এইতো এইচ,এস,সির রেজাল্টের কয়েকদিন পর ১২ তলা থেকে ফোন এলো, আমাকে যেতে বলেছে urgent.
খানিকটা চিন্তিত হয়ে আমি ধীরে ধীরে লিফটের সামনে এলাম, দুইটা ফ্লোর হেঁটেই নামা যায় ইচ্ছে করছিলো না, লিফটে ১২ ফ্লোরের একজনের সাথে দেখা হতেই কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, এখলাস ভাইয়ের ছেলে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে তাই অফিসের কাছের মানুষজনকে ডেকে স্পেশাল একটু খাওয়া দাওয়া করাচ্ছে, এখলাস ভাই আমাদের থেকে অনেক সিনিয়র কিন্তু আমরা অফিসে শুধু ডি, ইডি, এমডি, ডিজিএম ছাড়া আর সবাইকে ভাই আপু বলে চালিয়ে নেই,(যত সিনিয়রই হোক আংকেল বলা যাবেনা)এই রেওয়াজ সম্ভবত আমাদের অফিসে বহুদিন ধরে চলে আসছে, জানিনা, হতে পারে সব অফিসেই এমন।
যাক, ১২ ফ্লোরে ঢুকতেই চুপচাপ নিরিবিলি ওয়ার্ক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ঘরের মত আতিথিয়তায় সিট থেকে উঠে এলো এখলাস ভাই, ডেকে কর্নারের জেনির কাছে নিয়ে গেলো আমায়, সেখানে বেশ কয়েকটি খাবার প্যাকেটের পাশাপাশি প্লেট চামচ এনে রাখা, জেনি কাজ রেখে উঠে গিয়ে আমাকে স্ব সন্মানে বসতে দিয়ে সুন্দর করে খাবার বেড়ে এনে সামনে দিলো, খাবার প্লেটে সাজিয়ে দেয়ার মুহূর্ত বেশ ভালো লেগেছে, যদিও আমাদের অফিসের প্রতিটা ফ্লোরে টি কর্নার আছে কিন্তু ব্যক্তিগত আনন্দ সেলিব্রেটের জন্য এখলাস ভাই ওদিকে এসব করতে সাহস পায়নি বোধহয়, জেনি যেন এখলাস ভাই এর মেয়ে তার ঘরে বসে বাবার আনা খাবার অতিথিকে সাজিয়ে দিচ্ছে, দৃশটি অভূতপূর্ব।
আমি স্বভাবসুলভ টুকটাক কথা বলে খেয়ে দেয়ে চলে এলাম।
জেনি এমনি এক মেয়ে যে পৃথিবীর সকল শান্তি সকল স্নিগ্ধতা সকল মায়া সকল সত্য সকল সুন্দর সকল নিস্পাপ স্বভাব নিজের ভেতর ধারন করে আছে।
মানুষ হিসেবে আমি কখনই আমার নিজের ভুলত্রুটি শিকার করবোনা নিজের সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে কিছু বলতে গেলে আমি বুঝে না বুঝে নিজের প্রশংসাই করবো, এবং অন্য কারো সাথে নিজের তুলনা করতে গেলে অবশ্যই আমি নিজেকে ভালো বলবো, কিন্তু তবুও এখানে আমার শিকার করতে হচ্ছে জেনির পাশে ভালোর দিক থেকে আমার অবস্থান ওর থেকে অনেক কম, আমি ময়লা নোংরা পোশাকের মানুষজন ঘৃণা করি বোকাদের দিকে ফিরেও তাকাই না, কাউকে ভালো না লাগলে এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেই, রাগ করি, বাসায় ফিরে রাগে মায়ের সাথে চিৎকার করি, অনেককেই ছোট করি, অধিনস্তদের সাথে প্রায়ই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আচরন করি। কারো উপড়ে বিরক্ত হলে তার নামে গসিপ করি, এরকম অনেক দোষ আমার ভেতরে আছে এবং আমি মনে করি এরকম আমি একাই না অনেকেই আছে।
কিন্তু আমাদের জেনি মোটেই এরকম না, আমাদের জেনি পৃথিবীর সেরা নিস্পাপ এক মেয়ে, খানিকটা ভিতু, খানিকটা দুঃখী আর অনেক অনেক লক্ষ্মী মেয়ে জেনি।
আমরা আলাদা ফ্লোরে থাকলেও প্রায়ই লাঞ্চ আওয়ারে ডাইনিং এ দেখা হতো, নামাজ টাইমে নামাজ রুমে দেখা হতো, মাঝে মাঝে লিফটে দেখা হতো, অফিস ছুটির পর বের হতে হতে দেখা হতো।
আমার সাথে অফিসে লাস্ট দেখা হলো আজ থেকে ৫ দিন আগে, অফিসে গিয়ে শুনি এইচ আর ম্যাডাম(এইচ,আর হেড)খুঁজছে পঞ্চাশ ছুই ছুই অতিরিক্ত লম্বা ফরশা অমায়িক গোছালো এবং প্রচণ্ড ব্যাক্তিত্ত্ব সম্পন্ন এইচ,আর ম্যাডাম বসে এগারো ফ্লোরে, যেতে যেতে দেখি জেনি বেরিয়ে আসছে তার রুম থেকে, আমাকে দেখে হাসলো একটু ও, কিছু বললাম না, তাড়া ছিল চলে গেলো কিংবা এইচ,আর ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে দাঁড়াতে সাহস পেলনা।
ম্যাডাম কোন এক প্রাক্তন ইমপ্লয়ীর ব্যাপারে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দিলো।
যাই হোক জেনির সাথে তার পরদিন কথা হল অফিসে ল্যান্ড ফোনে, সতর্ক করে বললাম একদম মুখ বন্ধ, ম্যাডাম আপনাকে আমাকে কি বলেছে কাউকে বলার দরকার নেই, এর কোন কথা জানাজানি হলে বলবে জেনি অথবা ইতি বলেছে কাজেই একদম মুখ বন্ধ, সে ব্যাপারটায় ভয় পেয়েছিল, বার বার বলছিল শুধু আমাদের কেন ডাকল ম্যাডাম চাকরি চলে যাবে নাতো, চাকরি নিয়ে জেনির অনেক ভয়, বহু কষ্টে এতদুর এসেছে মেয়েটা। বললাম ওসব কিছু না, এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
তারপর
দুদিন আগের কথা।
জেনি ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত অফিস করে বের হল, আমরা যার যার বাড়ি ফিরলাম জেনি ফিরতে পারলোনা, শুনলাম পথে এক্সিডেন্ট করেছে, দুই পা ভেঙ্গে গেছে মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছে শুধু তাই-ই না, জেনি এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়েছিল এক ঘণ্টা কেউ ওর কাছে যায়নি, এমনকি ওর হ্যান্ডব্যাগ ওর মোবাইল কিচ্ছু ওর পাশে ছিল না, কেউ হয়ত চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। শেষে দুইজন গার্মেন্টস শ্রমিক ওকে কোন একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
সেখানে তারা ভর্তি করাতে নারাজ। নাম পরিচয় জানা নেই সাথে আত্মীয় স্বজন নেই ভয়াবহ এক্সিডেন্ট করা রোগী মরে গেলে থানা পুলিশ, রিস্ক নিতে চায়না হাসপাতালের লোকজন, পরে কেউ একজন ওর গলায় আমাদের অফিসের আইডি কার্ডের ইনফোতে লেখা নাম্বারে ফোন দেয়।
(আমরা গলায় আইডি কার্ড ঝুলায়ে রাখতে বাধ্য কেনোনা অফিসের হেন জায়গা নেই যেখানে কার্ড পাঞ্চ ছাড়া দরজা খোলা যায় তারপর ছুটির সময় তারাহুরায় অনেকেরই আর গলা থেকে ওটা খোলা হয় না) আর এটাই জেনির পরিচয় জানালো, আমাদের অফিস রিসিপশন চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে হয়তো। তারা ফোন দিলো এইচ আর ম্যাডাম কে ম্যাডাম ফোনেই জেনিকে অফিসের লোকজন পাঠিয়ে ইউনাইটেড হসপিটালে দ্রুত শিফট করে ফেললেন, এত সবকিছুর অনেক অনেক পরে জেনির বিপদের কথা জানতে পারলো তার পরিবার। কেনোনা অফিসে জেনির ডিটেইলস ছিলনা।
এই ঘটনার কারনে আমাদের অফিস রুলস হয়েছে নতুন করে সবার বাড়ির ঠিকানা বাড়ির অন্তত দুজন লোকের মোবাইল নাম্বার জমা দিতে।
জেনিকে দেখতে গিয়েছিলাম আজ। দুই দিনে মেয়েটাকে চেনাই যাচ্ছে না, পা প্লাস্টার করা, মাথা পেছন থেকে ব্যান্ডেজ, শরিলের যতটুকু বেরিয়ে আছে মনে হচ্ছে কেউ চাকু দিয়ে কুচি কুচি করার নিদারুন চেষ্টা করেছে, সবচেয়ে কষ্ট হল জেনি কথা বলতে পারছেনা, কথা বলার জন্য মাথার সাথে যে স্নায়ুর সংযোগ সেটা নাকি থেতলে গেছে, আর চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক, ও বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা, মুখ টা হা করা, শুধু একটা হাত নাড়াতে পারছে ওই হাতটা একদম বাচ্চাদের মত আঁকাবাঁকা করে মুভ করছে, বিস্মৃতি ঘটেছে ওর ব্রেনে।
দৃশ্যটা হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে আমার। জেনির জন্য অসংখ্য অসংখ্য দোয়া চাই।
এরকম অনেক ঘটনাই আমাদের চারপাশে হচ্ছে তবু খুব আপনজনদের জীবনে এত কাছ থেকে দেখা ঘটনা হৃদয়টাকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়।
রাস্তা ঘাটে চলাচলের সময় নিজের পরিচয় সব সময় সঙ্গে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এইতো কতদিন আগে আমার এক দুঃসম্পর্কের আংকেল রোগী দেখতে গিয়ে গাড়িতে চাপা পরে মারা গেলেন, ঘটনার ৮ ঘণ্টা পর তার আত্মীয় স্বজন খুঁজতে খুঁজতে হাসপাতালে মর্গে তার লাশ আবিস্কার করেন।
আমাদের ইউনিভার্সিটির ইংলিশ টিচার কদিন আগে মরে গেলেন বাসে বসে, ক্লাস শেষে পাবলিক বাসে ফিরছিলেন, কন্টাক্টর ভাড়া নিতে যেয়ে আবিস্কার করলেন যাত্রী মরে গেছে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্যার ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন।
আমি অনেক বছর আগে থেকেই এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি যে আমাদের দেশে অনেক নারী পুরুষের লাশ সনাক্ত হয় বেওয়ারিশ হিসেবে, তাদের লাশের পাশে কোন পরিচয় পাওয়া যায় না বলেই তারা বেওয়ারিশ।
ব্যাপারটা ভেবে ভেবে আমি শংকিত। আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভিজিটিং কার্ড রাখি সাথে।
জীবন যেহেতু আছে মৃত্যুর মুখোমুখি একদিন অবশ্যই আমাদের সবার হতে হবে, জীবনের বাঁকে কোথায় মৃত্যু ওত পেতে আছে কে জানে।
রাস্তা ঘাটে সবার সতর্ক ভাবে চলাফেরা করবেন, সব কিছুর আগে নিজের প্রোটেকশনের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, জীবনের থেকে অফিস টাইম বড় নয়, বাসে তারাহুরা করে উঠতে যেয়ে হাত পা হারিয়ে ফেললে চাকরি থাকবে?
রাস্তা পারাপারের সময় সবাই সাবধানতা অবলম্বন করুন, চেষ্টা করবেন অবশ্যই ফুটওভার ব্রীজ আশেপাশে থাকলে সেটি দিয়ে রাস্তা পাড় হওয়ার।
সবাই রাস্তাঘাটে সাবধানে চলাচল করুন সড়ক দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলুন এবং সুস্থভাবে দীর্ঘদিন বাঁচুন ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:১৮