রাতে একটি দুর্দান্ত গোসলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে, চমৎকার একটি গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়েছিলাম। এরপর দিন সকালে, প্রেয়সীর কাছ থেকে অশ্রু ভেজা বিদায় নিয়েছিলাম, এক অনন্য সুন্দরীকে দেখবো বলে!
সকাল হতেই দেখি প্রেয়সী আমার মুখ ভার করে বসে আছে গুমোট হয়ে। চোখের টলমলে অশ্রু ঝরে পড়ছে অবিরত, ডুকরে উঠছে একটু পর পর, চোখের কাজল লেপটে গেছে পুরো মুখ জুড়ে, কপালে টিপ নেই, গালে নেই ব্লাসারের পরম স্পর্শ, ঠোটে নেই গোলাপি লিপস্টিক!
যে সাঁজহীন সাঁজ তার সাথে যায়না একটুও। যে রূপে তাকে দেখিনি কখনো, অভ্যস্ত নই আমি এভাবে তাকে দেখে। তবুও বিদায় নিয়েছিলাম সেই সব সময়ের প্রার্থিত প্রেয়সীর কাছ থেকে এক গভীর অশ্রু ঝরা সকালে, মনকে বেদনায় বিষাক্ত করেই জীপে চেপে বসলাম! আর সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে তার ছলছল চোখ নিয়ে। জীপ চলা শুরু করতেই দু-চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগলো কপোল বেঁয়ে।
উহ সেকি বেদনার বিদায় ছিল, সে সকালে... কেউ জানবেনা, কেউ বুঝবেনা, কেউ দেখবেনা... জানে শুধু সে আর আমি!
জীপে চলতে শুরু করতেই, জীপের অন্যদের সাথে আমাদের টুকটাক আলাপ শুরু হল। সেই আলাপের মাঝেই জানাগেল আমাদের মত আরও দুইজন আছেন যারা সান্দাকুফু ট্রেক করবেন! ওয়াও গ্রেট। আমরা দুইজন খুবই খুশি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই। এমনই তাদের সাথে গাইড নিয়ে আলোচনা করে খরচের পরিস্থিতি বোঝার জন্য জিজ্ঞাসা করতেই জানালো যে গাইডের কোন দরকার নাই, যদি আমরা তাদের সাথে ট্রেক করি! কারণ তারা স্থানীয় নেপালি দম্পতি, গাইড ছাড়াই সব সময় নিজেদের মত করে ঘুরে বেড়ায়। শুধু টিকেটটা কাটতে হতে পারে বড়জোর!
“আহা, আমি তো এইডাই চাই!”
গাইড ছাড়াই যদি যাওয়া যায়, তবে তো অনেকটা খরচ বেঁচে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আজকাল ৮০০/১০০০ এর নিচে কোন গাইড নেই! যেটা আমরা ভেবেছিলাম ৫০০/৬০০! তার মানে জন প্রতি প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা গাইডের খরচ লাগবে, যথাযথ পথে ট্রেক শুরু করলে!
ভ্রমণ সঙ্গীর দিকে তাকাতেই তিনি আমার চাহনির মানে বুঝলেন এবং চোখের অভিব্যাক্তি দিয়েই তিনি তাদের সাথে ট্রেক করার অভিপ্রায় জানালেন! আহা, এবারও চাওয়া আর পাওয়া মিলে গেল! এই না হলে ভ্রমণসঙ্গী?
ব্যাস আমরা দুজন সেই নেপালি দম্পতির সাথে শুকিয়া-মানেভাঞ্জন-ধোত্রে হয়ে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ মুখে চলে গেলাম আমাদের মূল ট্রেক শুরু করার উদ্যেশ্যে। মাঝে মানেভাঞ্জন নেমে সকালের নাস্তা-চা-কফি উপভোগ করা হয়েছিল।
শুরু হল আমাদের স্বপ্নের সান্দাকুফু ট্রেক অভিযান, ধোত্রে থেকে। যে যায়গাটা এক কথায় অসাধারণ নান্দনিকতায় ভরপুর, নীরব-নিশ্চুপ এক পাহাড়ি পাড়া বা গ্রাম।
চারদিকে পাহাড় বেষ্টীত, গ্রামটিও এক পাহাড়ের চুরায়, রাতভর ঝরা বৃষ্টিতে চকচক করছিল চারদিক, পাহাড়-অরণ্য-গাছপালা-সদ্য পীচ ঢালা রাস্তা, বর্ণীল ঘর-বাড়ি। অক্টোবরের মেঘে-কুয়াসার আলিঙ্গনাবদ্ধতা আর সূর্যের লাজুক হাসি মিশ্রিত এক সকালে আমরা খেয়েছিলাম সবজি সুপ আর বিফ মোমো সেই পাহাড়ি গ্রামে।
যেভাবে আমরা গাইড আর রেজিস্ট্রেশন এড়িয়ে ছিলাম...
সাধারনত মানেভাঞ্জনের পরে মেঘমাতে একটি চেক পয়েন্ট আছে সেখানে চেক করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া হয়, কেউ যদি কোনভাবে মানেভাঞ্জনে তাদের অবশ্য আনুষ্ঠানিকতাগুলো শেষ করে না আসেন। ধোত্রে থেকে শুরু ট্রেক শুরু করাতে আমরা মানেভাঞ্জন আর মেঘমা দুটোই এড়িয়ে গিয়েছিলাম একই দিনে। কারণ মেঘমা ওই রুটের বাইরে পড়েছে। সুতরাং প্রথম ও দ্বিতীয় চেক পয়েন্ট অনায়সে পেরিয়েছিলাম আমরা।
এরপরে সকলেই সাধারনত প্রথম দিনের ট্রেক শেষ করে রাত টংলু বা টুমলিং এ। টুমলিং থেকে ঠিক এক কিমিঃ পরে তৃতীয় চেকপোস্ট। এরপর গাইরিবাস পেরিয়ে চতুর্থ চেকপোস্ট। এরপর কায়াকাট্টাতে আর একটি চেকপোস্ট আছে (এখানে শুধু গাড়ির এন্ট্রি করা হয়)। পরের রাত সাধারনত থাকা হয় কালাপোখারিতে। এখানেও ঠিক এক কিমিঃ ট্রেক করার পরে একটি চেকপোস্ট আছে বিকেভাঞ্জন নামক জায়গায়।
আর এই চেকপোস্ট গুলো আমরা পেরিয়েছিলাম এক অন্যরকম চাতুরতায়। যদিও আমরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে ধরা পড়লেই এন্ট্রি করে, টিকেট নিয়ে নেব আর আমাদের নেপালি বন্ধুই আমাদের গাইড বলে চালিয়ে দেব! এভাবেই ওদের সাথে আমাদের কথা হয়েছিল।
তো মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি কিভাবে এতোগুলো চেকপোস্ট আমরা বাঁধাহীন ভাবে পেরিয়ে গিয়েছিলাম আর এড়িয়েছিলাম গাইড বা এন্ট্রি ফিস এর টাকা, সাথে কমিয়ে ছিলাম পুরো ট্যুরের খরচ।
প্রথম দুটি কিভাবে এড়িয়েছি সেটা তো জানলেন আগেই। দ্বিতীয়টি এড়ানোর জন্য আমরা খুব ভোঁরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম, আর কোন রকমে একটু চা খেয়েই, আমাদের ট্রেক শুরু করেছিলাম সকাল ৬ টার মধ্যে যেন সকাল ৭ টার মধ্যে আমরা চেক পোষ্টের বাঁধা পেরিয়ে যেতে পারি।
কারণ ট্রেকার্সরা সাধারনত যেখানে রাতে থাকে, সকালে উঠে সেখানে নাস্তা করে, চা-কফি খেয়ে তারপর তাদের ট্রেক শুরু করে। তাতে করে সকাল ৭:৩০ বা ৮ টার আগে কেউ আর ট্রেক শুরু করতে পারেনা। আর এই কারণে প্রথম চেক পোস্টে পৌছাতে এক ঘণ্টাও লাগলেও ৮:৩০ বা ৯ টার আগে এসএসবিও (যারা চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকেন) ততটা তৎপর থাকেনা। আর এই সুযোগটাই আমরা নিয়েছিলাম প্রতিটি চেক পোস্টে!
আমরা প্রতিদিনের ট্রেক শুরু করেছিলাম সকাল ৬ টার মধ্যে। শুধু মাত্র চেক পয়েন্ট এর লোকজন সকালে উঠে তৎপর হবার আগেই! কারণ এতটা ভোরে সাধারণত কেউ ট্রেক শুরু করেনা। কিন্তু আমরা সেটাই করেছিলাম আমাদের নেপালি বন্ধুর পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা মেনে আর তার পরিকল্পনা অনুযায়ী সাথে থেকে।
যে কারণে আমরা গাইডহীন ভাবে, এন্ট্রি টিকেটের টাকা খচর না করে জয় করেছিলাম সান্দাকুফুর ১২০০০ ফুত উচ্চতার এক অন্যন্য রোমাঞ্চকর চুড়া, সারাক্ষণ এসএসবি আর গাইডহীন ধরা পরে যাবার এক অতিরিক্ত রোমাঞ্চ সাথে করে।
আর একটা কথা, প্রতিটি প্রথম চেক পোষ্টের পরে আর একটি চেক পোস্ট থাকে, যেখানে সাধারনত গাড়ি এন্ট্রি করা হয় অথবা শুধু গাইড গিয়ে নিজের নাম এন্ট্রি করে আসে। যেটাতে প্রতিবার আমরা অন্য দলের সাথে মিশে গিয়ে ট্রেক করাতে, অন্য দলের গাইডের নাম রেজিস্ট্রেশন করাতেই আমাদের আলাদা করে কোন জেরার মুখে পড়তে হয়নি পুরো ট্রেক এর কোথাও।
এভাবেই শেষ হয়েছিল আমাদের পুরো ট্রেক এর একই সাথে দু-দুটো অ্যাডভেঞ্চারের, অদম্য সাহসিকতায় আর হার না মানা মানসিকতায়, শেষ পর্যন্ত কি ঘটে সেটা দেখার নেশায়...!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৪৩