শারীরিক এবং মানসিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণেই হয়তোবা আমার ঘ্রাণশক্তি কিছুটা হলেও প্রখর। হাজার লোকের ভিড়েও আমি আমার পরিচিত মানুষগুলোর গন্ধ চিনে তাদের আলাদা করে ফেলতে পারি। প্রতিটি মানুষই আমার কাছে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ হয়ে ধরা দেয়। এইসব অনেক গন্ধের মাঝে আমার প্রিয় গন্ধ হলো 'মা' 'মা' গন্ধ। যে গন্ধ না পেলে আমি একসময় পাগলের মত হয়ে যেতাম।
মনে পড়ে এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত আমি কোনদিন মা'কে ছেড়ে কোথাও থাকতে পারিনি। কারণ, যে বাড়িতে মায়ের গন্ধ নেই সেখানে আমার দম বন্ধ হয়ে যেত।
মা'কে জ্বালাতন করার আমার সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম ছিল খাবার। আমার কখন খিদে পেত কিংবা নিজের খাবারের পরিমাণ আমি নিজেও জানতামনা। সবটাই আমার মায়ের নখদর্পণে। এটা নয় ওটা, ওটা নয় এটা করলে মায়ের অগ্নিমূর্তি দর্শন করলেও পাতে ঠিকই পৌছে যেত কাঙ্ক্ষিত খাবার।
জুতোর ফিতে বাঁধতে পারতামনা(এখনও পারিনা)। কলেজ যাবার সময়েও তাই এই কাজটিও করে দিতেন আমার মা।
ঝাড়ু, চিরুনি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প বাসায় বোধহয় এমন কোন বস্তু ছিলনা যেটা দিয়ে মা আমাকে পেটাননি। সময় সময় মারের চোটে রক্তাক্ত হয়েছি তবু পরক্ষণেই ছুটে গিয়েছি মা'র কাছে।
ছোটবেলায় মা’র হাতের পাশে আমার হাত রেখে গায়ের রং মেলাতাম। মা’র ধবধবে ফর্সা হাতের পাশে কালো কুচকুচে একটা হাত। সময়ের সাথে আমার ফর্সা মায়ের গায়ের রং অনেক মলিন।
আর মা’র চুল? মা’র বিশাল চুল আঁচড়ে দেয়া ছিল ছোটবেলায় আমার একটি প্রিয় খেলা।
তবে আমার জন্য সবচেয়ে গর্বের ছিল মা’র হাতের লেখা। আমার খাতায় মা’র লেখার নমুনা দেখামাত্রই সকলকেই বলতে শুনেছি-‘এত্তো সুন্দর লেখা কার?’
গর্ব কিংবা ঔদ্ধত্য যথাসম্ভব ঢেকে বলতাম-‘আমার মা’র’।
নানু বাসায় গেলে শোকেস্ ভর্তি ট্রফি আর বই দেখিয়ে নানু বলতেন- দেখ্ এগুলো সব তোর মায়ের।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ট্যাগগুলো পড়তাম কোনটা বিতর্ক, কোনটা অভিনয়, কোনটা গান, কোনটা ব্যাডমিন্টন, ক্যারম, টেবিল টেনিস কিংবা কোনটা আবৃত্তির পুরস্কার।
আমার উচ্চশিক্ষিত ‘মা’ বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে বনে গেলেন পুরোদস্তুর ‘হাউজওয়াইফ’ এবং সেটা আমারই বদৌলতে।
ছেলেকে মানুষ করতে হবে। মানুষ কতটা হয়েছি তা জানিনা তবে মা’র গুণ কিংবা রূপের কিয়দংশও জোটেনি আমার কপালে।
আমার এই ‘মা’ গত ৬ মাস যাবত লড়ছেন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে।
ক্যান্সার যেন রোগ নয় একটা আস্ত দানব। দানবকে তাড়াতে অমানষিক লড়ছে মা। মা’র ফর্সা রং, ত্বকের লাবণ্য, মাথার চুল, তীব্র প্রাণশক্তি সব সেই দানবের গ্রাসে।
আমার খুব ছোট্ট পৃথিবীটাতে আমার 'মা' যেন খুব সুস্থভাবে আমার সাথে আরও অনেক অনেক অনেক বছর থাকতে পারে এর বেশি আর কিচ্ছু চাইনা আমি এই জীবনের কাছে, জীবনের স্রষ্টার কাছে।
আমার মা’র শরীরে বাসা বাঁধা কর্কটরোগ দেহের কোষ ছেড়ে যাক অন্য কোথাও।
বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী সকলের কাছে অনুরোধ আমার মা'র রোগমুক্তির জন্য একটুখানি প্রার্থনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ ভোর ৪:৫০