বাসটা ঝা চকচকে নতুন ।মসৃণ রাস্তা বাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি ।শাঁই-শাঁই করে পেছনে চলে যাচ্ছে গাছ-পালা ,বাড়ী-ঘর ,ফসলের ক্ষেত ।
সচরাচর জানালার পাশেই থাকে আমার সিট ।আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি ।কানে হেডফোন ,তাতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে ,যেন অমৃতসুধা ।জানালার বাইরে নয়ন জুড়ানো সব দৃশ্য ,একের পর এক হাজির হচ্ছে ,আবার মিলিয়ে যাচ্ছে পরমুহূর্তেই ।বিশাল সবুজ এক সিনেমার পর্দা যেন ।
প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো আমাদের বাসটা ছুটছে অবিরাম ।বাইরের দৃশ্য একঘেয়ে মনে হলো ,চোখে ক্লান্তি ,ঘাড় ফেরালাম বাসের ভেতরটায় ।মার্সিডিজ বেঞ্চের বিলাসবহুল লাক্সারী বাস ।বিলাসের বাহুল্য চোখে পরে সর্বত্র ।আয়েশে অনেকেরই চোখ-মুখ মুদে আছে ।দু'এক জন পত্রিকা পড়ছে ,কেউ কেউ বই ,বেশিরভাগই হাই তুলছে ।গাইড ছেলেটা ছুটোছুটি করছে পুরো বাস জুড়ে ।খুব স্মার্ট আর শিক্ষিত মনে হচ্ছে ছেলেটাকে ।ইশারা করতেই চলে এলো ।খুবই মার্জিত ব্যবহার ,মুগ্ধ হওয়ার মতো ,সবই অর্থের বিনিময়ে ,তবু ভালো লাগে ।বাংলাদেশীদের মাথায়ও যে সেবা ব্যাপারটা ঢুকেছে ভেবে হাসি পেলো ।পলিসিটা খারাপ না ,কাজে দেয় খুব ।ছেলেটাকে কয়েকটা ম্যাগাজিন এনে দিতে বললাম ।
আবার চোখ রাখলাম জানালার বাইরে ,সেই চিরচেনা বারবার দেখা ছবি ,তবু ভালো লাগে ।বিশাল সবুজ ,তার মাঝে চোখে পরে দু একটা ধূসর ভগ্নপ্রায় কুঁড়ে ঘর ।দূর থেকে ঘরগুলি অদ্ভুত সুন্দর দেখতে ,কিন্তু এর বাসিন্দাদের জন্য এই সৌন্দর্য কেবলই পরিহাস ।
ছোট ছোট পুকুর ,তাতে ফ্যাকাসে সবুজ রঙের শ্যাওলা জমা পানি ।হঠাৎই চোখে পরে গবাদি পশুর পাল ,চড়ে বেড়াচ্ছে বিরাণ বিল জুড়ে ।একটা দৃশ্য অবাক করার মতো ,আশা জাগানিয়াও ,গেরস্থ ঘরের মেয়েরা কাজ করছে মাঠে ।ফসল বুনছে ,মাটি নিড়াচ্ছে ,ফসল তুলছে ।
দারিদ্রতা অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্রোহী করে তোলে মানুষকে ।সামাজিক প্রথা ,ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে দেখায় বুড়ো আঙ্গুল ।অবশ্য ওদের নিয়ে কেউ ভাবেও না খুব ।গরিব কৃষকের যুবতী বৌ ছেড়া কাপড়ে গিঁট দিয়ে উবু হয়ে কাজ করছে ক্ষেতে ,স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুষ্ট স্তন-চকচকে গ্রিবা অথবা মাংসল নিতম্ব ,শরীরের উচু-নিচু ভাজ ,সবাই আড় চোখে দেখে যায় ।কারো মধ্যে তেমন ভাবান্তর ঘটে না ,যেন এগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত ।যত অভিযোগ কেবল মধ্যবিত্তের বেলায় ।
এই মুহূর্তে বাসটা ছুটছে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ।পলকে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে ।
এলাকাটা পুরোপুরি নির্জন ।রাস্তার দু ধারে শুধুই ধু ধু বিল ।ফসল কাঁটা শেষ ,এখনো নতুন কিছু চাষ শুরু হয় নি ।খাঁ খাঁ করছে বিশাল বিলগুলো ।
গাইড ছেলেটাকে আসতে দেখলাম ,হাতে কয়েকটা পুরনো ম্যাগাজিন ।হাত বাড়ালাম ওগুলো নেয়ার জন্য ,আচমকাই প্রচণ্ড শব্দ আর তীব্র ঝাকুনি টের পেলাম ।কিছু বুঝে ওঠার আগেই শূন্যে ভাসলাম ।সম্মিলিত কণ্ঠের ভয়াবহ আর্তনাদ আমার কর্ণবিবর স্তব্ধ করে দিলো ।পুরো ব্যাপারটা ঘটলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ।
কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় অনুভূতি লোপ পেয়েছিল পুরোপুরি ,বুঝতে পারছিলাম না বেঁচে আছি নাকি নেই ।যখন সম্বিৎ ফিরল ,সীমাহীন বিস্ময়ে খেয়াল করলাম সারা শরীরের কোথাও তেমন কিছুই হয় নি ,কেবল জানালার কাচে হাতটা সামান্য কেটে গেছে ,কপালও খানিকটা ।রক্ত ঝরছিল তবে তা ভয় পাওয়ার মতো না ।আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ,নিশ্চিন্ত হলাম সব ঠিক আছে ,আমি বেঁচে গেছি ।নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার আনন্দে হিতাহিত জ্ঞান হারালাম আমি ,কয়েক সেকেন্ড উন্মাদের মতো এদিক ওদিক ছুটোছুটি করলাম ।
বাসটা যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তীব্র গতিতে ধাক্কা খায় রাস্তার পাশের প্রকাণ্ড কড়ই গাছের সঙ্গে ,প্রচণ্ড ঝাকুনিতে আমি জানালার কাচ ভেদ করে বাইরে আছড়ে পড়ি ,নরম ঘাসের উপর ।সাথে সাথেই বিশাল বিলাসবহুল বাসটা কয়েক পাক উলটে স্থির হয় রাস্তা থেকে সাত আট ফুট নিচের খাঁদে ।তখন আর চেনা যাচ্ছে না বাসটাকে ,দুমড়ে মুচড়ে ভয়ংকর আকৃতি নিয়েছে ওটা ।
হঠাৎই হুশ ফিরে পেলাম ,হৃদয়বিদারক - মর্মস্পর্শী চিৎকার অথবা আর্তনাদ আমাকে হকচকিয়ে দিলো ।অকল্পনীয় -বীভৎস -করুন এক দৃশ্য ,সারা শরীর কেঁপে উঠলো ।এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ ,রক্তাক্ত- বীভৎস ,বেশিরভাগই প্রাণহীন ।যাদের প্রাণবায়ু তখনও আছে বাঁচার সকরুণ অসহায় আর্তি ঝরে পড়ছে তাদের গলা থেকে ,তবে ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে তাদের গলা ।
আমি তখন হতবিহবল -কিংকর্তব্যবিমূঢ় ,মাথাটা গুলিয়ে আসছে ,আচমকা গর গর করে সব উগড়ে দিলাম মুখ দিয়ে ।
মাথাটা হালকা হতেই উঠে দাঁড়ালাম আবার ,ঘাড় ফেরাতেই চোখ আটকে গেলো একজনের উপর ।আমার পাশের সিটেই ছিল মেয়েটা ।একটু আগেও ওকে খুব মনোরম আর কমনীয় মনে হচ্ছিল ,অথচ এখন চেনাই যাচ্ছে না ,মুখটা বিশ্রীভাবে থেঁতলানো ,ভাঙ্গা মাথা থেকে বিদঘুটে তরল মগজ গড়িয়ে পড়ছে সবুজ ঘাসের উপর ,চোখদুটো বিস্ফোরিত ।দ্বিতীয়বার আর তাকাতে পারলাম না ওদিকে ,আমার চোখ নামলো আর একটু নিচে ,গলা থেকে বুক অবধি ,নিরেট ডায়মন্ডের একটা হার চকচক করছে সূর্যের আলোয় ।আমার চোখ দুটোও চকচক করে উঠলো ।দু তিন সেকেন্ড মাত্র ভাবলাম ,বিবেকটা হার মানলো প্রবৃত্তির কাছে ,হ্যাঁচকা টানে হারটা খুলে নিলাম ।কানগুলো ছিড়ে বের করলাম আরো কিছু দামী অলংকার ।ততক্ষণে আমি বদ্ধ উন্মাদ ।চারপাশে অজস্র সম্পদ ,ব্যাগ ভর্তি টাকা ,শরীর ভর্তি গয়না ,পড়ে আছে অবহেলায় ,বাধা দেয়ার কেউ নেই ।আমার ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা ভরে গেলো খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ।
একটা ব্রিফকেস দেখলাম পড়ে আছে একটু দূরে ,ভারী মনে হলো ,কয়েকবার চেষ্টা করেও খুলতে না পেরে ফেলে দিলাম ।পরমুহূর্তে কি ভেবে আবার গেলাম ওটার কাছে ।কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই এবার খুলে গেলো ।চরম আনন্দ আর বিস্ময়ে আমার হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো ,পুরো ব্রিফকেস ভর্তি অগুনতি চারকোণা সোনার বার ,থরে থরে সাজানো ।তাড়াতাড়ি ব্রিফকেসের ডালাটা বন্ধ করে দিলাম ।
ব্রিফকেস আর টাকা-গয়না ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে উঠে এলাম রাস্তায় ।পিছনে পড়ে থাকলো হতভাগ্যরা আর তাদের করুন আর্তনাদ ,চাপা অথবা নির্জীব ।
পরিশ্রম আর উত্তেজনায় পুরো শরীর ঘামে ভিজে জপ-জপ ।তখনও সবকিছু অবাস্তব আর কল্পনা মনে হচ্ছিল ।অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে আছি যেন ।দুর্ঘটনার পর কয়েক মিনিট মাত্র কেটেছে ,অথচ মনে হচ্ছে সময়টা স্থির হয়ে আছে ।হঠাৎই দেখতে পেলাম একটা একটা গাড়ী আসছে নির্জন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ।চিৎকার করতে লাগলাম ,হাত নাড়লাম ।ট্যাক্সিটা থামলো একদম আমার সামনে এসে ।তখনও আহতরা আর্তনাদ করছে ,ট্যাক্সি ড্রাইভারের বুঝতে কষ্ট হলো না কি ঘটেছে ।আমি সংক্ষেপে বললাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় এবং হসপিটালে খবর দিতে হবে ,বলেই লাফিয়ে উঠে বসলাম ট্যাক্সিতে ।ড্রাইভার বিনা বাক্যে গাড়ী ছুটালো ।সে খুবই অবাক হয়েছে আমাকে প্রায় সুস্থ অবস্থায় দেখে ।বারবার আমার ভাগ্যের প্রশংসা করতে লাগলো ।
আমি শেষবারের মতো পেছনে তাকালাম ,ততক্ষণে কয়েকটা গাড়ী এসে জড়ো হয়েছে দুর্ঘটনাস্থলে ।মানুষ ছুটে যাচ্ছে অকুলস্থলে ,সাহায্য করতে ,হয়তবা আমার মতো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে ।এখন আমাকে কেউ অপদার্থ-অথর্ব বেকার বলে না ,যে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতো এদিক-ওদিক ।বিলাসবহুল গাড়িতে প্রথম ভ্রমণ যাকে বিলাসবহুল জীবন দিয়েছে ।আমার আচমকা এমন বদলে যাওয়া সবাইকে অবাক করেছে ,এটা বলাই বাহুল্য ।তবে রহস্যটা গোপনই আছে এখন পর্যন্ত ।কেউই জানে না সেই ভয়ংকর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার গল্প ।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয় ।মনে হচ্ছে ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে আমার জন্য ।জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত ।মেয়েটা আঠার মতো আমার পিছে লেগে আছে ,বাড়িতে- গাড়িতে -অফিসে ,সবখানেই হানা দিচ্ছে ও ।কিন্তু আমিতো পুরনো স্মৃতি মনে করতে চাই না ,ভুলতে চাই অবিবেচক নির্বোধ মেয়েটাকে ।
দিনে দিনে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে আমার ,খেতে পারি না ,ঘুমাতেও না ।ঘুমের মধ্যেও হানা দেয় মেয়েটা বীভৎস মূর্তি নিয়ে ।চিৎকার করতে করতে ঘুম ভাঙ্গে আমার ।
থেঁতলানো মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ছে তপ্ত মগজ ,নিস্প্রান চোখ দুটো চেয়ে আছে শূন্যে ,গলায় লেপটে থাকা ডায়মন্ডের হারটা জ্বলজ্বল করছে দিবাকরের উজ্জ্বল আলোয় ।ছো মেরে হারটা নিতে হাত বাড়ালাম আমি ,পলকেই চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে উঠলো মেয়েটার ,রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন হাত দুটো তীব্র গতিতে ছুটে এলো আমার দিকে ,সজোরে চেপে ধরলো আমার গলা ।নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমশ ,চাপ বাড়ছে অনবরত ,ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি আমি ,সীমাহীন শূন্যতা ঘিরে ফেলছে আমাকে ...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৪৮