বাবা যেদিন বিয়ে করলেন, আমি বোধহয় সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম আমাদের ঘরের পাশের বহু বছরের পুরনো আর জৌলুশ হারানো সিনেমা হলে । বিকিনি পরা শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী আর সুঠাম দেহের দীর্ঘকায় কৃষ্ণাঙ্গ নায়কের সৈকতে জলকেলিরত রঙিন পোস্টারে ছেয়ে ছিল পুরো হলের ভেতর-বাহির । প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি ইংলিশ মুভি চলছিল সেদিন, যদিও আমি প্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম না । আমার তখন প্রিয় ছিল জুমাঞ্জি, উডি উড পেকার, গোস্ট মাস্টার, আরও সব বিদেশী কার্টুন ।
সকাল থেকেই গুমোট ভাব পুরো বাসা জুড়ে, বাবা কয়েকদিন বাসায় নেই । বাবা সাধারণত বাসার বাইরে থাকেন না, মায়ের মৃত্যুর পর আমরা দেখি নি তাকে আমাদের ছাড়া রাত কাটাতে । তবু সবই ঠিকঠাক চলছিলো প্রতিদিনের মতো, একা একা স্কুলে যাওয়া, বুয়ার হাতের অখাদ্য রান্না, প্রাইভেট টিউটরের অপত্য স্নেহ অথবা গ্রিলের ওপাশে চড়ুই যুগলের ভাবনাহীন উড়াউড়ি, সব ।
বসন্ত তখন, কোথাও কোন দুঃখ নেই, যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, অস্থিরতা নেই প্রকৃতিতে । রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়াগুলো ভরে গেছে রক্তিম ফুলে । লালপুচ্ছ বুলবুলির ছন্দপূর্ণ ডাক আর মখমলের মতো মোলায়েম রোদ, ব্যথাহীন পরশ হাওয়ার অথবা পূর্ণপ্রান প্রকৃতির শুভ্র ছোঁয়া যেন ঢেকে দিয়েছে পৃথিবীর সব অসুখ, দৃশ্যমান অথবা গোপন সব ক্ষত মানুষের । কারো চোখে মুখে কোন রেখা নেই কষ্ট বা বিরক্তির, অন্তত গ্রীষ্মের রোদে ঘামতে ঘামতেও যেটা ফুটে উঠে অজানতেই । বসন্ত এমনি, সব রঙ ঢেকে দেয় অনিবার্য লালের প্রলেপে ।
বিকেলগুলো এইসব দিনে কেবল নানির কথা মনে করিয়ে দেয়, নানির কোলে মাথা রেখে পুরোটা বছরই বসন্তের অনুভূতি পাওয়া যেতো ।
আমাদের মা কেমন ছিলেন ! এক কথায় মাকে নিয়ে মধুর স্মৃতি বেশি মনে পড়ে না আমার । তিনি ছিলেন ঝগড়াটে, স্বার্থপর আর সংকীর্ণমনা মহিলা । বাবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতে আমি খুব কমই দেখেছি, তারা অনবরত ঝগড়া করতো, মাঝেমাঝে মারামারিও ।
আমাদের ঘরে ভালোবাসা ছিল না বিন্দুমাত্র, বাবাকে ঘৃণা করতেন মা, আমাদেরও ভালোবাসতেন না । তিনি ভালোবাসতেন দূরসম্পর্কের এক মামাকে । মায়ের এই মামা আমাদের বাসায় আসতেন মাঝে মাঝে । মা তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতো, তাকে খাবার তুলে খাওয়াত । লোকটা ছিল বিভীষিকা, অসহনীয় । আমরা ঐ সময়টায় বাসায় থাকতাম না, বেড়িয়ে যেতাম ফুটবল অথবা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ।
মা আচমকাই একদিন মারা গেলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, যদিও বিষয়টা বহুদিন আমাদের অজানা ছিল । মায়ের মৃত্যুতে কাউকে শোক করতে দেখি নি, বাবাতো নয়ই, এমনকি সেই মামাও না, সে বোধহয় হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো । আমরাও কাঁদি নি, কান্না আসে নি । আমাদের বোধহয় কাঁদা উচিত ছিল !
মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের বাসাটা পাল্টে গেলো, অগোছালো-শুষ্ক-গন্ধহীন, নির্জন আর শান্ত । আত্মীয়-স্বজন বা লোকজনের আনাগোনা কমে গেলো আস্তে আস্তে । আমি হট্টগোল পছন্দ করতাম না, বিশেষত সেসব আলোচনা পূর্ণ থাকতো নিন্দা-গালি-ষড়যন্ত্র আর আত্মচর্চায় ।
মা মারা গেলেন আর আমি চমৎকার একটা ঘর পেলাম, সারাদিন টেলিভিশনে কার্টুন দেখতাম, গোয়েন্দা গল্প পড়তাম অথবা মামার দেয়া জার্মান দূরবীন দিয়ে পাশের বাসার মেয়েটাকে দেখতাম । মেয়েটার বয়স আর শরীরের তুলনায় স্তন যুগল ছিল অতিকায় । সে দিনের অনেকটা সময় ওগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে পরখ করতো, স্পষ্টতই সে তার উন্নত বুক নিয়ে চাপা অহং অনুভব করতো ।
এই মেয়েটা একদিন আমাদের বাসায় এসেছিল, আমি বেশ ভীতি অনুভব করেছিলাম কৃতকর্মের কথা ভেবে । সেদিন বাসায় কেউ ছিল না, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার বিশাল স্তন যুগলের চাপে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, আমি ভয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই ।
মেয়েটা আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিল । ঐদিনের পর আর কখনোই আমি সেই অস্বাভাবিক স্ফীত স্তন দেখার সুযোগ পাই নি, মেয়েটা তার ঘরের পর্দা নামিয়ে দিয়েছিল ।
বাবা নিজ ইচ্ছাতেই মাকে বিয়ে করেছিলেন, একটা এনজিওতে কাজ করতেন তখন, সুদর্শন আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি । সংস্থার কাজে দিন-রাত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো তাকে । এমনই একদিন মায়ের সঙ্গে দেখা তার, মায়ের অস্বাভাবিক সৌন্দর্য তাকে আপ্লুত করে, সম্মোহিত করে । বাবা এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান কাউকে না জানিয়েই এবং বিয়েও করে ফেলেন । তারা প্রায় ষোল বছর এক ঘরে ছিলেন, এবং তারা ছিলেন চূড়ান্ত রকম অসুখী । অবর্ণনীয় উৎকট আর অপ্রীতিকর ছিল তাদের পুরো দাম্পত্য জীবন ।
মায়ের কবরটা এখন ঘন জঙ্গলে পরিনত হয়েছে, পারিবারিক কবরস্থানের এক প্রান্তে চিহ্নহীন পড়ে আছে । লতাপাতা আর গুল্ম সরিয়ে মাঝে মাঝে কবরটা ছুঁই আমি, বাতাসে ভাসে শুষ্ক বেলে মাটি, ডেকে ওঠে ডাহুক, উড়ে যায় প্রজাপতি । ডানা জাপটানোর শব্দ শোনা যায় নীড়ে ফেরা পাখিদের । গোধূলির শেষ আলো এসে পড়ে গায়ে আর ক্রমশ অন্ধকার গ্রাস করতে থাকে চারপাশ ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪৯