আমার মতো যারা সত্তর দশেকের শেষ থেকে শুরু করে নব্বই দশকের মাঝামাঝির মধ্যে জন্মেছে এবং পারিবারিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার শিক্ষা পায়নি তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা শব্দটিকে ভাল না বেসে অনেকটা অবহেলা করতে শিখেছে। মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জাতির জন্য কত আবেগের তা তারা বুঝতে পারেনি। তাদের বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জেনেছে যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রেফতারকৃত হয়ে পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ শাসন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য বাকশাল গঠন করেছিলেন। আমার মতোই এই প্রজন্মটি জেনে এসেছে যে বঙ্গবন্ধুর ছেলেরা হেন কোন খারাপ কাজ নেই যা করেনি এবং বঙ্গবন্ধু তা প্রশ্রয় দিয়েছেন, এর মধ্যে অন্যতম ছিল শেখ কামাল কর্তৃক মেজর ডালিমের বউ অপহরণ। মুজিব পরিবার নিয়ে এরকম পুরোপুরি সত্য-বিবর্জিত অনেক গুজব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে।
শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যে দীর্ঘ ইতিহাস তা আমরা জানিনি। এমনকি ৭ মার্চের ভাষণ, যা শুনলে ইতিহাস-না-জানা আমারও রক্ত প্রবাহ দ্রুততর হতো, কেবল বিশেষ দিবসগুলোতে একমাত্র আওয়ামী লীগের অফিসগুলোতেই মাইকে বাজানো হতো। আমাদের পাঠ্য বইয়ে শেখ মুজিব একেবারেই অনুপস্থিত ছিলেন, সাত বীরশ্রেষ্ঠর জীবনীই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা। তারপরও ঐটুকুও বারবার পড়তাম। মতিউর রহমানের উড়োজাহাজ নিয়ে বাংলাদেশে আসার প্রচেষ্টা নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম! দেখতাম মতিউর রহমান উড়োজাহাজ নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন; তারপর পাকিস্তানীদের সাথে উড়োজাহাজ যুদ্ধ করছেন। মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর আরো দুটো দিন বেঁচে থেকে বিজয় দেখতে পারলেন না বলে কী যে কষ্ট হতো! স্বপ্ন দেখতাম মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর আরো দুটো দিন বেঁচে আছেন এবং পতাকা ও রাইফেল হাতে বিজয়োৎসব করছেন। এমনসব স্বপ্ন দেখতে কী যে ভাল লাগতো!
ওটুকুই সব। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিকভাবে যেমন মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা পাইনি, তেমনি শিক্ষার জন্য আমাদের ছিল না কোন শিক্ষানীতি, যা আমাদেরকে একটি উদ্দেশ্যহীন শিক্ষায় (কু)শিক্ষিত করেছে। আমাদের শিক্ষাকে একেবারে উদ্দেশ্যহীন বলাও যুক্তিসংগত হবে না। যে উদ্দেশ্যহীন শিক্ষা আমরা পেয়েছি তা আমাদেরকে উদ্দেশ্যহীন করলেও তখনকার রাজনীতিক/রাষ্ট্রনায়কদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য খুবই উপযুক্ত ছিল। বারবার শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে, সুপারিশ এসেছে কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি; কারণ তা রাষ্ট্রনায়কদের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে না। এর ফল হয়েছে যে আমরা শিক্ষিত হয়েছি কিন্তু আলোকিত হয়নি, উল্টো ক্রম-অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছি। আমাদের সুন্দর ও সুদীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকেও শিক্ষার সংকটে আমরা দেশপ্রেমিক হতে পারিনি; ক্রমাগত দেশপ্রেম হারিয়ে দেউলিয়া হয়েছি।
দেশপ্রেমে দেউলিয়া ও অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি প্রজন্মকে কাজে লাগিয়েছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যখন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের হিসেবে ব্যস্ত তখন এই পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে গোপন এজেণ্ডা বাস্তবায়নে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করেছে। তারই ফল আজকের এই জামাত শিবির।
যদিও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনরূপ সংশোধন হয়নি, হয়নি শিক্ষাব্যবস্থারও তেমন পরিবর্তন, তারপরও অনলাইনে তথ্যের অবাধ প্রবাহই আজকের তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইতিহাসের তেমন কিছু না জেনেও আমার মতো যারা মতিউর বা মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতো তারাও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, আমাদের আগের প্রজন্মের যারা এতদিন রাজনৈতিক দৈন্যতার চিত্র দেখতে দেখতে স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়েছিল তারাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতেও দেরী হবে না। প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন দিয়েই হোক একটি সুস্থ সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নের যাত্রা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমার মতোই স্বপ্ন দেখুক, "আহঃ রাজীব-শান্তরা যদি আর কটা দিন বেঁচে থাকতো, তাহলে একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে পারতো!"