ট্রেনে কাঁটা মানুষ বীভৎস কয়েক পিণ্ড মাংস কেবল। আপনি একবার দেখবেন বা একবারও না হয়তো। প্রথমবার যখন আমি মানুষের কাঁটা মস্তক, বিচ্ছিন্ন উরু আর রক্তাক্ত বাহু দেখেছিলাম বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আচমকাই গলা দিয়ে হড়বড় করে বেরিয়ে আসে অম্লস্বাদ জল, অর্ধ হজমিত ভাত আর দলিত মথিত লাউয়ের ডগা, যেগুলো খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। সেদিন আর কাজে যাওয়া হয় নি আমার। ঘরে এসে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম শরীর উদাম করা গরমের মধ্যে। বউ দেখে অবাক হলো, বিরক্ত। তবে রুক্ষ গলার তিরস্কার কিংবা কটূক্তি শুনতে পেলাম না অন্য দিনের মতো। সে বিশ্বাস করে আমার মাথায় ছিট আছে একটু আধটু, যেটা মাঝে মাঝে প্রকট হয়। মেয়েটা শুধু মূর্খ আর নির্বোধই না, যথেষ্ট কুসংস্কার আচ্ছন্নও। যেটা আমাকে বিব্রত করে প্রায়শ, মাঝে মাঝে হতাশ কিংবা ক্রোধান্বিত। তবু আমরা এক ঘরে থাকি। খাই, ঘুমাই আর সঙ্গমে লিপ্ত হই রাত-বিরাতে। কেউ যদি প্রেমহীন সঙ্গম সম্পর্কে জানতে চান, আমি বলবো, এটা স্রেফ নিরানন্দের আর উচ্ছ্বাসহীন। বহুক্ষণ চেপে রাখা মুত্র ত্যাগের পর যে আনন্দ হয়, ভালোবাসারহিত সঙ্গম আর শুক্র ত্যাগ তার চেয়েও পুলকহীন।
আজকের লাশটা কোন মহিলার, তবে সে হতভাগ্য কিনা আমি নিশ্চিত না। লোকজন মাংস পিণ্ডগুলোর চারপাশে গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কোন মজমা, যেখানে সাপের খেলা দেখানো হচ্ছে আর একজন হ্যান্ডমাইকে পাইলস আর বাতের নিস্ফলে মূল্য ফেরত মহৌষধের মাহাত্ম্য বর্ণনা করছে।
ছোটবেলায় গ্রামের বাজারে হাটবারে বহু মজমা বসতো। কেউ সাধনার খাটি সালসা বিক্রি করতো, কেউ যৌনদণ্ডবর্ধক মালিশ অথবা দাউদের মলম, কেউ বউ বা শত্রু বশের তাবিজ। আমি বেশি যেতাম এক ঝাঁকড়া চুলের বাউলের মজমায়। অল্প বয়সী বাউল, রুগ্ন স্বাস্থ্য আর কালো লম্বা ঝাঁকড়া চুলো। চিকন গলায় মাথা আর কোমর দুলিয়ে গান করতো একতারা বাজাতে বাজাতে। আমার দেখা প্রথম অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র ছিল সেটা ঢোলের পর। একটা গান শেষ হলেই সে গাছের ছাল বাকল আর সাপের তেল দিয়ে নিজের হাতে বানানো ওষুধের গুণগান শুরু করতো। দশ টাকা দামের ওষুধ কমতে কমতে দুই টাকায় নামতো একসময়, তবু লোকজন কিনতে চাইতো না। ওষুধ বিক্রি শুরু হলে ভিড় আস্তে আস্তে কমতে শুরু করতো। তরুন বাউলের হতাশ মুখ ব্যথিত করতো আমাকে। আমিও অন্যদের মতো সরে আসতাম সেখান থেকে সন্তর্পণে।
একটু দূরেই বসতো গোপন রোগের ওষুধ আর শক্তিবর্ধক সিরাপের মজমা। যার প্রতি ফাইলের দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা, অপেক্ষাকৃত চড়া, তবু বিক্রি হতো দেদার। সেখানে ছোট স্পিকারে মমতাজ কিংবা কনকচাঁপার চটুল বাংলা গান বাজতো, সাথে নাচতো মেয়েলি শরীর আর চেহারার একজোড়া হিজড়া। যাদের একজনের শরীরে থাকতো আঁটসাঁট সালোয়ার আর পাতলা কামিজ, যার বুকটা অস্বাভাবিক স্ফীত। ওই অস্বাভাবিক বুকের মালিক নাচের মধ্যে অযথাই বুকটা দর্শকের মুখের দিকে ঠেলে দিতো। তাতে স্ফীত বুক আরো স্পষ্ট হতো। আমার ক্ষুদ্র চোখে মনে হতো ছোটখাটো খাঁড়া খাঁজবিহীন পাহাড়, নরমই সম্ভবত। এদের উত্তেজক-অনান্দনিক নৃত্য বা অশ্লাঘ্য অঙ্গভঙ্গি শেষ হলে ওষুধ বিক্রেতা একটা প্ল্যাস্টিকের ফটো এ্যালবাম বের করতো, যেটা ছিল বেশ মোটা, ছাতায় ভরা আর অতি ব্যবহারে জীর্ণ। মজমার এই পর্যায়ে স্থূল এবং খাটো, পুরনো কোট পরা, যেটার ভঙ্গুর বোতাম খুলে ভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চাইতো, লোকটা মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলতো বাচ্চা ছেলেপেলে সব মজমা থেকে বের হও। পাঁচ মিনিট পর যদি কম বয়সী কাউকে দেখা যায়, তাকে ঐ দুধবড় হিজড়ার কোলে বসিয়ে দেয়া হবে, ঐ দুধের পাহাড় বাইতে হবে তাকে। মজমা জুড়ে ফুল্ল হাসির ফুলকি ছুটতো লোকটার অশ্লীল ভঙ্গি আর আদি রসাত্মক কথায়। আমরা একবার দুধের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার আর সাহস করতাম না। বিরস বদনে বেরিয়ে যেতাম একরাশ কৌতূহল আর ভাঙা অথচ অদৃশ্যমান বা অস্ফীত বুক নিয়ে। কিন্তু নিষিদ্ধের প্রতি অন্তহীন আগ্রহ আমাকে আবার ঐ মজমায় ফিরিয়ে আনতো, আমি সাবধানে ঠেলেঠুলে জটলার ভেতর ঢুকে জায়গা করে নিতাম। দু'একজন দেখে খেকিয়ে উঠতো, তবে বের করে দিতো না। হয়তো তারা আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত নষ্ট করতে চাইতো না।
মাইক বন্ধ এখন। লোকটা হালকা উচ্চগ্রামে খালি গলায় কথা বলছে আর হাতে ধরা ফটো এ্যালবামের পাতা উল্টে উল্টে দর্শকদের দেখাচ্ছে। যার প্রতি পাতায় অল্প বয়সী বা মাঝ বয়সী নর-নারীর নগ্ন রঙিন ছবি। উন্মুক্ত বেঢপ আকৃতির ঝুলে পড়া স্তন আর পাখির বাসায় ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহামুখ অথবা রসহীন আগাছাপূর্ণ চিমসা ইক্ষু দণ্ড। সবই রোগাক্রান্ত, ক্ষত বিক্ষত আর ঘায়ে ভরা, কুৎসিত। আমি মজমা থেকে বেরিয়ে আসতাম, বিশ্রী-জরাগ্রস্ত- ঘায়েপূর্ণ যৌনাঙ্গ দেখার কোন মানে নাই। মেয়েদের যৌনাঙ্গ এই স্থুল-নোংরা লোকটার ফটো এ্যালবামে গচ্ছিত ছবিগুলোর চেয়ে শত গুন আকর্ষণীয়, মনোহর। অসুস্থ যৌনাঙ্গের কাছে না গিয়ে কুস্বাদ নিমের ডাল চোষাও আনন্দের।
অথচ আজকের সকালটা ছিল দারুন। যেখানে লোকগুলো মজমার মতো দাড়িয়ে একটা মহিলার বিক্ষত মাংস পিণ্ড দেখছে, সেখানে কোন রক্ত বা নিষ্প্রাণ দেহের অস্তিত্ব ছিল না। কিছু ছেলে মার্বেল খেলছিল। রোদের আলিঙ্গনে চিকচিক করছিল বালি। বাতাসে যদিও নর্দমার পচা গন্ধ ভাসছিল, তবে সেটা অসহনীয় ছিল না। পরিচিত তেতুল গাছটার নিচে ছড়িয়ে ছিল পাতলা চিরচিরে নরম পাতারা। সুবাসহীন লাল জবা দুলছিল মৃদু বাতাসে। নিঃশেষিত সিগারেটের পোড়া টুকরো আর ঘোলাটে বীর্যপূর্ণ পিঁপড়া আক্রান্ত ব্যবহৃত কনডম পড়ে ছিল রেল লাইনের পাশে। অথচ এখন সেখানে কেবল কিছু কুঁচকানো মাংস পিন্ড ভিজা বালুতে ছড়িয়ে আছে সব সজীবতা হারিয়ে আর মাথায় ঝিম ধরানো জমাট গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। বাকী সব দৃশ্য বা গন্ধ হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে। চারপাশের অস্বাভাবিক নিরবতা আর মানুষের ভয়ার্ত মুখ কিছু সময়ের জন্য হলেও আল্লাহর অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে যেন।
আমি প্রয়াতদের সাথে দেখা করতে পছন্দ করি। মৃতদের ভাষা আমাকে মোহিত করে। আমি অপলক তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আর তারা কি বলতে চায় বোঝার চেষ্টা করি। আমি কোন মন্দ মৃত মানুষ দেখি নি কখনো। মৃতরা হয় সহৃদয়-মহানুভব-জ্ঞানী আর সৎ উপদেশদাতা। তাদের পরামর্শ আমাকে শান্তি দেয়। তারা বলে কিভাবে প্রচণ্ড ঝড়ে উত্তাল, বিক্ষুব্ধ নদী একলা পাড়ি দিতে হয়। তারা শেখাতে চায় প্রেম, যদিও আমি প্রেমিক নই। তারা শোনায় গভীর দর্শনের কথা, কিন্তু আমার আগ্রহ ইতিহাসে। তারা বলে মরে যাও অথচ আমি তা চাই না বেশিরভাগ সময়। এতো জটিলতা কিংবা বৈপরীত্য সত্ত্বেও আমি তাদের পছন্দ করি, তাদের কাছে যাই আর প্রশান্তি অনুভব করি।
ক্লান্ত-বিক্ষিপ্ত মন আর শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকে বুঝতে পারি মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথায় টনটন করছে। আমি আমার স্ত্রীকে ডাকলাম, বহুক্ষণ পেরিয়ে গেলো, কোন সাড়া পেলাম না কারো। আমি তাকে খুঁজতে উদ্যত হলাম, কিন্তু তার ছায়াও নেই কোথাও, এমনকি গন্ধও না। সহসাই আমার মনে পড়লো রেল লাইনের পাশে যে কাঁটা লাশটা পড়ে ছিল, কোন মহিলার, তার মুখ আমি দেখি নি। অথচ সচরাচর এমন ঘটে না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ রাত ৯:৫৩