সান্দাকুফু যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করার পর থেকে তিন-চারজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিল, যে তারাও এই একই সময়ে আর একই ভাবে যাবার পরিকল্পনা করছেন। এদের মধ্যে একজন তুষার। তো শেষমেশ যাবার দিনক্ষণ একেবারে চূড়ান্ত হয়ে যাবার পরে দেখাগেল যে তুষার ছাড়া বাকি দুইজন ভিসা জটিলতার কারণে একই সময়ে যেতে পারছেননা।
যেটা প্রায় সকল দলগত ভ্রমণের ক্ষেত্রেই কম-বেশী প্রযোজ্য। এবং যথারীতি আমাদের খেত্রেও তেমন ঘটেছে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত সেই তুষার আর আমি। দুজনে দুজনের আলাদা-আলাদা পথে রওনা হবার আগেই বাস স্ট্যান্ডে একটু দেখা সাক্ষাতের চেষ্টা করলাম।
এর আগে আমাদের কারো সাথে কখনো দেখা হয়নি। পরিচয়, কথাবার্তা, পরিকল্পনা, তথ্যের আদান-প্রদান, পারিবারিক যোগসূত্র সবই এই আজকালকার একমাত্র উপায় ফেসবুকে। তো নিজেদের মধ্যে একটু দেখে পরিচিত হবার স্বার্থে দুজনেই বাস স্ট্যান্ডে দেখা করতে উদ্যোগ নিলাম।
দুজনে প্রায় একই সময়ে যার যার বাসা থেকে বের হলাম। এবং অনেকটা কাছাকাছি সময়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেও গেলাম। আমি একটু আগে আর তুষার আসছে পথে, কথা হল মোবাইলে। আমি তুষারের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি... তুষার এলো। ওকে দেখে আমি বেশ খানিকটা ভড়কে গেলাম আর সাথে অনেকটা অবাক হলাম। কেন ভড়কে গেলাম আর কেনইবা অবাক হলাম? দুটো কারণে...
অবাক হলাম এই কারণে যে তুষারকে আমি বেশ লম্বা-চওড়া আর কিছুটা হোমরা-চোমড়া ধরনের ভেবেছিলাম ফেসবুকের ছবি দেখে আর মোবাইলে বেশ ভারিক্কি ধরনের কথা শুনে, তার উপর সে আবার একটি ব্যাংকের উঁচু পদের কর্মকর্তা বলে কথা! কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবে দেখাগেল তুষার আমার মতই সাইজের অনেকটা! যেটা কিছুটা আশ্বস্ত করলো আমাকে।
এই ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ট্যুর আর ট্রেক প্রসঙ্গে আসি। যে কারণে আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। আমি ভড়কে গিয়েছিলাম ওর পিঠের ব্যাগপ্যাক দেখে। বেশ বড় নয় ঠিক, অনেকটা বড় আর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বেশ ভারি একটা ব্যাকপ্যাক বহন করছে সে। অনেকটা এভারেস্ট অভিযানের ব্যাকপ্যাক ধরনের!
কিন্তু প্রথম সামনা-সামনি পরিচয়ে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করা ঠিক ভদ্রতার পর্যায়ে পরেনা বলে সেই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে সাধারণ পরিচিতি আর একে-অন্যকে আর একটু জেনে, কোথায় কিভাবে দেখা হয়ে ট্রেক শুরু করবো সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে একে অন্যকে বিদায় জানালাম। কিন্তু মাথার মধ্যে কেন যেন ওর ব্যাকপ্যাকের ব্যাপারটা রয়ে গেল! তবে নিজেকে বোঝালাম এই বলে যে......
“ব্যাটা ব্যাকপ্যাকের ব্যাপার তুই কি বুঝবি, তোর কি আর ব্যাকপ্যাক আছে নাকি? তোর তো সেই মান্ধাতার আমলের কালা একটা পিঠে ঝোলানো ব্যাগ, সেটাও নিজের পয়সায় কেনা নয়, অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা পাওয়া! যেটা নিয়ে তুই অফিসে যাস, বেড়াতে যাস, সমুদ্রে যাস, পাহাড়ে যাস, দেশে হোক আর বিদেশে হোক, যেখানেই যাস তুই, ওই সবেধণ নীলমনি সাথে করে আর পিঠে করে নিয়েই যাস! যে ব্যাগের হাতল দুইতা তুই দুবার নিজ হাতে সুঁই-সুতা দিয়ে শেলাই করে নিয়েছিস হে রামছাগল...!! সেই তোর আবার ব্যাকপ্যাক...? হুহ”
ব্যাকপ্যাকের তুই কি বুঝবি? কোনদিন তো বাস্তবে চোখেই দেখিসনি, ছুঁয়ে দেখা তো দূরের কথা! আর কেনা? সে তোর মত কঞ্জুস ভ্রমণকারীর কাম্য নয় আদৌ। ব্যাটা ওটা আধুনিক ব্যাকপ্যাক। দেখতে অমন বড় আর ভারী হলে কি হবে, আসলে ওজনে হালকা আর পিছনে এমন কায়দা করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে যে, ওটা পিঠে নিলে পাহাড়ে হাটতে বা ট্রেক করতে নয়, ইচ্ছা হবে আনন্দে পাহাড়ময় দৌড়াতে! ব্যাকপ্যাক পিঠে পাবার আনন্দে। আর মনে মনে ভাবলাম আমার যদি এমন একটা ব্যাপপ্যাক থাকতো! তবে কত ভাবেই না ভ্রমণকে আরও বেশী করে উপভোগ করা যেত!
আর সেই ব্যাকপ্যাকের উপরেও কি সুন্দর কমলা রঙের রেইন কভার, আহা দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। নিজেকে প্রবোধ দিলাম, শালা কয়টা টাকা খরচ করে যদি একটা রেইন কভারও কিনতাম তবুও একটু ভাব আসতো ট্রেকিং এর সময়! আর তোর শেলাই করা হাতল দুটোও মানুষের চোখ এড়িয়ে কিছুটা অসম্মান কম হত মানুষ আর নিজের কাছে।
যাই হোক, ব্যাকপ্যাকের ভাবনাটা মাথা থেকে চলে গেল, বাস চলে আসাতে। দুজনের দেখা হল পরদিন দার্জিলিং গিয়ে। রাতে রুমে ফিরে ফ্রেস হয়ে দুজনে মিলে বিভিন্ন গল্পের মাঝে, মাথায় তুষারের ব্যাকপ্যাকের কথা জিজ্ঞাসা করেই ফেলি! দাম কত, কোত্থেকে কিনলেন? ব্যাকপ্যাক নিয়ে আরও বেশ কিছু কৌতূহলী প্রশ্ন। তুষার একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিল আর সেই সাথে জুড়ে দিল। তুষারের মা আর বউ, দুজনের ভালোবাসার মিলমিশ হয়ে ব্যাপ্যাকটা বেশ ভারী হয়ে গেছে!
মানে! কিভাবে? আমার কৌতূহল বেড়ে গেল আগের চেয়ে অনেক বেশী। যে কিভাবে দুজনের ভালোবাসার মিলমিশে ব্যাগপ্যাকের ওজন বেড়ে যেতে পারে? কোন ভাবেই মাথায় আসলোনা। সেদিন আর সময় হয়ে না ওঠাতে সেই রহস্য অজানাই থেকে গেল। আর রাত বেড়ে যাওয়াতে ঘুমোতে চলে গেলাম দুইজনে। কাল আবার খুব ভোঁরে উঠে দার্জিলিং থেকে মানেভাঞ্জনের প্রথম শেয়ার জীপ ধরতে হবে।
পরদিন দুজনে উঠে আগের রাত্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী মানেভাঞ্জনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। দার্জিলিং থেকে শেয়ার জীপে করে। যে জীপে বসেই দেখা-কথা এক নেপালি দম্পতির সাথে আর নতুন পরিকল্পনা হল যে মানেভাঞ্জন থেকে ট্রেক শুরু না করে, ধোত্রে থেকে শুরু করা যেতে পারে, তাতে করে গাইড নেবার খরচটা বেঁচে যাবে। আমরাও খচর বাঁচাতে সেই নেপালি দম্পতির সাথে মানেভাঞ্জনের ট্রেকিং এর আনুষ্ঠানিকতা না করে, সোজা ধোত্রে থেকে ট্রেক শুরু করলাম। আর প্রথম দিনের ৭ কিলো ট্রেক শেষ করে, টংলু হয়ে টুমলিং গিয়ে সেদিনের মত ৫ ঘণ্টার প্রথম দিনের ট্রেক শেষ করলাম।
পুরো ট্রেকে তুষারকে ওর মা আর বউ এর ভালোবাসার মিলমিশে বেড়ে যাওয়া ওজনের ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেশ বেগ পেতে দেখলাম। যেটা ওর ব্যাগপ্যাকের প্রতি আমার কৌতূহল আরও বাড়িয়ে দিল। আর সেই কারনেই, টুমলিং গিয়ে, রাতের অখণ্ড অবসরে তুষারের ব্যাগপ্যাকের পোস্ট মরটেম শুরু করলাম, তুষারের আন্তরিক অনুমোদন সাপেক্ষেই। আর সেই সাথে শুরু হল বিস্ময়! একের পর এক ভালোবাসার মিলমিশের বিস্ময়! কি সেগুলো? চলুন দেখি......
ওটা খোলার আগেই নিজে একটু ওজন পরীক্ষা করতে গিয়ে তো হুমড়ি খেয়ে পরলাম নিজের ব্যাগের উপর! এক হাতে সেই দামি ব্যাগপ্যাকের ওজন নিতে না পেরে। এরপর প্রথম চেন খোলার পরেই আর একটা ব্যাগ চোখে পড়লো! যেটা বের করতেই আমি বিস্মিত... কারণ ভিতরের সেই ব্যাগটাই প্রায় আমার নিজের বহনকরা ব্যাগের কাছাকাছি এবং প্রায় সমপরিমাণ ওজনের! কি আছে এতে ভাই?
খুলেই দেখেন না, মা আর বউয়ের ভালোবাসার মিলমিশ! ওহ তাই, তবে তো ওজন হবেই। দুই জনের ভালোবাসা বলে কথা, তাও এমন দুইজনের যাদের ভালোবাসায় কোন খাঁদ নেই আর থাকেওনা। বরং দুজনের অজানা ভাবনায় থেকে কে আপনাকে বেশী ভালোবেসে আর বেশী নিজের কাছে আগলে রাখতে পারবে।
আর তেমন দুজন মানুষের ভালোবাসা যদি একসাথে মিলেমিশে যায়, তো সেই ওজন তো বেশী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটা পাহাড়ে-পাহাড়ে পায়ে হেটে বহন করাও চাট্টিখানি কথা নয়। তো এবার খোলা যাক সেই ব্যাগ। খোলা হল সেই ভালোবাসায় ভরপুর ব্যাগ...
কি আছে ওতে? আসলে বলেন কি নেই ওতে! নাম না বলে কত রকম আর পরিমাণ বললেই বোঝা যাবে। অন্তত ১৫ রকমের খাবার যার ওজন হবে ৩/৪ কেজি! সেই ব্যাগের ভেতরে আবার আছে প্লাস্টিকের আরও বাতাস নিরোধক বাটি, যেন খাবার এতটুকু নষ্ট না হয়ে যায়! বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই এতো এতো খাবার কেন?
ভাই একবার মা আর একবার বউ, দুইজনে দুইবার আমার জন্য অনেক ভালোবাসা মিশিয়ে খাবার কিনে এনেছেন। যার যেটা মনে পড়েছে। যেন শুকনো খাবারের কোন ঘাটটি, না পরে! আর সবই নিতে হয়েছে, তাই এই হালকা ওজন! যেটা আমি বহন করতে পারছিনা বলতে পারেন। “ভাই আপনারা সবাই মিলে এগুলো আগে শেষ করেন, ব্যাগটা একটু হালকা হোক”।
এরপর আর একটা ব্যাগ বের করা হল, সেই ব্যাগপ্যাকের ভেতর থেকে। যার ভেতরে নানা রকম কসমেটিকস রয়েছে, যার মধ্যে এমনকি পাউডারও রয়েছে! যাহা দেখিয়া আমি প্রায় বাঁকরুদ্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ভাই আপনি এই দুরূহ ট্রেকিং এ পাউডার দিয়া কি করিবেন? আর কখন করিবেন? ভাই আমার কথা শুনিয়া কোন কথা না বলিয়া, শুধুই চাহিয়া রহিলেন আর বলিলেন...
“আমি এগুলো ধীরে-ধীরে একে ওকে দিয়া-দিয়া, আমার ব্যাগপ্যাক হালকা করিব ভাই!”
এরপর তাহার সেই ব্যাগপ্যাকের ভিতরে আরও একটি বেশ বড় ব্যাগ রহিয়াছে দেখিয়া, ভঁয়ে কুঁকড়ে গিয়া আমি আর সেই ব্যাগ দেখিবার সাহস সঞ্চয় করিতে না পারিয়া, ভঁয়ে আর আতংকে প্রায় মুষড়ে পরিলাম! এবং নিজের ব্যাগের ওজন এতো ওজনের ব্যাগপ্যাক দেখিয়া মানসিক ভাবে না আবার বাড়িয়া যায় সেই ভয়ে সরিয়া গিয়া নিজের বিছানায় শুইয়া পড়িয়া, তাহার ওজন কমাইবার নিমিত্তে নানা রকম সুস্বাদু খাদ্য চাবাইতে লাগিলাম!
কিন্তু এই চিবাইয়া আর কতইবা ওজন কমানো যায় তাহা বুঝিতা পারিলামনা।
আর এই ভালোবাসার মিলমিশের ভারী ব্যাগপ্যাকের দরুন পরদিন দুপুরে আমি আমার ট্রেকিং এর একমাত্র বাঙালি সঙ্গী হারাইয়া ছিলাম! কারণ ভালোবাসার ভারে পরদিন দুপুরে তুষার ঝরে পরে গিয়ে, বাকি পথ ট্রেক না করে, জীপে সান্দাকুফু চলিয়া গিয়াছিলেন!
আর আমি বাকি পথ প্রায় একা-একাই পাড়ি দিয়াছিলাম কোন সঙ্গী ছাড়াই! সেই ট্রেকের সবচেয়ে ভয়ানক আর ঝুঁকিপূর্ণ পথ ছিল সেটি।
কারণ, ভালোবাসার ভারে, তুষার ঝরে পড়েছিল সেদিন......!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮