আকাশ দস্যুতা
নীলিমা স্কাই বিল্ডারস এর প্রধান আজিজ সাহেব মুখ বেজার করে বসে আছেন । মুখ বেজার করে থাকার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি । তিনি এক মাস আগে একটি নির্দেশ দিয়েছেন অথচ এখনও সেটা পালন হয়নি । তিনি জিএম আদনানকে ডাক দিলেন । এই আদনান আর তিনি মিলেই গড়ে তুলেছেন নীলিমা স্কাই বিল্ডারস । মূল আইডিয়া অবশ্য আদনানেরই ছিল , কিন্তু টাকা ছিলো না । সে তার আইডিয়া নিয়ে নানা জায়গায় গেছে , সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে । অবশ্য না দেওয়ারও কিছু ছিলো না । কেউ যদি বলে, মানুষের বসবাসের জন্য গ্যাসবেলুনের ব্যাবস্থা করলে কেমন হয় তাহলে যে কেউই তাই করবে ! তার আইডিয়া ছিলো, মানুষ যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে কিছুদিন পর মানুষের থাকার জন্য আর জায়গা থাকবে না । সব জমি চলে যাবে ভুমিদস্যুদের দখলে , কিন্তু তাদের বানানো ফ্লাটও একসময় সোনার হরিন হয়ে যাবে মানুষের কাছে । তখন হন্ন্যে হয়ে মানুষ জায়গা খুঁজবে বসবাসের , কিন্তু পাবেনা , সেই সময়ের জন্য যদি আমরা আকাশটা দখল করে নেই তাহলে কেমন হয়?? একেকটা বিল্ডিঙের ছাদে যতগুলো সম্ভব গ্যাসবেলুন । সেই গ্যাসবেলুনে থাকবে অন্তত তিন জন মানুষ থাকার ব্যাবস্থা । সারাদিন আকাশে এক জায়গায় স্থির থাকবে বেলুন । ঝড় বৃষ্টি বা শীতে ফলস সিলিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে । বিল্ডিঙের ছাদে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হবে বেলুনবাড়িগুলো । ছাদ থেকে ওঠা নামার জন্য ব্যাবহার করা হবে দড়ির মই । আর প্রতিমাসে হওয়া ভাড়া দিতে হবে । আর বেলুনগুলোর ঠিকানা হবে , বিল্ডিঙের নাম্বার অনুসারে , যেমন , ১২/৩ বিল্ডিং ৪ নাম্বার বেলুন ! আজিজ সাহেব বুঝতে পারেন ভবিষ্যতে এটাই হতে যাচ্ছে । তাই তিনি আর দেরি না করে এই খাতেই বিনিয়োগ শুরু করলেন । প্রথমে অনেকেই পাগলামি ভেবেছিলো । কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা গেলো সত্যিই ফ্ল্যাট সব সোনার হরিন হয়ে গেছে মধ্যবিত্তদের কাছে । তখন তারা বেলুনবাড়ির পেছনেই ছুটছে । সময় লাগলেও আজিজ সাহেবের ব্যাংক ব্যাল্যান্স ফুলে ফেপে উঠলো । কিন্তু বেড়ে গেলো প্রতিদ্বন্দ্বী । এখানেও জমি দখলের মতো করে সবাই আকাশ দখলের লড়ায়ে নেমে গেলো । কিছুদিনের মধ্যেই আকাশে আর নীল দেখা যায় না । তাকালেই শুধু নানা ডিজাইনের বেলুন । নীল নয় রঙ্গিন আকাশ দেখে অভ্যস্ত হতে শুরু করলো মানুষ । সুযোগ বুঝে ছাদওলারা বেশি ভাড়া দাবি শুরু করলো, সরকার ধার্য আকাশসীমার ট্যাক্স । আর উপদ্রপের মতো পিছনে লেগে থাকলো সমাজের কবি সাহিত্যিক নামের কীটগুলো । আকাশ দেখতে না পেয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতা নাকি থেমে যাচ্ছে, বাচ্চাদের নাকি মানসিক গঠন সুস্থ হচ্ছে না । আজ তারা মানববন্ধন করে কাল কবিতা লিখে । তারা আজিজ সাহেবের নাম দিয়েছে আকাশদস্যুদের সর্দার । তাতে আজিজ সাহেবের থোড়াই কেয়ার । পারলে তোরা মানুষের বাসস্থান করে দে , তা তো পারবি না । আজও তারা কি এক কর্মসূচী ডেকেছে । কিন্তু তিনি সেসব নিয়ে চিন্তিত না, তিনি চিন্তিত একটা বাড়ির ছাদ কিছুতেই দখল করতে পারছেন না বলে । সেখানে একটা ছাদে একবেলুনে একজনই থাকে, কিন্তু সেই পুরোটা ছাদ দখল নিয়ে থাকে । তাকে উৎখাত করতে পারলেই তিনি নতুন প্রকল্প শুরু করতে পারেন কিন্তু গত একমাস ধরে সে নির্দেশ দিয়েও সে কাজ হয়নি । তিনি আবারও আদনান সাহেবকে ডাক দিলেন ।
পূর্বকথা ঃ আমি এবং সেই মাতাল রাতের মেয়েটি
যারা একাকী বড় হয় তাদের নানারকম মানসিক সমস্যা নিয়ে বড় হয় । বেশিরভাগই সাধারণ সমস্যা । আমার ছোটবেলায়, প্রায় বন্দী অবস্থায় বড় হওয়ার কারনে নানারকম মানসিক সমস্যা আমারও আছে । এর মাঝে সাধারণ একটা সমস্যা হচ্ছে, আমি মাঝে মাঝে একসাথে দুইটি দৃশ্য দেখি । একটা বাস্তব, একটা হেলুসিনেশন । কঠিন লাগছে?? বুঝিয়ে বলি, ধরা যাক, আমার সামনে দুইজন লোক বসে আছে । একজন লোক হঠাৎ আরেকজন লোকের পিঠে আদর করে চাপড় দিলো । আমি সেই দৃশ্য দেখবো , সাথে সাথে আমার মস্তিস্ক আরেকটি দৃশ্য তৈরি করবে যেখানে আমি দেখবো, লোকটা আসলে তার পিঠে ছুরি বসাচ্ছে । ঠিক জানি না, হয়তো দুটি দৃশ্যর মাঝে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পার্থক্য থাকে বলে আমি বুঝতে পারি কোনটা আসল আর কোনটা হেলুসিনেশন । মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়, যদি কখনও এই সেকেন্ডের পার্থক্য ঘুচে যায় ? আমি যদি আর দুইটা দৃশ্য আলাদা করতে না পারি ??
এই মুহূর্তেও আমার মধ্যে সেই ভয়টা কাজ করছে । এই মুহূর্তে আমার সামনে যে মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখছি তাকে আমার বিভ্রম মনে হওয়ার কারণ নেই , অথচ হচ্ছে । যেদিন তাকে প্রথম দেখি তাকে কিন্তু বিভ্রম মনে হয়নি । অদ্ভুত হলো তখনই বিভ্রম হওয়ার সুযোগ ছিলো বেশি । ঝমঝমে বৃষ্টির রাত, যাত্রী ছাউনিতে মেয়েটা একা বসে ছিল । আশেপাশে শেষ জনমনুষ্য বলতে আমি । সেও পুরোপুরি সুস্থ না । সদ্যবিবাহিত সহকর্মীর লক্ষ্মী সুন্দরী বউটি দেখে ঈর্ষান্বিত আমার বহুবছরের অবদমিত নিঃসঙ্গতা জেগে উঠেছিলো তীব্র ব্যাথা নিয়ে । সেই ব্যাথা কমাতেই পেটে কিছু তরল চালিয়েছিলাম । অনভ্যস্ত পাকস্থলী বোধহয় তা সহ্য করতে পারছিলো না । পেট বাঁকিয়ে ভাঙ্গাচোরা ভঙ্গিতে বসে বসে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম মেয়েটির দিকে । মেয়েটি কিন্তু সরাসরিই তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে । কোনও দ্বিধা কোনও জড়তা নেই । ঠিক এখন যেভাবে তাকিয়ে আছে ।
“ কিছু বলবেন না বুঝি ??” মেয়েটার কোথায় সৎবিত ফিরে আমার । আমি মৃদু হাসলাম । মেয়েটি বলল, সেই রাতের কথা ভাবছেন তো ?? আমি আবার বিভ্রান্ত হই । এই মেয়েটি কি আমার মনের কল্পনা নয় ?? নাহলে আমার মনের কথা টের পাচ্ছে কিভাবে ?? আমি অস্বস্তিবোধ করি । মেয়েটা আবার বলে ওঠে, অস্বস্তিবোধ করার কিছু নেই । আপনি সহজ হন । আমি সহজ হওয়ার চেষ্টা করি । যেমন সে রাতে করেছিলাম । তার দিকে হাসি দিয়ে । তবে হাসিতে মনে হয় আমার অসুস্থতাই ফুটেছিল বেশি । মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলো, আপনার কি বমি পাচ্ছে ?? আমি তাকালাম তার দিকে সরাসরি । আমার ঝাপসা চোখে তাকে মনে হচ্ছিলো সে আমার বন্ধুর বউটি কিংবা আরও পরিচিত কেউ । দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম আজ আবার দেখা হয়েছে হঠাৎ । আমার বুকে আবার বেজে উঠেছিলো কনকনে নিঃসঙ্গতার কষ্ট । এই ভাবনাটি কিও ধরতে পারলো মেয়েটি ?? জিজ্ঞেস করলো, আপনার মা বাবা থাকেন না আপনার সাথে ?? আমি বললাম, না । অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন তারা ।
- ওহ অ্যাই আম সরি ।
- নো ইটস ওকে
- তারপর আপনি কার কাছে বড় হলেন ??
- এতিম খানায় ।
- ওহ
মেয়েটার চোখে বিষাদ ফুটে উঠলো । আসলেই কি ফুটে উঠলো নাকি সেটা আমার কল্পনা । মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করলো , আপনার শরীর এখন কেমন ?? আমি কিছু না বলে হাসলাম । সুস্থ হাসি । মেয়েটা আবার বলল, “প্রথম পরিচয়েই কোনও মেয়ের সামনে বমি করে দেওয়া কোনও কাজের কথা না”। আমি লজ্জা পেলাম । কিন্তু থামলো না। একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “তাও আবার মাতাল হয়ে !” আমি জানি, আসলেই কাজের কথা না । তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বমিটা আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম আমি । কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । শরীর গুলিয়ে আসছিলো , মনে হচ্ছিলো পেটের ভিতরে যা কিছু আছে, কিডনি লিভার সব যেনও টেনে হিঁচড়ে বেরিয়ে আসতে চায় । মৃত্যু কি খুব কাছে চলে এলো আমার ?? একসময় অনুভব হলো মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । কোমল স্পর্শ পেলাম আমার কাঁধ আর মাথায় । নরম সুরে মেয়েটা বলেছিল, মাথাটা আরেকটু নীচে করুন । আমার মনে হয়েছিলো, এই যাত্রায় হয়তো মারা যাবো না ।
- দেখুন আপনাকে অস্বস্তি ফেলার জন্য আমি কথাগুলো বলছি না । মজা করার জন্য বলছি । আবার বাস্তবে ফিরে আসি আমি । বললাম, বুঝতে পেরেছি । হাসলাম । মেয়েটার মুখে আবার দুষ্ট হাসি ফিরে আসলো , বলল, “সেদিন আপনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন মনে আছে ??” আমি জানতাম, এই প্রসঙ্গ আসবেই । বমি হওয়ার সময় যখন মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল পর কেউ আমাকে এতো কোমলভাবে স্পর্শ করছে । আমার আজন্ম তৃষ্ণার্ত হৃদয় গুমরে উঠেছিলো । মনে হচ্ছিলো, এই হাত এই স্পর্শ যেনও অনন্তকাল থাকে । তখন মেয়েটিকে আর অচেনা কেউ মনে হচ্ছিলো না । বোধহয় এমন একটা মুহূর্তের জন্যই মানুষ অপেক্ষা করে সারাটি জীবন । কেউ পায় কেউ পায় না । আমি সেই ঘোরের ভিতরেই বলে বসলাম, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই । জানি এটা খুব একটা আদর্শ মুহূর্ত নয় এমন প্রস্তাব দেওয়ার কিন্তু এর চেয়ে খাদহীন অনুভূতিও আর কখনও আসবে না । মেয়েটি শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো । আজ সেসব মনে পড়ায় অজান্তেই হাসলাম আমি । আমাকে হাসতে দেখেই মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার বুঝি কোনও গার্লফ্রেন্ডও নেই ?? আমি বললাম, না । মেয়েটা সব জান্তার একটা ভাব নিয়ে বলল, আমিও তাই ধারণা করেছিলাম । গার্লফ্রেন্ড থাকলে বুঝতেন কখন একটা মেয়েকে প্রস্তাব দিতে হয় , কখন হয়না। আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম । তারপর বললাম, “ঠিক তা নয় । আমি আসলে ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি । একা একা মানে শুধু বাবা মাকে ছাড়া তা নয় , আমি যে এতিমখানায় থাকতাম সেখানের পরিবেশের সাথেও আমি মানিয়ে নিতে পারিনি । সবসময় চুপচাপ থাকতাম । কারও সাথে মেশার চেয়ে নিজের সাথে কথা বলতেই বেশি ভালো লাগতো আমার । তীব্র নিঃসঙ্গতাতে আমার অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা, হয়েছিলামও । বড় হয়ে স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটিতেও আমার তেমন বন্ধু ছিলো না আমার চুপচাপ স্বভাবের কারনে । অফিসেও নেই । কিন্তু শেষপর্যন্ত মানুষই তো । অভ্যস্ততার বাহিরেও অন্তরের অন্তঃস্থলে কি যেনও একটা থেকে যায় । ক্লান্তির শেষে একটু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা কিংবা কোনও তারা ঝরে যাওয়া রাতে কারও হাত ধরে আকাশ দেখা । আপনাকে দেখে হঠাৎ মনে হয়েছিলো, আপনি আমার বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কেউ যার জন্য আমি ঘুরে ঘুরে অবশেষে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি” । এইবার মেয়েটির চুপ থাকবার পালা । কিছুক্ষণ পর সে বলল, তারমানে সেদিনের কথাটা শুধুই ক্ষণিকের আবেগ কিংবা মাতালের প্রলাপ ছিলো না । আমি বললাম, না । মেয়েটি আর কিছু বলল না । খানিকপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা আমি যাই । আমি তখনও একটু আগের বলা কথাগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত । সারা জীবনের চুপচাপ আমি হঠাৎ এতো কথা বলে ফেললাম কিভাবে কে জানে ! তারচেয়েও বেশি অস্বস্তিকর, মেয়েটি কি ভাবলো , এরপরে কি ভাববে সে আমার সম্পর্কে ! আমার কি মেয়েটিকে থামানো উচিৎ?? আমি মনে হলো আমি যেনও পিচ্ছিল কেকের উপর দিয়ে হাঁটছি । মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছে তবুও আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি, যেমন আমি সারাটি জীবন চুপচাপ দেখেছি অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া । এর আগের দিন, বমি করার পর, মেয়েটা যখন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল তখন পরম নির্ভরতায় তার পাশে হেঁটেছি যেনও এর কোনও শেষ নেই । আজ তাকে হেঁটে চলে যেতে দেখে অদ্ভুত শুন্যতা গ্রাস করলো আমাকে যেন এরও কোনও শেষ নেই । এতক্ষণে আমার মনে হলো, মেয়েটার আমার অসুস্থ মনের কল্পনা নয়, আমার পাঁজর চেরা কষ্টের অংশ ।
কিন্তু সেই ভাবনা কাটতেও বেশি দিন দেরি হলো না আমার । মেয়েটা চলে যাওয়ার পর প্রতিটা দিন আমি অপেক্ষা করেছি সে আসবে । এইবার আসলে আর কোনও ভুল করবো না । ঠিক তার নাম জিজ্ঞাসা করবো । জিজ্ঞাসা করবো ঠিকানা । কিন্তু সে আর এলো না । এলোই না । হঠাৎ এক সকালে তার একটা চিরকুট এলো । একটা ঠিকানা দিয়ে লিখা, আজ এই জায়গাটায় চলে আসবেন বিকেল ৪ টায় । আপনার জন্য চমক আছে । ইতি , সেই মাতাল রাতের মেয়েটি । আমি গেলাম । অপেক্ষা করলাম । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা , সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত । কিন্তু তার দেখা পেলাম না । আবার ফিরে এলো সন্দেহ । আসলেই কি মেয়েটি ছিলো ?? নাকি কাল্পনিক সব চরিত্র তৈরি করে নিঃসঙ্গতা দূর করার আমার সেই পুরানো অসুখ ?? বাসায় এসে অনেক খুঁজেও চিরকুটটা পেলাম না । আমার সন্দেহ দৃঢ় হলো । হয়তো রাতের বেলা ঘুমের মাঝে নিজেই চিরকুটটি লিখেছিলাম কিংবা চিরকুটটাও আমার একটা কল্পনা ছিলো দীর্ঘদিন তাকে দেখতে না পেয়ে আমার হতাশ অবচেতন মন আমার জন্য এইভাবে গল্প সাজিয়েছিলো । প্রচণ্ড মন খারাপ হলো । অসংখ্য চোরা অশ্রুর সাক্ষী বোবা বালিশটাকেই একমাত্র সত্যি মনে হলো আমার ।
(আবার) আকাশ দস্যুদের অফিসে
আদনান সাহেব তার সামনে এসে দাঁড়াতেই আজিজ সাহেব বললেন, এই বাড়ির ছাদ এখনও দখল হয়নি কেনও ??
- স্যার ওই বেলুনবাড়িতে যিনি থাকেন তিনি ছাড়তে চাচ্ছেন না
- তাকে টাকা অফার করা হয়েছে ??
- জি । যত দাম তার বেশিই করা হয়েছে । কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন ।
- হুমকি দেওয়া হয়েছে ??
- জি তাও দেওয়া হয়েছে । কিন্তু লাভ হয়নি !
- আশ্চর্য ! কেনও ?? তার দাবি কি??
- তার কোনও দাবি নেই ।
- তাহলে কেনও ছাড়ছে না ??
- স্যার ভদ্রলোক একজন মেয়েকে পছন্দ করেন । কিন্তু মেয়েটার নাম ঠিকানা জানেন না । শুধু মেয়েটা তার ঠিকানা জানে । তার ভয় তিনি সেখান থেকে চলে গেলে আর কেউ কাউকে খুঁজে পাবেন না ।
- আজব !
- জি
- এই সময়েও কেউ ২০১৩ এর আবেগ নিয়ে চলে জানতাম না । মনে হচ্ছে, এটাও কবি সাহিত্যিকদের মতো কীট ।
আদনান সাহেব কিছু বললেন না । আজিজ সাহেব আবার বললেন, তার মতো আবেগ নিয়ে কাজ কারবার আমাদের নয় । আবেগ দিয়ে কিচ্ছু হবে না । আপনি আজকের রাতের মধ্যে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন ।
- জি স্যার
- কিছু বলার দরকার নেই। শুধু ছাদের হুকের দড়িটা কেটে দিবেন । যেদিকে খুশি উড়ে যাক । আমি কাল থেকেই ওখানে আমার প্রজেক্ট শুরু করতে চাই ।
অবশেষের দিন এবং রাত্রি
সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল ফোনের আওয়াজে । স্ক্রিনে দেখি অচেনা নাম্বার । আলস্য নিয়ে রিসিভ করলাম ।
- হ্যালো
- আমি সেই মাতাল রাতের মেয়ে বলছি ।
আমি চুপ হয়ে গেলাম । আমি ভেবেছিলাম আমি বিভ্রান্তি কেটে উঠেছি । কিন্তু সে আবার হাজির হয়েছে ।
- হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন ?? মেয়েটা বলল আবার ।
- জি বলুন
- আমি আজ আপনাকে বিয়ে করতে চাই । জানি এটা খুব একটা আদর্শ মুহূর্ত নয় এমন প্রস্তাব দেওয়ার কিন্তু এর চেয়ে খাদহীন অনুভূতিও আর কখনও আসবে না ।
- রসিকতা করছেন ??
- না । এর চেয়ে সিরিয়াস আমি কখনও ছিলাম না । হবোও না কখনও ।
- কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব ??
- কেনও সম্ভব নয়?? নাকি আপনি মন পরিবর্তন করেছেন ??
- না মন পরিবর্তন করিনি । একটা সমস্যা আছে ।
- কি সমস্যা ??
- আমার ধারণা আপনি আমার কল্পনা ।
- মানে ??
- দেখুন আমি ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি বলে আমার অনেকরকম মানসিক সমস্যা আছে । একটা সমস্যা হচ্ছে, আমি খুবই কল্পনাপ্রবণ । আমি কিছু একটা কল্পনা করলে তাকে একদম বাস্তবের মতো দেখতে পাই । কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই । আপনার ধারণা আমার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য আমার অবচেতন মন আপনাকে তৈরি করেছে । আপনার আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই ।
- যার এমন সমস্যা থাকে সে কিন্তু বুঝতে পারে না ।
- আমি এখনও পারছি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাইনি বলে হয়তো । একসময় আর পারবো না ।
- কিন্তু আপনার কেনও মনে হচ্ছে আমি কল্পনা?? আপনাকে তো আমি স্পর্শও করেছি !
- সে রাতে হয়তো বাস্তব ছিলেন কিন্তু এখন কল্পনা হতে পারেন । আর তাছাড়া এর আগেও একদিন আপনি আমাকে ডেকেছিলেন , মানে আমি ভেবেছিলাম , কিন্তু আপনি আসেননি ।
- আমি এসেছিলাম ।
- জি ??
- হ্যাঁ আমি এসেছিলাম । আমি দেখতে ছেয়েছিলাম আপনি আমার প্রতি কতখানি ডেডিকেটেড । তাই আপানার সামনে আসিনি । আপনি যতক্ষণ অপেক্ষা করেছেন আমিও ততক্ষণ ছিলাম । শেষে আপনি প্রচণ্ড কষ্টে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন প্রায় মধ্যরাতে ।
আমি আবারও চুপ হয়ে গেলাম । কি বলবো ! অসম্ভব আশা আর নিরশার মাঝখানে আমি অসহায়বোধ করছি । মেয়েটিই আগে বলল , এবার বিশ্বাস হলো ??
- আপনি আমার ফোন নাম্বার কই পেলেন ??
- সেই মাতাল রাতে আপনিই দিয়েছিলেন । আপনার মনে নেই!
আমার আবছাভাবে মনে পরে । আমি দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করি , আর যদিও আপনি বাস্তব হয়েই থাকেন তাহলে কেনইবা আমাকে বিয়ে করবেন ?? আমি মাতাল, মানসিক রোগী ।
- আপনাকে বিয়ে করার পেছনে আমার শক্ত একটা কারণ অবশ্যই আছে ।
- কি কারণ ?
- এখন তো বলা যাবে না । যদি আপানার সাথে আমার বিয়ে হয় তাহলে বাসর রাতের কোনও এক আবেগময় সময়ে আমি বলবো ।
- ওহ
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করে, কি আসছেন??
কি বলবো আমি ?? যদি মেয়েটা স্বপ্ন হয় তবে এরচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন আর আসেনি আমার জীবনে । যদি বাস্তব হয় তবে এরচেয়ে অসাধারন ঘটনাও থাকবেনা আমার জীবনে । কিন্তু মেয়েটা যদি স্বপ্নই হয় তাহলে আমার কি উচিৎ হবে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া ?? ওপাশের অপেক্ষা বাড়ে, বৃদ্ধি পায় আমার নীরবতা ।
২
রকিব আর মজনু নিঃশব্দে ছাদে উঠে আসে । ওদের পায়ের তলা যেনও বিড়ালের চেয়েও রেশমি । দুইজনেই আজিজ সাহেবের ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনীর উদীয়মান মাস্তান । এই প্রথম তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । অন্যদিনের চেয়ে আজ তারা বেশি সতর্ক । যদিও কাজটা তেমন কঠিন কিছু না । শুধু ছাদের হুকের সাথে লাগানো বেলুনবাড়ির দড়িটা কেটে দিতে হবে । ধীর পায়ে তারা বেলুনের নীচে এসে দাঁড়ায় । উপরে তাকাতেই থমকে গেলো তাদের চোখ। বেলুনের মাথায় লাল নীল বাতি জ্বলছে । তারা জানে বেলুনবাড়িতে বাসর রাত হলে এই আলো জ্বলে । সাধারণত এমন রাতে সেই বাড়িতে হাত দেওয়া হয়না । রকিব মজনুর দিকে তাকায় । তাদের মাঝে কোনও কথা হয়না । এটাই তাদের প্রথম বড় কাজ । ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছে আজকের কাজের উপরে , তাই তারা ঝুকি নিতে পারে না । মজনু একটু মাথা দোলায় । তারপর দুইজনে মিলে কাটতে শুরু করে দড়ি ।
৩
“ আরে আমরা উড়ে যাচ্ছি কেনও” চমকে উঠে সেই মাতাল রাতের মেয়েটি বলে উঠলো ! আমি হাসলাম । বললাম, “নীলিমা স্কাই বিল্ডারস অনেক দিন থেকেই আমার বেলুনবাড়ি দখল নিতে চাচ্ছিলো । কিন্তু আমি দিচ্ছিলাম না । কারণ আমি ভেবেছিলাম, এই বাড়িটা ছাড়া আমাদের আর কোনও যোগাযোগের উপায় নেই । শেষমেশ ওরা আর ধৈর্য ধরল না । আজকেই দড়ি কেটে দিলো” । মেয়েটার হতভম্বভাব তখনও যায়নি । সে বলল, আমরা তো আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম । আমি আবার হাসলাম , বললাম, আকাশের চেয়ে বড় আশ্রয় আর কি আছে । মেয়েটা চারপাশে তাকালো । আমিও তাকালাম । আমরা একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছি । আর একটু একটু করে অন্ধকার তার গভীরে টেনে নিচ্ছে যাবতীয় অলৌকিক আলো । শূন্য স্পর্শের কিছু হাওয়া মিলে মিশে জমছে আমাদের বিছানায়। অনেকদূরে একটা তারা খসে পড়লো কারও ইচ্ছেপূরণের প্রার্থনা হতে । কিছু নাবালক সাদা মেঘ শরীর ভাসিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে । সমগ্র চরাচরে যেনও আর কিছু নেই ! এমন বাসররাত কি হয়েছে কখনও কারও কোনওকালে ?? আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম । ওর ভেজা চোখের কোণায় আশ্রয় নিতে চায় শেষ রাতের মরাটে জোছনা । বোকা চাঁদ জানে না কারও অশ্রুতে জোছনার ছায়া পরে না ।
( উৎসর্গ – ঢাকা শহরের যানজটকে । এই অনভ্যস্ত শহরে চাকার গোঁজামিলে আটকে গেলে কেবলই মনে হয় যদি আমি গ্যাসবেলুন নিয়ে উড়ে যেতে পারতাম ! )