের ওষুধগুলো খেয়ে আত্মহত্যা করেন সেসব আমিই তাকে যোগাড় করে দিয়েছিলাম ।
( উৎসর্গ প্রিয় গল্পকার হাসান মাহবুব ভাইকে । গল্প শুনতে বারবার আমি আপনার কাছেই যেতে চাই । )
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ রাত ১১:২১