ভোর সাড়ে চারটা থেকে সকাল ৮:৩০ টা পর্যন্ত কোথাও যাইনি এক পা-ও। ঠায় বসে ছিলাম শেরপা চ্যালেটের খোলা উঠোনে। এখান থেকেই সবচেয়ে আরামে আর কোন রকম বাঁধা ছাড়াই দেখা মেলে পুরো বরফ মুদ্রিত হিমালয় রেঞ্জের। যার শুরুটা ডানের ভুটান থেকে, মাঝে ভারতের কিছু অংশ আর একদম বামে থ্রি সিস্টার সহ স্বপ্নের এভারেস্ট শৃঙ্গ পর্যন্ত... আর এরপরেও রয়েছে নাম না জানা বেশ কিছু বরফে বরফে আচ্ছাদিত পর্বতরাজী যা নেপালে অবস্থিত।
যখন ধ্যান ভাঙল ওই পর্বত শ্রেণী দেখার, ততক্ষণে যারা ফালুট ট্রেক করার চলে গিয়েছে, যারা রিম্বিক হয়ে শ্রীখোলা যাবার তারাও চলে গিয়েছে। আমার প্ল্যান ফালুট যাবার। কিন্তু যে সময় আছে তাতে, সন্ধার মধ্যে ফালুট পৌঁছানো সম্ভব নয়। আর স্থানীয় সবাই (যাদের কাছে পরামর্শ নিয়েছি) একা-একা ফালুট ট্রেক করতে আন্তরিক ভাবেই নিষেধ করলো।
কারণ এই পথ খুব খুব সুন্দর আর রোমাঞ্চকর হলেও, অনেক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এই পথে একদম স্বচ্ছ আবহাওয়ার মাঝেও হুট করে ঝড় বয়ে যায়, ঝড়ো বাতাসে পাহাড় থেকে পাথর ছুটে আসে, যার কারণে অনেকে অনেক বড় বড় বিপদের সম্মুখীনও হয়েছে বা হয়। এমনকি খুব খুব ঝুঁকিপূর্ণ কিছু পথে আছে, যেখানে একবার কোন কারণে পিছলে পড়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়াও যাবেনা! তাই একা না যাওয়াই ভালো।
তাই ট্রেকের প্ল্যান বাদ দিতে হল। কিন্তু ফালুট না যেতে পারলে একটা অপূর্ণতা আর আক্ষেপ থেকে যাবে তাই যাবার উপায় খুঁজতে লাগলাম। আল্লাহর অসীম আশীর্বাদে পেয়ে গেলাম একটি উপায়। গতকাল যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তাদের সবাই ফালুট যাবেনা, তবে কয়েকজন যাবেন। আর আমি চাইলেই তাদের সাথে যেতে পারি। ব্যাস, ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়লাম ওনাদের জীপে। শুরু হল এক স্বপ্নময় পথ।
এমন পাথরের রাস্তায় এর আগে কখনো কোন গাড়িতে ওঠার দুর্ভাগ্য আমার হয়নি। এই রাস্তাতেই গতদিন হেটে গিয়েছিলাম বেশ ৪/৫ কিলো পথ, উচ্চতার সাথে মানিয়ে নিতে। কি অদ্ভুত সেই রাস্তাটা, সান্দাকুফু থেকে ফালুট যাবার পথ। যেন এক স্বর্গের পথে চলছিলাম। যে রাস্তার মাধুর্য আর মোহময়তা কোন শব্দে লিখে বোঝানো সম্ভব নয় আদৌ।
পাহাড়ের মাঝ থেকে, অনেকটা চুড়ার মত অবস্থানে পাথরের রাস্তা, পাশের ছোট ছোট সবুজ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ট্রেকার্সদের জন্য নিজেদের তৈরি করা পথ। সবুজ আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গায়ে গায়ে সিঁথির মত একেবেকে যাওয়া রাস্তা। মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জমে দুই পাহাড়ের ভ্যালীতে তৈরি হয়েছে সাময়িক লেক।
রাস্তার ডান পাশে সারি সারি পাইনের বন, বহু বছরের পুরনো শ্যাওলা জমে জমে কালো হয়ে যাওয়া, পাইনের শরীর। যার উপরের দিকে তাকালেই সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে নীল আকাশ আর সাদা মেঘেদের মাঝ থেকে উঁকি দেয়া সূর্যের হাসি।
যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাইনের বন, নেমে গেছে পাদদেশে, সিঁড়ি বেঁয়ে, কোন এক পাহাড়ের ভ্যালীতে। এরপর ওপাশে আবার সিঁড়ি বেঁয়ে উঠে গেছে, পাইনের বন, ধীরে ধীরে উঁচুতে আরও উঁচুতে। এক সময় পাইনের বন শেষ হয়ে, শুরু হয় রুক্ষ পাথুরে পাহাড়। যে পাহাড়ের সিঁড়িও শেষ হয়ে যায় এক সময়, শুরু হয় কিছুটা সবুজ পাহাড় আর এরপরেই ওপাশে দাড়িয়ে থাকা হিমালয়ের বরফে মোড়া চুড়াগুলো! এক অপার্থিব সময় আর যায়গা সেটা।
আর যদি ট্রেকের পথে বামে তাকাই তো চোখে পড়ে, ছোট ছোট টিলার মত সবুজের কার্পেট বিছানো পাহাড়ের সারি। আসলে ওগুলো অনেক বড় আর উঁচু পাহাড়, আমরাই তো আছি ১২,০০০ ফুটের উচ্চতায়, তাহলে ওগুলো কিভাবে টিলার মত হয়? আসলে হয়েছে কি, এই পথে এতো বিসৃত পাহাড়ের সারি যে আর উঁচু না হয়ে, শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রঙের-বর্ণের আর আকারের পাহাড়ের দল।
সবুজ পাহাড়ের দলের সাথে খেলা করছে সাদা-সাদা মেঘেদের দল। চাইলেই মেঘের সাথে মিশে যাওয়া যায় অনায়াসে! ভিজে যাওয়া যায় ইচ্ছে মত, আর একটু মেঘেদের থেকে এদিকে এসে মিষ্টি রোদে দাঁড়ালেই দারুণ আনন্দ! দুই একটি পাহাড়ি জংলী পাখি, আর নাম জানা শত ফুলের রঙিন হাসি। আর সেইসব সবুজের পাহাড়ের দল গুলো ধীরে ধীরে নিচে নেমে গিয়ে মিশেছে কোন এক ভ্যালীতে যার উপারেই আবার সাদা বরফ পাহাড়ের মেলা!
আহা, কোন দিকে তাকাই এখন? বামের সবুজ পাহাড়ের সাথে সাদা মেঘেদের খেলা দেখি? নাকি ডানের কালো কালো পাইনের বনের ভিতরে ফুটে থাকা হাজারো রঙের বর্ণিল ফুলেদের দিকে? সবুজে ছেয়ে থাকা রাস্তার দুইধারের অপার সৌন্দর্যের দিকে? কিজে করি, হাটি না বসে থাকি নাকি চুপচাপ সবুজে শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে অনুভব করি? বুঝতে পারছিলামনা। কিংকর্তব্যবিম্বুড় হয়ে পরেছিলাম।
এরপর ভাগ্য প্রথমে বেশ সদয় হয়েছিল আর তার কিছুক্ষণ পরেই প্রকৃতি হয়েছিল ভীষণ বিরূপ। আমাদের গাড়ি যে পথে যাবে, সেই পথে এতো গভীর খাদ হয়েছে যে কোন ভাবেই গাড়ি যাবার উপযুক্ত ছিলোনা। যে কারণে আমরা নেমে পড়লাম সেই সবুজ পাহাড়ি ভ্যালীতে, মেঘেদের মাঝে। শুরু হল ট্রেক ফুল আর পাখিদের সাথে, সবুজের পথে-পথে।
এক একটা পাহাড় পেরোই আর এক এক রকম মোহ ঘিরে ধরে চারপাশ থেকে। এক এক পাহাড়ে এক এক রকম মেঘের দল, এক এক রঙের ফুলের চাদর আর এক এক রঙের ঝলক। একটু হাটি আর একটু বসে থাকি আর অপলক চেয়ে থাকি চারপাশের বিমোহিত রূপ দেখে। মনে হয় যেন এক যায়গায় বসেই থাকি যতক্ষণ মেঘ ঢেকে না দেয় অপরূপ প্রকৃতিকে বা ঝড়-বৃষ্টি এসে বাঁধা না দেয় এই রূপ অবলোকনে। এভাবে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূরে, প্রায় ১৩ কিলো।
সামনে চেকপোস্ট এলো আর একটা। বুকের মধ্যে দুরুদুর শুরু হল। আমার তো গাইড নাই, যদিও একটি গ্রুপের সাথে আসি আপাতত। টিকেট কাঁটা নাই, যদি ঝামেলা করে? চিন্তায় পড়ে গেলাম বেশ। কিন্তু আমাকে বাচাতেই কিনা কে যানে, দুম করে, কোন পূর্বাভাস ছাড়াই কালো মেঘে ঢেকে গেল পুরো ভ্যালী সহ আসে-পাশের সমস্ত পাহাড়। ঢেকে গেল দূরের সমস্ত বরফ পাহাড়ের রূপ নিমেষেই। আর আমাদের আশ্রয় নিতে হল ফেলে আসা গাড়িতে, যেটা বেশ আগেই চলে এসেছে এই চেক পোষ্টের কাছে।
কোন রকমে আমাদেরকে নামিয়ে নিজেদের মত করে ধাক্কা দিয়ে, পাথর দিয়ে, গাছের বাকল কেটে, মাটির তলায় দিয়ে চাকাকে চলার উপযোগী করে সেই খাদের ভিতর থেকে। এরপর এমন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল যে, সেখানকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী আজকে আর ফালুট না যাবার পরামর্শ দিল। ওদিকে রাস্তা নাকি আরও বেশী খারাপ। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ আর ফিরতে পারা যাবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়, ড্রাইভাররাও!
যে কারণে একদম ফালুট আর যাওয়া হলনা। ফিরে আসতে হল সেই ঝড়ো আবহাওয়ায় ধীরে-ধীরে, খুব ধীরে-ধীরে, সান্দাকুফুর দিকে। যদিও রয়ে গেল ফালুট পুরোপুরি না যেতে পারার ক্ষীণ আক্ষেপ, তবে অপূর্ণতা নেই এতটুকু, নেই কোন অতৃপ্তি, কোন মন খারাপের কারণ।
কারণ আমি মনে করি আর বিশ্বাস করি, সব স্বপ্ন, সব চাওয়া, সব আকাঙ্ক্ষা একসাথে পূরণ হতে নেই, উচিৎ নয়! ওতে অহং বারে, অহমিকা হয় নিজের মধ্যে, ধরাকে সরা করে ফেলি আমরা। আমাদের এমনই স্বভাব!
তাই সব কিছুতেই কিছু অপূর্ণতা, একটু আক্ষেপ আর কিছুটা না পাওয়া থাকা উচিৎ, তাতে করে আগামীর জন্য স্বপ্ন বেঁচে থাকে, নতুন কল্পনার রঙ লাগাতে ইচ্ছা করে, আর বাভনা গুলো ফিকে না হয়ে গিয়ে, নিজেদের ডালপালা মেলতে থাকে, নতুনের সম্ভাবনায়। জীবনকে আরও আরও নতুন ভাবে, নতুন যায়গায়, নতুন অভিজ্ঞতায় সাঁজাতে সাধ জাগে।
জীবন নিয়ে ফেরা- দুর্ধর্ষতা! (পরের গল্প) সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গল্প!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৪২