এটি জীবন-মরণের গল্প!
এটি বেঁচে ফিরতে পারার গল্প!
এটি পাহাড় থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে, হারিয়ে না যাবার গল্প!
এটি টানা ছয় ঘণ্টা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে শতেক পাহাড় পেরিয়ে আসার গল্প!
এটি পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতিটি শিরা-উপশিরার ভয়ে শিউরে ওঠার গল্প!
এটি নিজের কাছে নিজের কান্না লুকানোর গল্প!
এটি প্রিয়জনের কাছে ফেরার হাহাকারের গল্প!
এটি সান্দাকুফু অভিযানের সবচেয়ে দুর্ধর্ষতার গল্প!
তবে গল্পটা শুরু করি?
ফালুটের মাঝ পথ থেকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে সান্দাকুফু ফিরার পরেই, সেই পরিবার তাদের সেদিনের গন্ত্যব্যে চলে গেল। এরপর তাকিয়ে দেখি চারপাশ সুনসান। কোথাও কোন প্রাণী নেই। একটি মানুষ পর্যন্ত নেই, এখন এই সান্দাকুফুতে! অদ্ভুত একটা নির্জনতা চারদিকে।
কারণ যাদের যেদিকে যাবার পরিকল্পনা, তারা প্রত্যেকেই তাদের গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেছে বেশ আগেই। এখানে সকাল ৯ টার পরে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। আর যারা আসবে নতুন করে, তারা সেই দুপুরের পরে। কিন্তু আজকে আরও দেরী হবে। কারণ সেই ঘণ্টা দুয়েক থেকে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। থামার কোন লক্ষণ নেই। চারদিক গভীর মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, আর বৃষ্টি ধারা ঝরছে অবিরাম।
এইসব দেখতে দেখতে, মুহূর্তেই একটা একাকিত্ত গ্রাস করে ফেলল আমাকে। বুকের ভেতর একটা হাহাকারের ঢেউ উঠলো প্রিয় মুখ গুলোর জন্য। কেমন যেন গুমরে উঠতে লাগলো ভেতরটা, খুবই ভয়ানক ভাবে যা পুরো চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিল। ইচ্ছে হচ্ছিল, তখনই যদি ছুটে আসা যেত প্রিয়জনের কাছে!
কিন্তু সেই উপায় তো নেই। অন্তত আরও তিনদিন লাগবে, ঢাকায় ফিরতে! এখন নেই কোন গাড়ি, নেই কোন মানুষ, নেই কোন গাইডও। তাই অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত এই সান্দাকুফুতেই থাকতে হবে একা-একা! ভাবতেই ভয়ে-আতঙ্কে-কষ্টে ফেটে যেতে লাগলো ভিতরটা।
তাই এই মুহূর্তও দেরী না করে, সেই বৃষ্টির মাঝেই রওনা হলাম, মাথায় পলথিন, পিঠে ব্যাগ আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে শুধু আশা বাঁচিয়ে রাখলাম, পথে যেতে যেতে কোন না কোন গাড়ি হয়তো পেয়ে যাবো, কিছুদূর যাবার। সেই সান্ত্বনাকে বুকে করেই শুরু হল নির্জন পাহাড়ি রাস্তায়, বৃষ্টির মাঝে পথ চলা।
সান্দাকুফু থেকে কালাপোখারি, ৬ কিলো পথ। যে পথ গতকাল ৩ ঘণ্টায় এসেছি সেই পথ পাড়ি দিয়েছি মাত্র ১ ঘণ্টা পাঁচ মিনিটে! হাটার গতি এতোই বেশী ছিল, আর একটু সুবিধা ছিল, প্রায় পুরোটাই ডাউন হিল। কিন্তু বৃষ্টি ভেজা, ঝুরো পাথরের রাস্তায় এটাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মনে মনে শুধু একটাই প্রত্যাশা ছিল যে, কালাপোখারিতে পৌঁছে কোন না কোন রেশনের গাড়ি পেতে পারি। সান্দাকুফু থেকে সেভাবেই জেনে এসেছিলাম।
কিন্তু কালাপোখারি এসে অপেক্ষা-অপেক্ষায় প্রায় ৪০ মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও কোন কিছু না পেয়ে আবার শুরু করবো, এমন সময় কয়েক পা এগোতেই একটি খালি জীপ এলো, সামনের কাইয়াকাট্টা পর্যন্ত কোন কাজে যাবে। উঠে পড়লাম ওটাতেই। প্রায় ৪০ মিনিট পরে গাড়ি এসে থেকে গেল আর আমিও নেমে গেলাম। নেমে যাবার পরে শুধু জিজ্ঞাসা করলাম এখান থেকে টুমলিং যেতে কত সময় আমার লাগতে পারে? ওরা জানালো ৪ থেকে ৪:৩০ ঘণ্টা! যার পুরোটাই আপ-হিল! তখন সময় প্রায় ২:৩০!
তার মানে ৬:৩০ থেকে ৭ টা বাজবে? আমার তো আরও বেশী লাগতে পারে? ভাবতেই কিছুটা শিউরে উঠলাম! কিন্তু থামলাম না এক মুহূর্তও।
কারণ যেটুকু সময় থেমে থাকবো, সেটুকু সময়ই পিছিয়ে পড়বো। আর ওদের কাছে জানলাম সন্ধা কেন, অনেক সময় বেশ রাতেও টুমলিং থেকে রেশন বহনকারী জীপ পাওয়া যায় মানেভাঞ্জন যাবার। আর এই পথে যেতে যেতেও পেয়ে যেতে পারি ফালুট থেকে ফেরার কোন গাড়ি। ব্যাস সেই আশা বুকে বেঁধেই শুরু হল এক অসম্ভব পথ চলার, গা ছমছমে, গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে পথ চলার গল্পটি।
কাইয়াকাট্টা থেকে গাইরিবাস একটু কম বৃষ্টিতেই হেটে এসেছি তেমন কোন আতঙ্ক বা ভয় ছাড়াই। কারণ সেই সময়েও ওই পথে অনেকে ট্রেক করে কালাপোখারি উঠছিলেন। প্রত্যেকেই আমার এই সময়ে একা-একা নেমে যাওয়া দেখে বেশ অবাক চোখে তাকাচ্ছিলেন। কারণটা বুঝতে পারছিলাম না কিছুতেই। কারণ ওদের দৃষ্টিতে একটা বিস্ময় ছিল, আমি যেটার কারণ খুঁজছিলাম। যেটার উত্তর পেয়েছিলাম গাইরিবাস পেরিয়ে একদম খাড়া পাহাড়ে উঠার সময়ে।
গাইরিবাস পার হতেই, মৃদু বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নিল। পাহাড়ে অন্ধকার নেমে এলো নিমিষেই, অরণ্য গভীর থেকে আরও গভীর হতে লাগলো, অন্ধকার হতে লাগলো নিকষ কালো! নিজের হাত সামনে দিলেও নিজের হাতকে দেখা যাচ্ছেনা এতো বৃষ্টি আর এতো অন্ধকার ঘনিয়ে এলো! এভাবে এক সময় এক পাহাড়ের আপ-হিল শেষ করে, একটু সমতল পেতেই কিছুটা ভালো লাগলো। কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ড মাত্র! কারণ মাত্র কয়েকটা স্টেপ দিতেই আবারো আপ-হিল! আবার আরও খাড়া, আরও বেশী বাঁক পেরোতে হবে।
কিছু সময় খুব ধীরে ধীরে আপ-হিলে উঠার সময় একটা বাঁক এলো, যেখানে পাহাড় এতটাই খাড়া আর বেশী বাঁকের রাস্তা যে, জঙ্গলের গাছ-লতা-পাতা-শ্যাওলা সব এসে ঘিরে ঘরেছে সেই রাস্তাকে, ভয়ানক গা ছমছমে একটা পরিবেশ, তার উপর মুষলধারে বৃষ্টি আর সন্ধার অন্ধকার, সবকিছু মিলে একটা ভয়াবহ পরিবেশ। আর এই বাঁকটা যখন পেরিয়ে যাচ্ছিলাম পায়ের পাতা থেকে মাথার প্রতিটা চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে গিয়েছিল ভঁয়ে-আতঙ্কে আর শিউরে উঠেছিলাম প্রতিটি শিরায়-উপশিরায়! হ্যাঁ তাই-ই, আমি নিজের মাথায় নিজে হাত দিয়ে দেখেছি, প্রতিটি চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল! বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ঠিক অনেক পুরনো একটেলের “১০ সেকেন্ড পালস” এর বিজ্ঞাপনের মত!
ধীরে ধীরে উপরে উঠছিলাম আর সব রকম দোয়া কালাম যা জানা আছে পড়ছিলাম একে-একে, আর চাইছিলাম যদি একটা গাড়ি একটু আসতো, তাহলে কিজে ভালো হত। অথবা যদি বৃষ্টিটা কমে গেলেও হাটতে একটু সুবিধা হত। কিন্তু কিসের কি, বৃষ্টি আরও বাড়ছে, সাথে বাতাস, সাথে ভয়াবহ ঠাণ্ডা আর ওদিকে ট্রেক এর ঘামে ভিজে যাওয়া পুরো শরীর।
দোয়া পড়ছিলাম আর হাঁটছিলাম যতটা ধীরে পারা যায়, একটুও না থেমে! কারণ আমি জানতাম থেমে বিশ্রাম নিতে গেলেই আমি আর উঠতে পারবোনা। আমাকে ওখানেই বসে-শুয়ে বা মরে পরে থাকতে হবে! উঠার সামরথ আর আমার হবেনা। তাই ভীষণ ভীষণ পানির পিপাসা লাগা সত্ত্বেও, সাথে পানি থাকা সত্ত্বেও, থেমে, ব্যাগ নামিয়ে পানি খাবার সাহস দেখাইনি। হেটে চলেছি তো হেটেই চলেছি...। সব শেষে কোন গাড়ি না পেয়ে, বৃষ্টি না থামাতে, আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ছিল, যেন জুতার ভিতরে পানি ঢোকে।
কিন্তু না, উপরওয়ালা আমার এই চাওয়াও রাখলেন না। আমার চাওয়া শুনেই বোধয় তিনি ভাবলেন যে তোকে এবার পাহাড়ে-পাহাড়ে, একা-একা অ্যাডভেঞ্চারের মজা হাড়ে হাড়ে বোঝাবো। তোকে আজন্ম শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো এবার, এই সান্দাকুফু অভিযানেই। যে কারণে একটু একটু করে বুটের ভিতরে বৃষ্টির পানি ঢুকতে লাগলো...!
আর যারা পাহাড়ে যান, ট্রেক করেন, তারা মাত্রই জানেন আর বুঝবেন, বুটের ভেতরে পানি ঢুঁকে যাওয়াটা কতটা বেদনার আর যন্ত্রণার, কতটা প্রতিবন্ধকতার!
বুটে পানি ঢুঁকে পড়াতেই আতঙ্কে তাল হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর মুষলধারে বৃষ্টি পড়াতে কিছুই দেখা যাচ্ছিলোনা সামনে, যার প্রভাব পড়েছিল মরণের মুখ দেখে ফেয়া দিয়ে!
কারণ বুটের ভেতরে বৃষ্টির পানিতে ভরপুর হয়ে যাওয়াতে কখন যে একদম রাস্তার শেষে পাহাড়ের খাঁদে গিয়ে পড়েছি খেয়ালই করিনি! পরের স্টেপ দিতেই তাই, উড়ে গেলাম পাহাড় থেকে অন্য কোন জগতে! ভাবলাম আমি শেষ, পড়তে পড়তেই! শুধু মাথাটা আগে পরে ঘুরে গিয়ে পিঠের ব্যাগটা অন্য পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগেছিল বলে রক্ষা। মাথাটা ভেঙে যায়নি, এই যা! প্রায় ৮/১০ টা যায়গায় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, একসময় গড়িয়ে পড়া থেমে গেল আপনা আপনি-ই! অনুভব করলাম বেঁচে আছি!
এরপর কোথায়, কোন দিক দিয়ে কিভাবে উঠবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলামনা। ভেবে দেখলাম যা হবার হবে, জীবন যেহেতু পেয়েই গেছি, কোন পথ না খুঁজে সোজা-বাঁকা যেভাবে যেখানে, ভর দিতে পারবো, সেভাবে, সেখান থেকেই সামনে আর উঁচুরাস্তার দিকে যেতে থাকবো। ততক্ষণে সত্যিকারের সন্ধা নেমে গেছে পুরো পাহাড়ে।
বৃষ্টি আরও তেড়েফুড়ে পড়ছে যেন, জীবনের শেষ বারের মত! অন্ধকারের বর্ণনা দেবার কোন ভাষা জানা নেই আমার। চারদিকে শুধু গাছ-লতা-পাতা আর শ্যাওলা জমে থাক্কা পিচ্ছিল পাথর! কতক্ষণ আর কিভাবে উঠেছি জানিনা, তবে উঠতে পেরেছিলাম জীবন নিয়েই, পিঠের ব্যাগকে সাথে করেই।
আর উঠতেই দেখি টুমলিং এর পরের যে চেকপোস্ট, সেখানে পৌঁছে গেছি প্রায়। একবার ভাবলাম চেক পোস্টে পৌঁছে ওদের কাছে আজকে থাকার সাহায্য চাই। আবার ভাবলাম না আমার সাথে গাইড নাই, অনুমোদন নাই, সাথে কেউ নাই, এইসব দেখে যদি কোন ঝামেলা করে ফেলে! সেই সংকাতে আর অমুখো না হয়ে সোজা যেতে লাগলাম, শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে, পিঠের ব্যাগ হাত দিয়ে ঠেলে ধরে, একটু হালকা করে নিয়েই প্রায় দৌড় লাগালাম, চেকপোস্ট পার হবার পরেই।
কারণ সামনে আর তেমন বড় কোন চড়াই নেই, রাস্তা অনেকটা সমতল, একটু উঁচুনিচু কিন্তু পাথরের খাঁজ খাঁজে রয়েছে আবারো পিছলে পরার ঝুঁকি। কিন্তু এখানে আমার দামি আর আদুরে উডল্যান্ড বড় উপকার করেছে। যেখানেই পা রাখি, আটকে যায় কোন রকম নড়াচড়া বা পিছলে না গিয়ে। এটা বুঝতে পেরে, পা ফেলতে শুরু করলাম আরও জোরে জোরে, অনবরত। প্রায় ২০/২৫ মিনিট হাটার পরে পৌঁছে গেলাম আপাত ঝুঁকিমুক্ত টুমলিং এ।
আর আগে যেখানে ছিলাম, সেই যায়গায়, তাদের রান্না ঘরের সামনে গিয়ে মানুষ দেখতে পেয়েই, পড়ে গিয়েছিলাম ধপাস করে! চেতনা হারিয়েছিলাম বোধয়!
এরপরে আর মনে নেই কিছুই.........!!!
ট্রেকার্সদের বৌয়েরা...! (পরের গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০২