somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশ দস্যুতা এবং মাতাল রাতের সেই মেয়েটির গল্প - আকাশের নীল আমার ঠিকানা

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশ দস্যুতা


নীলিমা স্কাই বিল্ডারস এর প্রধান আজিজ সাহেব মুখ বেজার করে বসে আছেন । মুখ বেজার করে থাকার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি । তিনি এক মাস আগে একটি নির্দেশ দিয়েছেন অথচ এখনও সেটা পালন হয়নি । তিনি জিএম আদনানকে ডাক দিলেন । এই আদনান আর তিনি মিলেই গড়ে তুলেছেন নীলিমা স্কাই বিল্ডারস । মূল আইডিয়া অবশ্য আদনানেরই ছিল , কিন্তু টাকা ছিলো না । সে তার আইডিয়া নিয়ে নানা জায়গায় গেছে , সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে । অবশ্য না দেওয়ারও কিছু ছিলো না । কেউ যদি বলে, মানুষের বসবাসের জন্য গ্যাসবেলুনের ব্যাবস্থা করলে কেমন হয় তাহলে যে কেউই তাই করবে ! তার আইডিয়া ছিলো, মানুষ যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে কিছুদিন পর মানুষের থাকার জন্য আর জায়গা থাকবে না । সব জমি চলে যাবে ভুমিদস্যুদের দখলে , কিন্তু তাদের বানানো ফ্লাটও একসময় সোনার হরিন হয়ে যাবে মানুষের কাছে । তখন হন্ন্যে হয়ে মানুষ জায়গা খুঁজবে বসবাসের , কিন্তু পাবেনা , সেই সময়ের জন্য যদি আমরা আকাশটা দখল করে নেই তাহলে কেমন হয়?? একেকটা বিল্ডিঙের ছাদে যতগুলো সম্ভব গ্যাসবেলুন । সেই গ্যাসবেলুনে থাকবে অন্তত তিন জন মানুষ থাকার ব্যাবস্থা । সারাদিন আকাশে এক জায়গায় স্থির থাকবে বেলুন । ঝড় বৃষ্টি বা শীতে ফলস সিলিং দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে । বিল্ডিঙের ছাদে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হবে বেলুনবাড়িগুলো । ছাদ থেকে ওঠা নামার জন্য ব্যাবহার করা হবে দড়ির মই । আর প্রতিমাসে হওয়া ভাড়া দিতে হবে । আর বেলুনগুলোর ঠিকানা হবে , বিল্ডিঙের নাম্বার অনুসারে , যেমন , ১২/৩ বিল্ডিং ৪ নাম্বার বেলুন ! আজিজ সাহেব বুঝতে পারেন ভবিষ্যতে এটাই হতে যাচ্ছে । তাই তিনি আর দেরি না করে এই খাতেই বিনিয়োগ শুরু করলেন । প্রথমে অনেকেই পাগলামি ভেবেছিলো । কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা গেলো সত্যিই ফ্ল্যাট সব সোনার হরিন হয়ে গেছে মধ্যবিত্তদের কাছে । তখন তারা বেলুনবাড়ির পেছনেই ছুটছে । সময় লাগলেও আজিজ সাহেবের ব্যাংক ব্যাল্যান্স ফুলে ফেপে উঠলো । কিন্তু বেড়ে গেলো প্রতিদ্বন্দ্বী । এখানেও জমি দখলের মতো করে সবাই আকাশ দখলের লড়ায়ে নেমে গেলো । কিছুদিনের মধ্যেই আকাশে আর নীল দেখা যায় না । তাকালেই শুধু নানা ডিজাইনের বেলুন । নীল নয় রঙ্গিন আকাশ দেখে অভ্যস্ত হতে শুরু করলো মানুষ । সুযোগ বুঝে ছাদওলারা বেশি ভাড়া দাবি শুরু করলো, সরকার ধার্য আকাশসীমার ট্যাক্স । আর উপদ্রপের মতো পিছনে লেগে থাকলো সমাজের কবি সাহিত্যিক নামের কীটগুলো । আকাশ দেখতে না পেয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতা নাকি থেমে যাচ্ছে, বাচ্চাদের নাকি মানসিক গঠন সুস্থ হচ্ছে না । আজ তারা মানববন্ধন করে কাল কবিতা লিখে । তারা আজিজ সাহেবের নাম দিয়েছে আকাশদস্যুদের সর্দার । তাতে আজিজ সাহেবের থোড়াই কেয়ার । পারলে তোরা মানুষের বাসস্থান করে দে , তা তো পারবি না । আজও তারা কি এক কর্মসূচী ডেকেছে । কিন্তু তিনি সেসব নিয়ে চিন্তিত না, তিনি চিন্তিত একটা বাড়ির ছাদ কিছুতেই দখল করতে পারছেন না বলে । সেখানে একটা ছাদে একবেলুনে একজনই থাকে, কিন্তু সেই পুরোটা ছাদ দখল নিয়ে থাকে । তাকে উৎখাত করতে পারলেই তিনি নতুন প্রকল্প শুরু করতে পারেন কিন্তু গত একমাস ধরে সে নির্দেশ দিয়েও সে কাজ হয়নি । তিনি আবারও আদনান সাহেবকে ডাক দিলেন ।





পূর্বকথা ঃ আমি এবং সেই মাতাল রাতের মেয়েটি



যারা একাকী বড় হয় তাদের নানারকম মানসিক সমস্যা নিয়ে বড় হয় । বেশিরভাগই সাধারণ সমস্যা । আমার ছোটবেলায়, প্রায় বন্দী অবস্থায় বড় হওয়ার কারনে নানারকম মানসিক সমস্যা আমারও আছে । এর মাঝে সাধারণ একটা সমস্যা হচ্ছে, আমি মাঝে মাঝে একসাথে দুইটি দৃশ্য দেখি । একটা বাস্তব, একটা হেলুসিনেশন । কঠিন লাগছে?? বুঝিয়ে বলি, ধরা যাক, আমার সামনে দুইজন লোক বসে আছে । একজন লোক হঠাৎ আরেকজন লোকের পিঠে আদর করে চাপড় দিলো । আমি সেই দৃশ্য দেখবো , সাথে সাথে আমার মস্তিস্ক আরেকটি দৃশ্য তৈরি করবে যেখানে আমি দেখবো, লোকটা আসলে তার পিঠে ছুরি বসাচ্ছে । ঠিক জানি না, হয়তো দুটি দৃশ্যর মাঝে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ পার্থক্য থাকে বলে আমি বুঝতে পারি কোনটা আসল আর কোনটা হেলুসিনেশন । মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়, যদি কখনও এই সেকেন্ডের পার্থক্য ঘুচে যায় ? আমি যদি আর দুইটা দৃশ্য আলাদা করতে না পারি ??

এই মুহূর্তেও আমার মধ্যে সেই ভয়টা কাজ করছে । এই মুহূর্তে আমার সামনে যে মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখছি তাকে আমার বিভ্রম মনে হওয়ার কারণ নেই , অথচ হচ্ছে । যেদিন তাকে প্রথম দেখি তাকে কিন্তু বিভ্রম মনে হয়নি । অদ্ভুত হলো তখনই বিভ্রম হওয়ার সুযোগ ছিলো বেশি । ঝমঝমে বৃষ্টির রাত, যাত্রী ছাউনিতে মেয়েটা একা বসে ছিল । আশেপাশে শেষ জনমনুষ্য বলতে আমি । সেও পুরোপুরি সুস্থ না । সদ্যবিবাহিত সহকর্মীর লক্ষ্মী সুন্দরী বউটি দেখে ঈর্ষান্বিত আমার বহুবছরের অবদমিত নিঃসঙ্গতা জেগে উঠেছিলো তীব্র ব্যাথা নিয়ে । সেই ব্যাথা কমাতেই পেটে কিছু তরল চালিয়েছিলাম । অনভ্যস্ত পাকস্থলী বোধহয় তা সহ্য করতে পারছিলো না । পেট বাঁকিয়ে ভাঙ্গাচোরা ভঙ্গিতে বসে বসে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম মেয়েটির দিকে । মেয়েটি কিন্তু সরাসরিই তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে । কোনও দ্বিধা কোনও জড়তা নেই । ঠিক এখন যেভাবে তাকিয়ে আছে ।

“ কিছু বলবেন না বুঝি ??” মেয়েটার কোথায় সৎবিত ফিরে আমার । আমি মৃদু হাসলাম । মেয়েটি বলল, সেই রাতের কথা ভাবছেন তো ?? আমি আবার বিভ্রান্ত হই । এই মেয়েটি কি আমার মনের কল্পনা নয় ?? নাহলে আমার মনের কথা টের পাচ্ছে কিভাবে ?? আমি অস্বস্তিবোধ করি । মেয়েটা আবার বলে ওঠে, অস্বস্তিবোধ করার কিছু নেই । আপনি সহজ হন । আমি সহজ হওয়ার চেষ্টা করি । যেমন সে রাতে করেছিলাম । তার দিকে হাসি দিয়ে । তবে হাসিতে মনে হয় আমার অসুস্থতাই ফুটেছিল বেশি । মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলো, আপনার কি বমি পাচ্ছে ?? আমি তাকালাম তার দিকে সরাসরি । আমার ঝাপসা চোখে তাকে মনে হচ্ছিলো সে আমার বন্ধুর বউটি কিংবা আরও পরিচিত কেউ । দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম আজ আবার দেখা হয়েছে হঠাৎ । আমার বুকে আবার বেজে উঠেছিলো কনকনে নিঃসঙ্গতার কষ্ট । এই ভাবনাটি কিও ধরতে পারলো মেয়েটি ?? জিজ্ঞেস করলো, আপনার মা বাবা থাকেন না আপনার সাথে ?? আমি বললাম, না । অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন তারা ।
- ওহ অ্যাই আম সরি ।
- নো ইটস ওকে
- তারপর আপনি কার কাছে বড় হলেন ??
- এতিম খানায় ।
- ওহ

মেয়েটার চোখে বিষাদ ফুটে উঠলো । আসলেই কি ফুটে উঠলো নাকি সেটা আমার কল্পনা । মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করলো , আপনার শরীর এখন কেমন ?? আমি কিছু না বলে হাসলাম । সুস্থ হাসি । মেয়েটা আবার বলল, “প্রথম পরিচয়েই কোনও মেয়ের সামনে বমি করে দেওয়া কোনও কাজের কথা না”। আমি লজ্জা পেলাম । কিন্তু থামলো না। একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “তাও আবার মাতাল হয়ে !” আমি জানি, আসলেই কাজের কথা না । তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বমিটা আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম আমি । কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । শরীর গুলিয়ে আসছিলো , মনে হচ্ছিলো পেটের ভিতরে যা কিছু আছে, কিডনি লিভার সব যেনও টেনে হিঁচড়ে বেরিয়ে আসতে চায় । মৃত্যু কি খুব কাছে চলে এলো আমার ?? একসময় অনুভব হলো মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । কোমল স্পর্শ পেলাম আমার কাঁধ আর মাথায় । নরম সুরে মেয়েটা বলেছিল, মাথাটা আরেকটু নীচে করুন । আমার মনে হয়েছিলো, এই যাত্রায় হয়তো মারা যাবো না ।

- দেখুন আপনাকে অস্বস্তি ফেলার জন্য আমি কথাগুলো বলছি না । মজা করার জন্য বলছি । আবার বাস্তবে ফিরে আসি আমি । বললাম, বুঝতে পেরেছি । হাসলাম । মেয়েটার মুখে আবার দুষ্ট হাসি ফিরে আসলো , বলল, “সেদিন আপনি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন মনে আছে ??” আমি জানতাম, এই প্রসঙ্গ আসবেই । বমি হওয়ার সময় যখন মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল পর কেউ আমাকে এতো কোমলভাবে স্পর্শ করছে । আমার আজন্ম তৃষ্ণার্ত হৃদয় গুমরে উঠেছিলো । মনে হচ্ছিলো, এই হাত এই স্পর্শ যেনও অনন্তকাল থাকে । তখন মেয়েটিকে আর অচেনা কেউ মনে হচ্ছিলো না । বোধহয় এমন একটা মুহূর্তের জন্যই মানুষ অপেক্ষা করে সারাটি জীবন । কেউ পায় কেউ পায় না । আমি সেই ঘোরের ভিতরেই বলে বসলাম, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই । জানি এটা খুব একটা আদর্শ মুহূর্ত নয় এমন প্রস্তাব দেওয়ার কিন্তু এর চেয়ে খাদহীন অনুভূতিও আর কখনও আসবে না । মেয়েটি শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো । আজ সেসব মনে পড়ায় অজান্তেই হাসলাম আমি । আমাকে হাসতে দেখেই মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার বুঝি কোনও গার্লফ্রেন্ডও নেই ?? আমি বললাম, না । মেয়েটা সব জান্তার একটা ভাব নিয়ে বলল, আমিও তাই ধারণা করেছিলাম । গার্লফ্রেন্ড থাকলে বুঝতেন কখন একটা মেয়েকে প্রস্তাব দিতে হয় , কখন হয়না। আমি কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম । তারপর বললাম, “ঠিক তা নয় । আমি আসলে ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি । একা একা মানে শুধু বাবা মাকে ছাড়া তা নয় , আমি যে এতিমখানায় থাকতাম সেখানের পরিবেশের সাথেও আমি মানিয়ে নিতে পারিনি । সবসময় চুপচাপ থাকতাম । কারও সাথে মেশার চেয়ে নিজের সাথে কথা বলতেই বেশি ভালো লাগতো আমার । তীব্র নিঃসঙ্গতাতে আমার অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা, হয়েছিলামও । বড় হয়ে স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটিতেও আমার তেমন বন্ধু ছিলো না আমার চুপচাপ স্বভাবের কারনে । অফিসেও নেই । কিন্তু শেষপর্যন্ত মানুষই তো । অভ্যস্ততার বাহিরেও অন্তরের অন্তঃস্থলে কি যেনও একটা থেকে যায় । ক্লান্তির শেষে একটু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা কিংবা কোনও তারা ঝরে যাওয়া রাতে কারও হাত ধরে আকাশ দেখা । আপনাকে দেখে হঠাৎ মনে হয়েছিলো, আপনি আমার বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কেউ যার জন্য আমি ঘুরে ঘুরে অবশেষে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি” । এইবার মেয়েটির চুপ থাকবার পালা । কিছুক্ষণ পর সে বলল, তারমানে সেদিনের কথাটা শুধুই ক্ষণিকের আবেগ কিংবা মাতালের প্রলাপ ছিলো না । আমি বললাম, না । মেয়েটি আর কিছু বলল না । খানিকপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা আমি যাই । আমি তখনও একটু আগের বলা কথাগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত । সারা জীবনের চুপচাপ আমি হঠাৎ এতো কথা বলে ফেললাম কিভাবে কে জানে ! তারচেয়েও বেশি অস্বস্তিকর, মেয়েটি কি ভাবলো , এরপরে কি ভাববে সে আমার সম্পর্কে ! আমার কি মেয়েটিকে থামানো উচিৎ?? আমি মনে হলো আমি যেনও পিচ্ছিল কেকের উপর দিয়ে হাঁটছি । মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাচ্ছে তবুও আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি, যেমন আমি সারাটি জীবন চুপচাপ দেখেছি অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া । এর আগের দিন, বমি করার পর, মেয়েটা যখন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল তখন পরম নির্ভরতায় তার পাশে হেঁটেছি যেনও এর কোনও শেষ নেই । আজ তাকে হেঁটে চলে যেতে দেখে অদ্ভুত শুন্যতা গ্রাস করলো আমাকে যেন এরও কোনও শেষ নেই । এতক্ষণে আমার মনে হলো, মেয়েটার আমার অসুস্থ মনের কল্পনা নয়, আমার পাঁজর চেরা কষ্টের অংশ ।


কিন্তু সেই ভাবনা কাটতেও বেশি দিন দেরি হলো না আমার । মেয়েটা চলে যাওয়ার পর প্রতিটা দিন আমি অপেক্ষা করেছি সে আসবে । এইবার আসলে আর কোনও ভুল করবো না । ঠিক তার নাম জিজ্ঞাসা করবো । জিজ্ঞাসা করবো ঠিকানা । কিন্তু সে আর এলো না । এলোই না । হঠাৎ এক সকালে তার একটা চিরকুট এলো । একটা ঠিকানা দিয়ে লিখা, আজ এই জায়গাটায় চলে আসবেন বিকেল ৪ টায় । আপনার জন্য চমক আছে । ইতি , সেই মাতাল রাতের মেয়েটি । আমি গেলাম । অপেক্ষা করলাম । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা , সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত । কিন্তু তার দেখা পেলাম না । আবার ফিরে এলো সন্দেহ । আসলেই কি মেয়েটি ছিলো ?? নাকি কাল্পনিক সব চরিত্র তৈরি করে নিঃসঙ্গতা দূর করার আমার সেই পুরানো অসুখ ?? বাসায় এসে অনেক খুঁজেও চিরকুটটা পেলাম না । আমার সন্দেহ দৃঢ় হলো । হয়তো রাতের বেলা ঘুমের মাঝে নিজেই চিরকুটটি লিখেছিলাম কিংবা চিরকুটটাও আমার একটা কল্পনা ছিলো দীর্ঘদিন তাকে দেখতে না পেয়ে আমার হতাশ অবচেতন মন আমার জন্য এইভাবে গল্প সাজিয়েছিলো । প্রচণ্ড মন খারাপ হলো । অসংখ্য চোরা অশ্রুর সাক্ষী বোবা বালিশটাকেই একমাত্র সত্যি মনে হলো আমার ।


(আবার) আকাশ দস্যুদের অফিসে

আদনান সাহেব তার সামনে এসে দাঁড়াতেই আজিজ সাহেব বললেন, এই বাড়ির ছাদ এখনও দখল হয়নি কেনও ??
- স্যার ওই বেলুনবাড়িতে যিনি থাকেন তিনি ছাড়তে চাচ্ছেন না
- তাকে টাকা অফার করা হয়েছে ??
- জি । যত দাম তার বেশিই করা হয়েছে । কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন ।
- হুমকি দেওয়া হয়েছে ??
- জি তাও দেওয়া হয়েছে । কিন্তু লাভ হয়নি !
- আশ্চর্য ! কেনও ?? তার দাবি কি??
- তার কোনও দাবি নেই ।
- তাহলে কেনও ছাড়ছে না ??
- স্যার ভদ্রলোক একজন মেয়েকে পছন্দ করেন । কিন্তু মেয়েটার নাম ঠিকানা জানেন না । শুধু মেয়েটা তার ঠিকানা জানে । তার ভয় তিনি সেখান থেকে চলে গেলে আর কেউ কাউকে খুঁজে পাবেন না ।
- আজব !
- জি
- এই সময়েও কেউ ২০১৩ এর আবেগ নিয়ে চলে জানতাম না । মনে হচ্ছে, এটাও কবি সাহিত্যিকদের মতো কীট ।
আদনান সাহেব কিছু বললেন না । আজিজ সাহেব আবার বললেন, তার মতো আবেগ নিয়ে কাজ কারবার আমাদের নয় । আবেগ দিয়ে কিচ্ছু হবে না । আপনি আজকের রাতের মধ্যে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন ।
- জি স্যার
- কিছু বলার দরকার নেই। শুধু ছাদের হুকের দড়িটা কেটে দিবেন । যেদিকে খুশি উড়ে যাক । আমি কাল থেকেই ওখানে আমার প্রজেক্ট শুরু করতে চাই ।


অবশেষের দিন এবং রাত্রি

সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল ফোনের আওয়াজে । স্ক্রিনে দেখি অচেনা নাম্বার । আলস্য নিয়ে রিসিভ করলাম ।

- হ্যালো
- আমি সেই মাতাল রাতের মেয়ে বলছি ।
আমি চুপ হয়ে গেলাম । আমি ভেবেছিলাম আমি বিভ্রান্তি কেটে উঠেছি । কিন্তু সে আবার হাজির হয়েছে ।
- হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন ?? মেয়েটা বলল আবার ।
- জি বলুন
- আমি আজ আপনাকে বিয়ে করতে চাই । জানি এটা খুব একটা আদর্শ মুহূর্ত নয় এমন প্রস্তাব দেওয়ার কিন্তু এর চেয়ে খাদহীন অনুভূতিও আর কখনও আসবে না ।
- রসিকতা করছেন ??
- না । এর চেয়ে সিরিয়াস আমি কখনও ছিলাম না । হবোও না কখনও ।
- কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব ??
- কেনও সম্ভব নয়?? নাকি আপনি মন পরিবর্তন করেছেন ??
- না মন পরিবর্তন করিনি । একটা সমস্যা আছে ।
- কি সমস্যা ??
- আমার ধারণা আপনি আমার কল্পনা ।
- মানে ??
- দেখুন আমি ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি বলে আমার অনেকরকম মানসিক সমস্যা আছে । একটা সমস্যা হচ্ছে, আমি খুবই কল্পনাপ্রবণ । আমি কিছু একটা কল্পনা করলে তাকে একদম বাস্তবের মতো দেখতে পাই । কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই । আপনার ধারণা আমার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য আমার অবচেতন মন আপনাকে তৈরি করেছে । আপনার আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই ।
- যার এমন সমস্যা থাকে সে কিন্তু বুঝতে পারে না ।
- আমি এখনও পারছি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাইনি বলে হয়তো । একসময় আর পারবো না ।
- কিন্তু আপনার কেনও মনে হচ্ছে আমি কল্পনা?? আপনাকে তো আমি স্পর্শও করেছি !
- সে রাতে হয়তো বাস্তব ছিলেন কিন্তু এখন কল্পনা হতে পারেন । আর তাছাড়া এর আগেও একদিন আপনি আমাকে ডেকেছিলেন , মানে আমি ভেবেছিলাম , কিন্তু আপনি আসেননি ।
- আমি এসেছিলাম ।
- জি ??
- হ্যাঁ আমি এসেছিলাম । আমি দেখতে ছেয়েছিলাম আপনি আমার প্রতি কতখানি ডেডিকেটেড । তাই আপানার সামনে আসিনি । আপনি যতক্ষণ অপেক্ষা করেছেন আমিও ততক্ষণ ছিলাম । শেষে আপনি প্রচণ্ড কষ্টে ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন প্রায় মধ্যরাতে ।

আমি আবারও চুপ হয়ে গেলাম । কি বলবো ! অসম্ভব আশা আর নিরশার মাঝখানে আমি অসহায়বোধ করছি । মেয়েটিই আগে বলল , এবার বিশ্বাস হলো ??
- আপনি আমার ফোন নাম্বার কই পেলেন ??
- সেই মাতাল রাতে আপনিই দিয়েছিলেন । আপনার মনে নেই!

আমার আবছাভাবে মনে পরে । আমি দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করি , আর যদিও আপনি বাস্তব হয়েই থাকেন তাহলে কেনইবা আমাকে বিয়ে করবেন ?? আমি মাতাল, মানসিক রোগী ।
- আপনাকে বিয়ে করার পেছনে আমার শক্ত একটা কারণ অবশ্যই আছে ।
- কি কারণ ?
- এখন তো বলা যাবে না । যদি আপানার সাথে আমার বিয়ে হয় তাহলে বাসর রাতের কোনও এক আবেগময় সময়ে আমি বলবো ।
- ওহ
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটা আবার জিজ্ঞেস করে, কি আসছেন??
কি বলবো আমি ?? যদি মেয়েটা স্বপ্ন হয় তবে এরচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন আর আসেনি আমার জীবনে । যদি বাস্তব হয় তবে এরচেয়ে অসাধারন ঘটনাও থাকবেনা আমার জীবনে । কিন্তু মেয়েটা যদি স্বপ্নই হয় তাহলে আমার কি উচিৎ হবে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে দেওয়া ?? ওপাশের অপেক্ষা বাড়ে, বৃদ্ধি পায় আমার নীরবতা ।




রকিব আর মজনু নিঃশব্দে ছাদে উঠে আসে । ওদের পায়ের তলা যেনও বিড়ালের চেয়েও রেশমি । দুইজনেই আজিজ সাহেবের ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনীর উদীয়মান মাস্তান । এই প্রথম তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । অন্যদিনের চেয়ে আজ তারা বেশি সতর্ক । যদিও কাজটা তেমন কঠিন কিছু না । শুধু ছাদের হুকের সাথে লাগানো বেলুনবাড়ির দড়িটা কেটে দিতে হবে । ধীর পায়ে তারা বেলুনের নীচে এসে দাঁড়ায় । উপরে তাকাতেই থমকে গেলো তাদের চোখ। বেলুনের মাথায় লাল নীল বাতি জ্বলছে । তারা জানে বেলুনবাড়িতে বাসর রাত হলে এই আলো জ্বলে । সাধারণত এমন রাতে সেই বাড়িতে হাত দেওয়া হয়না । রকিব মজনুর দিকে তাকায় । তাদের মাঝে কোনও কথা হয়না । এটাই তাদের প্রথম বড় কাজ । ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছে আজকের কাজের উপরে , তাই তারা ঝুকি নিতে পারে না । মজনু একটু মাথা দোলায় । তারপর দুইজনে মিলে কাটতে শুরু করে দড়ি ।



“ আরে আমরা উড়ে যাচ্ছি কেনও” চমকে উঠে সেই মাতাল রাতের মেয়েটি বলে উঠলো ! আমি হাসলাম । বললাম, “নীলিমা স্কাই বিল্ডারস অনেক দিন থেকেই আমার বেলুনবাড়ি দখল নিতে চাচ্ছিলো । কিন্তু আমি দিচ্ছিলাম না । কারণ আমি ভেবেছিলাম, এই বাড়িটা ছাড়া আমাদের আর কোনও যোগাযোগের উপায় নেই । শেষমেশ ওরা আর ধৈর্য ধরল না । আজকেই দড়ি কেটে দিলো” । মেয়েটার হতভম্বভাব তখনও যায়নি । সে বলল, আমরা তো আশ্রয়হীন হয়ে গেলাম । আমি আবার হাসলাম , বললাম, আকাশের চেয়ে বড় আশ্রয় আর কি আছে । মেয়েটা চারপাশে তাকালো । আমিও তাকালাম । আমরা একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছি । আর একটু একটু করে অন্ধকার তার গভীরে টেনে নিচ্ছে যাবতীয় অলৌকিক আলো । শূন্য স্পর্শের কিছু হাওয়া মিলে মিশে জমছে আমাদের বিছানায়। অনেকদূরে একটা তারা খসে পড়লো কারও ইচ্ছেপূরণের প্রার্থনা হতে । কিছু নাবালক সাদা মেঘ শরীর ভাসিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে । সমগ্র চরাচরে যেনও আর কিছু নেই ! এমন বাসররাত কি হয়েছে কখনও কারও কোনওকালে ?? আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম । ওর ভেজা চোখের কোণায় আশ্রয় নিতে চায় শেষ রাতের মরাটে জোছনা । বোকা চাঁদ জানে না কারও অশ্রুতে জোছনার ছায়া পরে না ।




( উৎসর্গ – ঢাকা শহরের যানজটকে । এই অনভ্যস্ত শহরে চাকার গোঁজামিলে আটকে গেলে কেবলই মনে হয় যদি আমি গ্যাসবেলুন নিয়ে উড়ে যেতে পারতাম ! )
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩০
৪১টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×