“A writer’s obituary should be one liner - He wrote books, then he died” – William Faulkner
আমাকে আমার কিছু বন্ধু হিমু বলে ডাকতো । আমার কিছু চাচাতো ভাই বোনেরও ধারণা ছিল, আমার মধ্যে হিমু ভাব প্রবল। আমি জানতাম আসলে তা নয়। আমার মত ছা-পোষা টাইপ মধ্যবিত্ত ছেলেরা কখনও হিমু হতে পারেনা। কিন্তু তারপরেও ভিতরে ভিতরে যে আমার ভালো লাগত না তা নয়। হিমুর বই পড়েছে কিন্তু হিমু হতে চায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া তো অসম্ভব।
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বড় স্বার্থকতা সম্ভবত এখানেই। আপনি যখন একটা চরিত্রকে বই এর পৃষ্ঠাতে পড়ছেন তখন আর তাকে আপনি কাল্পনিক ভাবতে পারছেন না, বরং সেই জায়গায় নিজেকে দাড় করিয়ে দিচ্ছেন। সেই চরিত্রের সাথে আপনি হাসছেন, কাঁদছেন, তাঁর সব অনুভূতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করছেন। আপনি নিজেও টের পাচ্ছেন না আপনি আসলে সম্মোহিত হয়ে গেছেন ।
অবশ্য লেখক হিসেবে উনি কত বড় ছিলেন সেটা নিয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য না। আমি সেটার যোগ্যও না। আমি জানি তাঁর বই নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। ক্ল্যাসিক ধারার অনুসারীরা তাকে লেখকই মনে করেন না। সেসব নিয়ে অনেক বড় বড় তর্ক বিতর্কও আছে। বিতর্ক আছে তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন নিয়েও। কিন্তু সেসব নিয়ে নয় আমি শুধু আমার ব্যাক্তিগত কিছু অনুভূতির কথা বলতে চাই।
যদিও তিনি সমালোচকদের মতে জনপ্রিয় ধারার লেখক, কিন্তু তাঁর মত মানুষের অনুভূতির গোঁড়ায় টান দিতে পারে কয়জন??
হয়ত সে কারনেই সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম বইমেলার জন্য। আমি আর আমার বোন তৃষা সারা বছর আলাদা করে টাকা জমাতাম বই মেলায় তার বই কিনবো বলে । আর বই মেলা শুরু হলে প্রতিদিন একবার ঢুঁ মারতাম লাইব্রেরীতে। এমন হয়েছে লাইব্রেরিয়ান বই’র বান্ডিল খুলে প্রথম বইটা আমাকে দিয়েছে। এবং সে বইটা যে হুমায়ূন আহমেদের হতো তা বলাই বাহুল্য। ভাবতে অবাক লাগে, একটা বই কিনে আনার পর সেটা নিয়ে কত ঝগড়া করেছি তৃষার সাথে। তারপর বই হাতে আসার পর উৎসর্গপত্র থেকে শুরু করে শেষ অক্ষর পর্যন্ত বুভুক্ষের মত এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলার চেষ্টা। অন্য অনেকের মতো তার অনেক বই’র উৎসর্গপত্রও মুখস্ত। অনেক জায়গায় আমি সেগুলো ব্যবহারও করতাম। কিছু কবিতা আমি যেখানে সেখানে লিখি। যেমন –
“ যদি আজ বিকেলের ডাকে
তাঁর কোনও চিঠি পাই
অথবা যদি সে নিজেই এসে থাকে
এতদিন পর যদি তাঁর মনে হয়
দেরি হোক যায়নি সময়” ।
মনে আছে কলেজের প্রতিটা খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে রাখতাম-
“ দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই” ।
হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো গল্প প্রধান না হয়ে চরিত্রপ্রধান হতো বলে সব বই এ কিছু মনে রাখার চরিত্র থাকতো। বাদল, বড় ফুপা, মাজেদা খালা, বাকের ভাই, মুনা, টুনি ভাবি, নিলু, শুভ্র কত নাম বলবো!!! এমনও হয় বই’র নাম ভুলে গেছি কিন্তু চরিত্রগুলো ঠিক মনে আছে। আমি শারলক হোমস পড়ার আগেই মিসির আলি পড়েছি। এই কারনেই মিসির আলির কাছ থেকেই আমি প্রথম যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করা শিখেছি। অনেক সময় কিছু না বুঝলে ভেবেছি, আমার জায়গায় মিসির আলি থাকলে কিভাবে দুইয়ে দুইয়ে চার করতেন।
আর কিছু চরিত্র নিয়ে বুকের গহীনে ছিল গোপন ব্যাথা। কতদিন ভেবেছি আমার জীবনে যদি রুপার মত কেউ থাকতো। গভীর বিষণ্ণতায় আমার সব অপূর্ণতা মেনে নিয়ে অপেক্ষা করত আমার জন্য অথবা কিছুই মানতে না পেরে খুব রাগ করে চিঠি দিত “তুমি এত পাগল কেনও? তুমি কি ভাবো আইসব পাগলামি দেখে আমি তোমাকে আর বেশি ভালবাসবো? (ময়ুরাক্ষি)” । কখনও মনে হয়েছে সবকিছু ছেড়ে কোনও মেয়ের হাত ধরি যে হবে মারিয়ার মত দুঃখী-যে মেয়ে হাসি দিয়ে বহুদিন আগের কান্নার ছায়া ঢাকতে পারেনা (হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম) ।
অদ্ভুত রকম ইচ্ছেও কম ছিল না। “মৃন্ময়ী” পড়ার পর এতোটা মুগ্ধ হয়েছিলাম, ঠিক করেছিলাম আমার কখনও মেয়ে হলে তাঁর নাম রাখবো মৃন্ময়ী।
আর যে বইটা মুগ্ধতার সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল সেই “ জোছনা ও জননীর গল্প” সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের মাস্টারপিস। বইটা পড়ার সময় দুঃখ কষ্ট রাগ ঘৃণা গর্ব কত বিচিত্র অনুভূতির সাথেই না পরিচয় হয়েছিল। একই মলাটের ভিতর এতোটা আবেগের উচ্ছাস খুব কম বই পড়েই হয়েছে। মনে আছে এই বইটা পড়ে দীর্ঘদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এতটাই যে পাঠ্য বই পড়ার সময়েও আমি সবার সামনে এই বই পড়তাম।
নয়তো এমনিতে বই পড়লে বকা খেতে হয় বলে সাধারণত বইগুলো রাতে পড়া হত আমার,সবাই ঘুমানোর পর । বড় লাইট জালিয়ে রাখলে আম্মা টের পাবে এই ভয়ে কত রাত ডিম লাইটে বই পড়েছি। মশারীর ভিতর চোখের একেবারে কাছে নিয়ে এসে পড়তে পড়তে কখন যে চরিত্রগুলোকে আপন ভাবতে শুরু করতাম টেরই পেতাম না। টের পেতাম না কখন বালিশ ভিজে গেছে চোখের জলে। তখন ভীষণ সাদাসিদে হাসানকে আর হাসান মনে হতো না। মনে হতো আমিই যেন হাসপাতালে শুয়ে অপেক্ষা করছি গারো অন্ধকারের ( মেঘ বলেছে যাবো যাবো)। এইভাবেই আমার নরম বালিশ সাক্ষি হয়ে আছে রাবেয়া আপার রঙ ফর্শাকারী ক্রিমের কৌটার যেটাতে করে ২০ টাকা দিয়ে ভালবাসা কিনে এনেছিলেন তাঁর বাবা ( শঙ্খনীল কারাগার) , সাক্ষী হয়ে আছে ঘুমন্ত আনিসের কপালে জরির ভালোবাসার কোমল স্পর্শের যার জন্য একটি পুরুষ আজীবন তৃষিত হয়ে থাকে (নির্বাসন), মিজান সাহেবের ক্ষুদ্র আফসোস তার- তিনি তাঁর ছেলেকে কতটা ভালোবাসতেন তা বুলু কোনদিনও জানতে পারল না (অন্ধকারের গান), সুপ্রভা নামের এক অভিমানী কিশোরীর - মৃত মানুষের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না এই চরম সত্যটি না জেনেই যে হারিয়ে গিয়েছিলো (অপেক্ষা), জয়নাল নামের এক আধ পাগল যুবকের যে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটির বিনিময়ে এক অনাত্মীয় চাচাজির জীবন ভিক্ষে চায় স্রস্টার কাছে (আজ আমি কোথাও যাবো না), এক গ্রাম্য ডাক্তারের জন্য শহুরে নবনীর জনম জনম তব তরে কাঁদিবার প্রতিশ্রুতির ( তেঁতুল বনে জোছনা), সমুদ্রের ফেনার মত সাদা চাদরে শোয়া মুহিবের হাত ধরে অরুর পিছুডাকের- আমি সব কিছুর বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছিলাম;তোমাকে পেয়েছি আমি তোমাকে চলে যেতে দেব না; তোমাকে তাকাতেই হবে তাকাতেই হবে…… (কৃষ্ণপক্ষ)।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেমন লাগছিলো তার এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে যেখানে তিনি থাকতে চেয়েছিলেন হাজার বছর?? কতখানি অপূর্ণতা লুকিয়ে ছিলো তার বুকের গহীনে ?? কি ছিল এই দুঃখী বলপয়েন্ট এর শেষ চিন্তা??
কোনওদিনও আর জানা হবে না। জানা হবেনা কেমন কাটছে তাঁর কলমবিহীন সময়। জানা হবে না যে অন্যভুবনের সন্ধানে কেটেছে তাঁর জীবন (বলপয়েন্ট) সে ভুবনের দেখা কি তিনি পেয়েছেন?? কিংবা যে ফানুস উড়াবার যে সলজ সাধ তাঁর আজন্ম, তিনি কি পেয়েছেন তার খোঁজ??
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, লিখালিখি হল এক নিঃসঙ্গ যাত্রা। সমস্ত মানবজীবনই কি তাই নয় ?? সবকিছুর শেষে মানুষের প্রাপ্তি তো শুধুই একাকীত্ব। মানুষ সেই একাকীত্বর বুকে আঁকিবুঁকি কাটে। কেউ কাঠপেন্সিলে, কেউ বলপয়েন্ট দিয়ে। কিন্তু অবশেষের ঘরে হাহাকার ছাড়া আর কিছু থাকে না। আপনিই যেমন বলেছেন,
শুয়ে শুয়ে অশোক পাতায়
মুমূর্ষু শিশির বলে, “হায়
কোনও সুখ ফুরায়নি যার
তার কেনও জীবন ফুরায় ?” (একজন মায়াবতী)
পরিশিষ্ট
স্যার, আপনার কাছেই জেনেছি প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করেনা। কেউ হয়ত এসে আপনার জায়গা পুরন করবে। কিন্তু এও জানি, কোনও ক্লান্তিভাঙ্গা সময়ে বই’র তাকে হাত বাড়ালে আমার হাত আপনার বই ঠিক খুঁজে নেবে। অতঃপর এক পৃষ্ঠা দুই পৃষ্ঠা পাল্টাতে পাল্টাতে পেরুবে ঘণ্টা, দিন , মাস, বছর । এবং এইভাবেই অনেক বছর পর, হয়ত তিরিশ বছর কিংবা তারও বেশি, যদি বেঁচে থাকি…… কোনও “রোদন ভরা বসন্তে” কিংবা “শ্রাবণ মেঘের দিন”এ কোলের কাছে কাউকে বসিয়ে বলবো…… আমাদের কৈশোর, তারুণ্যটা অসাধারণ ছিল, কারন আমাদের ছিল একজন হুমায়ুন আহমেদ … কোনোদিন পারবোনা জেনেও তার দেখানো গন্তব্যবিহীন পথে হাঁটার সাধ নিয়ে কেটে গেছে অসংখ্য বৃষ্টিবেলা অথবা জোছনাকাল ……
শুভ জন্মদিন স্যার !
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৪৮