আজ থেকে বহু বছর আগে আলবার্ট আইনস্টাইন বলে গেছেন মহাবিশ্ব নিয়ত প্রসারিত হচ্ছে আর এর সঙ্গে সঙ্গেই মহাবিশ্বের উপাদানগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব বেড়ে চলেছে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলো ক্রমেই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর সম্প্রতি তিন মার্কিন বিজ্ঞানী টাইপ-১এ সুপারনোভা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে মহাবিশ্বের এই প্রসারনের গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৪ অক্টোবর লরেন্স বার্কলি ন্যাশনাল ল্যাবের সল পার্লমুটার, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ল্যাবের ব্রায়ান স্মিড এবং জন হফকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এডাম রিজ মহাবিশ্বের এই ক্রম-প্রসারমানতা আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের দুটো দল পৃথকভাবে এ কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
মহাবিশ্বে যে পরিমাণ বস্তু রয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবে মনে হয় পারে এসব বস্তুর মধ্যাকর্ষণ বলের কারণে মহাবিশ্বের প্রসারনের গতি ক্রমেই কমে আসবে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ দুটো দল (যারা এ বছরে নোবেল জয় করেছেন) ১৯৯৮ সালে সবাইকে একেবারে অবাক করে দিয়ে দেখিয়ে দেন যে মহাবিশ্বের প্রসারনের হার আসলে কমছে তো নয়ই বরং বাড়ছে (একসেলারেটিং)। যোজন যোজন দূরের সুপারনোভা থেকে আসা আলোর উজ্জ্বলতার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে স্বল্প দূরত্বের সুপারনোভার আলোর উজ্জ্বলতার তুলনা করে বিজ্ঞানীরা এ ফলাফলে উপনীত হন।
তারা দেখেছেন যে দূরবর্তী সুপারনোভার আলো যেমনটি হওয়ার কথা তার চেয়ে এটা ২৫ শতাংশ বেশি অনুজ্জ্বল বা মলিন। এ থেকে বোঝা গেছে সুপারনোভাটির গতি বৃদ্ধি পেয়ে প্রত্যাশিত দূরত্বের চেয়ে অনেক বেশি দূরে চলে গেছে। এ ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে যে, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এবং এই প্রসারনের গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নক্ষত্র জ্যোতির্বিদ্যার জন্য এ আবিষ্কার একটা মাইলফলক বলা যেতে পারে। একই সঙ্গে আগামী প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জও বটে।
বিজ্ঞানীদের এ আবিষ্কার মহাবিশ্বের অন্তিম অবস্থা সম্পর্কে একটা নতুন চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতের মহাবিশ্ব হতে পারে মারাত্মক রকম শীতল একটা জগৎ যার আকাশ ঘোর কৃষ্ণবর্ণের। নক্ষত্রের আলো সেখানকার অন্ধকার দূর করতে পারছে না কারণ তারা একটা আরেকটা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত গতিতে।
প্রায় এক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা মনে করছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারনের গতি ক্রমেই সøথ হয়ে আসছে। ৯০-এর দশকে সল পার্লমুটার, ব্রায়াম স্মিড এবং এডাম রিজ ৫০ টিরও বেশি দূরবর্তী নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণের (সুপারনোভা এক্সপ্লোশন) ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান এর থেকে যে আলো এসে পৌঁছেছে তা প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি অনুজ্জ্বল। এ পর্যবেক্ষন থেকেই তাঁরা বলছেন গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে ক্রমবর্ধমান গতিতে ছুটে চলেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর গতি বৃদ্ধির (একসেলারেশন) পেছনে কাজ করছে একটি মহাজাগতিক বল (কসমিক ফোর্স) যেটাকে বিজ্ঞানীরা ডার্ক এনার্জি নামে অবিহিত করছেন। এই ডার্ক এনার্জি এখনো মহাবিশ্বের এক অমীমাংসিত রহস্য।
বিজ্ঞানীদের এ আবিষ্কার আরো নির্দেশ করছে যে প্রসারনের গতি এভাবে বাড়তে থাকলে মহাবিশ্ব ক্রমেই ক্রমবর্ধমান হারে শীতল হতে থাকবে। পৃথিবী থেকে ৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সিগুলো প্রতি সেকেন্ডে ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছে। আর ৬ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিগুলো প্রায় দ্বিগুণ গতিতে ছুটে চলেছে। গবেষণাটি থেকে ধারনা করা যায় যে এখন থেকে কোটি কোটি বছর পর মহাবিশ্ব হয়ে উঠবে অনেক অনেক বড় প্রায় অন্তহীন একটা আকারের খুব শীতল এবং নিঃসঙ্গ একটা স্থান। মহাবিশ্বের শুরু বিগ ব্যাংগের সাপেক্ষে এই ভবিষ্যৎ পরিণতিটিকে ‘বিগ রিপ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, কোটি কোটি বছর পরে গ্যালাক্সিগুলো এত দ্রুত গতিতে ছুটে চলবে যে তা থেকে নির্গত আলো এখনকার মতো মহাবিশ্বের অন্য দূরবর্তী স্থানে পৌঁছতে পারবে না।
প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া বিগ ব্যাংগ বা মহাবিস্ফোরণের পর থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এমন ধারণা আমরা প্রায় ১ শতাব্দী ধরে জেনে আসছি। কিন্তু প্রসারনের গতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন আবিষ্কার সর্বত্রই বিস্ময়কর। আর এটা অব্যাহত থাকলে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি হতে পারে জমাট বরফ।
বয়েল সুইমিশ একাডেমী জানিয়েছে, পুরস্কারের দেড় মিলিয়ন ডলারের অর্ধেক পাবেন পার্লমুটার। আর স্মিড এবং রিজ বাকি অর্ধেক ভাগাভাগি করে নেবেন। ৫২ বছর বয়সী পার্লমুটার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেন্স বার্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। শিমিটের বয়স এখন ৪৪ বছর। তিনি কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হাই-জেড সুপারনোভা সার্চটিমের প্রধান হিসেবে । আর ৪১ বছর বয়সী রিজ বাল্টিমোরে অবস্থিত জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের জোতির্বিদ্যার অধ্যাপক।
এই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল। যেটাকে বলা হয় মহাজাগতিক ধ্রুবক (কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট)। এটাকে আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি ভিত্তিপ্রস্তরের মতো। যদিও আইনস্টাইন পরে তার এই ধারণাকে একটি ‘বড় মাপের ভুল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এ থেকেই পরে পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক অনেক গবেষণা উৎসরিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৩ ভোর ৫:৪৬