ইকোনমিক্সে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমদিন ক্লাসে আমরা সবাই আবিষ্কার করলাম ৮/১০ জনের থেকে আলাদা এক হুজুর ছেলেকে, সে কথা বলিতো(বলতো)সাধু ভাষায়, এবং খানিকটা চিকন কণ্ঠস্বর করিয়া(করে)প্রথম দিনই আমাদের সবাইকে সে বলল, “এই তোমরা কিন্তু ইকোনমিক্সকে সহজ ভাবিও না, ইহা অত্যন্ত কঠিনতর বিষয়, আমাদের আজিকেই প্রথম বর্ষের সকল পুস্তক কিনিতে হইবে এবং যার যার নিজ বাসায় ফিরিয়াই তাহা পাঠ করিতে বদ্ধ পরিকর থাকিতে হইবে” তারপর আরো আরো কথা, স্বাভাবিক ভাবেই এর বন্ধু কারোই হওয়ার কথা নয়, আমি অতিরিক্ত মিশুক সত্ত্বেও তার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতেও বিরক্ত অনুভব করতাম সে আমার নাম ধরে ডাকলেই আমার গা জ্বলে যেত।
সে এমনি এক ছোট ছোট ক- গাছা দাড়িওয়ালা খানিকটা ময়লা পাজামা পাঞ্জাবী পড়া বিরক্ত উৎপাদনকারী ছেলে যে সে নিজেও বুঝতে পারতোনা এর কথাবার্তা আমরা একদম পছন্দ করতে পারছিনা, সে তার বিরক্ত উৎপাদনকারী কথাবার্তা চালিয়ে যেতেই থাকতো এমনকি ক্লাস চলাকালীন সময়ে সে টিচারদের লেকচার থামিয়ে এটা ওটা খুঁটিনাটি নানা বিষয় জানবার জন্য একটার পর একটা উৎসুক প্রশ্ন করে আমাদের সবাইকে মানসিক টর্চারে রাখতো, আলফ্রেড মার্শালের চাহিদা আর যোগান রেখার সামান্য ব্যাখ্যা নিয়া ঘাটাঘাটি, মালথাসীয় তত্ত্ব, প্রান্তিক আয় ব্যয়,বাজার ভারসাম্য, মুনাফা, জাতীয় চাহিদা নীট/গ্রস, যোগান তত্ত্ব, অন্তরীকরণ সূত্র, উৎপাদন/আয়/মুদ্রাস্ফীতি/,উপযোগিতা, ক্রমবাচক উপযোগিতা, প্যারেটোর মানদন্ড, চাহিদার মুল্যগত স্থিতিস্থাপকতা, ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম ইত্যাদি এমন কোন টপিক নাই যার ভেতর সে নাক গলাতো না, ৫০ মিনিটের ক্লাস তার জানবার এবং জানাবার বাসনায় এবং স্যারদের বোঝানোর অতি মাত্রার আগ্রহতে ৭০/৮০ এমনকি একশো মিনিটে গড়াতো।
যখন একদম ধৈর্যের শেষ সীমানায় পৌঁছে যেতাম সবাই, তখন স্যার ওকে থামিয়ে দিয়ে ক্লাস শেষ করতো। এমন ছেলের জন্য কারো সমবেদনা কিংবা সাহায্য করার মানসিকতা থাকা উচিত না। দিনের পর দিন ক্লাস লম্বা করে (বেহুদা সহজ জিনিস মাথায় ঢুকত না এমন খারাপ ব্রেন) আমাদের জীবনটা তামা তামা করে দিয়েছিল সে।
প্রথমবর্ষ ফাইনাল(বোর্ড)পরীক্ষায় সে প্রথম হল, আমরা ওর দিকে সরু চোখে তাকাতে লাগলাম স্যাররা ওকে বাহবা দিতে লাগলো এবং ওলিউল্লা, তাসনিম, বাশার, মিম, সেলিম, শিশির, রাসেল, মাহমুদ, এমন কি নাক সিটকানো সুমি, চরম ঢঙ্গী আর স্টাইলিশ মেয়ে লিপিও ওর মোটামুটি ফ্রেন্ড হয়ে গেলো। নাসরিন হয় নাই, কারন হুজুর ছেলে তার একদম অপছন্দের আর ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে অনেকের সাথেই তার প্রেম সে ওইগুলা নিয়েই বেশি বিজি থাকতো, রোম্যান্টিক গার্ল সে।
তাছাড়া নাসরিনের পরীক্ষায় পাশ করার জন্য আমিই ওর জীবনে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান, রোল নং একসাথে হওয়ায় আমার পাশে ওর চিরকালের সিট। ও নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায় একের পর এক প্রেম করে যেতে লাগলো, ক্লাসের কোন ব্যাপারেই ওর মাথা ব্যথা নেই।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে, চলে এলো শেষ বর্ষ (ফাইনাল বোর্ড পরীক্ষা) আমাদের ইউনিভারসিটি থেকে অনেক দূরে পরীক্ষা কেন্দ্র। আমি আর নাসরিন কাছাকাছি থাকি সিট এক সাথে এবং পরীক্ষার হলে নাসরিন আমি দুইজন একি সাথে পরীক্ষা দিতে যাই, আমাদের ট্রান্সপোর্ট সি,এন,জি। হুজুর পরীক্ষা দিতে আসতো বাসে করে, তার বাস পাল্টাতে হতো এক বাসে সরাসরি যাওয়া যেত না, শেষ বাস পাল্টাতো আমরা যেখান থেকে সি,এন,জিতে উঠতাম সেই বাস স্ট্যান্ড থেকে।
ঘটনার দিন সে তুরাগ বাসে করে এসে নেমেই তরিঘড়ি করে দ্বিতীয় বাসে উঠলো। ও যে বাসে করে এসেছে সেটি খালি প্রায় তাই ছাড়ছে না যাত্রী তোলার জন্য অপেক্ষায় আছে। আমরা অপেক্ষায় আছি সি,এন,জির।
অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি ছেলেটা বাসে যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে ভাজ করা কাগজ পড়ে আছে,অনেকক্ষণ দেখলাম, কিছুই মনে হলনা, ওটায় যাত্রীরা উঠছে, কেউ তুলছেনা কাগজটা, দেখছেইনা কেউ, একজন তো পাড়াই দিলো ওটার উপর, বাসটা ছেড়ে দিলো, ধীরে।
আর ঠিক ওই মুহূর্তে আমার মনে হল ওটা প্রবেশ পত্র হয়ে থাকতে পারে! ছেলেটা ওখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল, পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পরীক্ষার টেনশনে বেখেয়ালে কাগজটা পরে যেতে পারে, ব্যাপারটা মাথায় আসতেই আমি অর্ধ চলন্ত গাড়িতে উঠলাম ওটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম হুম; উনার এডমিট কার্ড আর রেজিস্ট্রেশন কার্ড।বাস অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, এতে ১০/১২ মিনিট সময় অপচয় হল।
৯ টায় এক্সাম। তখন অলরেডি সাড়ে ৮টা বেজে গেছে। আর একটাও সি,এন,জি ঠিক করতে পারেনাই নাসরিন, ও আমাকে ছাড়া কিছুই করতে পারেনা, শুধু ও কেন যেই আমার সাথে থাকে সেই আমাকে ছাড়া কিছুই করতে পারেনা,এখনো।
ও সি,এন,জি না পাওয়ার জন্য আমাকে বকতে লাগলো। দৌড়াদৌড়ি করে ৮টা ৪০মিনিটে সি,এন,জি পেলাম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড জ্যামেও পড়ে গেলাম। যখন ৯টা বেজে গেছে তখনও আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলাম।
নাসরিন মেয়েটা পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মেয়েদের একজন, শ্যামলার মধ্যে ওর চেহারা হুবুহু এঞ্জেলিনা জলির মত লাগতো আমার কাছে, সেই এঞ্জেলিনা জলি ওই সময় পরীক্ষার টেনশনে দেখতে দেখতে ভয়ঙ্কর ডাইনির রুপ নিলো, কণ্ঠ পাল্টে গিয়ে বিভীষিকা বার বার বলতে লাগলো কেন আমি হুজুরটার এডমিট কার্ড কুড়াতে বাসে উঠে সময় নষ্ট করলাম আমি কি হাতেম তাই!!
কি যে এক মুহূর্ত ছিল, সি,এন,জির ভেতর নাসরিনের চিৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটি বকাঝকা!!শেষের দিকে একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড করে ফেললো আমার হাতে প্রচণ্ড খামচি দিয়ে রক্তারক্তি করে ফেললো, আমি যা রিভিশন দিয়ে বের হয়েছিলাম ততোক্ষণে সব গিলে খেয়ে ফেলেছি যেন।
ঠিক নয়টা দশে আমাদের সিএনজি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে এসে থামল,
সিএনজিওয়ালার কাছে ভাংতি নেই।
নাসরিন পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে দৌড়।
আমি ভাড়া দেয়া, প্রবেশ পত্র শো করা, গেট চেকিং পর্ব, মোবাইল, বই খাতা, জমা দেয়া পর্ব শেষ করে, হেঁটে সামনে গিয়ে বোর্ড দেখে হুজুর ছেলেটার কোন বিল্ডিঙে পরীক্ষা জেনে যত দ্রুত সম্ভব সেদিকে হাঁটতে লাগলাম।
দূর থেকে দেখলাম ছেলেটা এর ওর হাতে পায়ে ধরছে, ছোটাছুটি করছে, দূর থেকেই ডাক দিলাম, শুনছেই না,আমাকে একবার দেখল যেন তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলো। ও যেন এখন এই পৃথিবীতেই নেই এমনি উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি।
বাধ্য হয়েই ওর পর্যন্ত আমাকে পৌছাতে হল এতে আরও সময় নষ্ট হল, কাছে যেতে না যেতেই চিকন গলায় বলতে লাগলো ইতি আমি এখন তোমার সাথে কথা বলিতে পারিবনা আমাকে এখন তুরাগ বাসে যেতে হবে, ওদের নাম্বার যোগাড় করিতে হবে, ওর এসব কথা শুনবার যথেষ্ট সময় হাতে নেই, এডমিট কার্ড হাতে দিলাম ওর। তারপর ও হুশ নেই সে তার কথা রোবটের মত বলেই যাচ্ছে তুরাগ বাসের ফোন নাম্বার আছে তোমার কাছে? আমাকে এখুনি তুরাগ বাসের নাম্বার যোগাড় করতে হবে।
হাতে কি দিয়েছি দেখো বলে আমি ছুটতে ছুটতে নিজের সীট রুম খুঁজে পেয়ে যখন রুমে ঢুকলাম তখন ৯টা ৩৫ বেজে গেছে।
এই ঘটনার পর ছেলেটা সবাইকে বলে বেড়াতো আমি ওর জীবন বাঁচিয়েছি।
বেশ কয়েকদিন আমার সাথেও যতবার দেখা হল ততবারই আমাকে বলল। আমি বললাম আমি তোমার জীবন বাঁচিয়েছি বল কেন তুমি তো মরে যাচ্ছিলে না এতে আমার জীবন বাঁচানোর কি আছে?
বলল ইতি তুমি বুঝবেনা কি যে কষ্ট করে এতদূর এসেছি, সারাদিন টিউশনি করে স্কুলে ক্লাস নিয়ে রাতে মেসে ফিরলে ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এলে পায়ের আঙ্গুলে দরি বেঁধে শুতাম, পায়ে টান পরলেই ঘুম ভেঙ্গে যেত আর আমি পড়া শুরু করতাম, এত গুলো পরীক্ষা এত ভালোভাবে পার হয়ে শেষে ফাইনালে এত কষ্টে এত ভালো প্রিপারেসনের পর যদি পরীক্ষা দিতে না পারতাম আমি সহ্য করতে পারতাম না, বলতে বলতে ওর কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো তারপর একদম চুপ করে রইলো।
দেখে বোঝা যাচ্ছিল ছেলেটার ভেতরটা কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বললাম না, বাকীটা ওর ধুলো জমা পা, পায়ের ছেড়া স্লিপার, আধাময়লা পাঞ্জাবী আমাকে জানান দিয়ে দিলো।
ওইদিন নাসরিন পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি মাফ চাওয়া চাওয়ি করেছিলো, ওর খামচিতে কাঁটা জায়গায় দোকান থেকে স্যাভলন কিনে লাগাতে লাগাতে সে কি মায়া কান্না, যত্তসব ড্রামা কুইন।
ওই সময় আরেকটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল।
আমাদের ক্লাসের শুকনা, লম্বা ফর্শা মিষ্টি চেহারা আর সব থেকে ঠাণ্ডা স্বভাবের মেয়ে শ্যামলী প্রথম পরীক্ষার পর আর এলোনা, আত্মহত্যা করেছিলো ও, ওর সীট পড়েছিল আমার দুই বেঞ্চ সামনে একটা বিশাল জানালার পাশে, সেই জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি গাছ, খানিকটা আকাশ, শুকনো পাতা দেখা যেত।
বাকী পরীক্ষাগুলোতে সীটটা ছিল ফাঁকা। এত মানুষের ভিড়েও ওটা কি যেন কি এক বিষাদ জানান দিয়ে যেত সারাটাক্ষণ।
বিঃ দ্রঃ এটা কোন গল্প নয় আমার জীবনে পথে ঘাটে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৫