টুমলিং, কি সুন্দর মিষ্টি-আদুরে আর আহ্লাদি একটা নাম! অন্তত আমার কাছে তো তাই-ই। প্রথম যখন এই নামটার কথা শুনি, ভেবেছিলাম কোন পাখির বা পাহাড়ি ফুলের নাম। আর এই নামটা প্রথম শুনি মাহমুদ ভাইয়ের সান্দাকুফু অভিযানে। পরে পড়তে গিয়ে জানলাম এটা একটা পাহাড়ি পাড়া বা গ্রামের নাম।
কিন্তু প্রথম কাউকে দেখে যেভাবে ভালোলাগা, ভালোবাসা বা প্রেমে পড়া যায়, ঠিক তেমনি এই প্রথমবার এই নামটি শুনেই ভালোলেগেছিল খুব খুব। আর একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল একদিন এই পাহাড়ি পাড়া বা গ্রামে যাবো, হাটবো-বসবো কিছুটা সময় কাটাবো একান্তে। অনেকটা না দেখে, নাম শুনেই প্রেমে পড়ার মত!
লেখা পড়ে প্রথম ভেবেছিলাম একদম পাহাড়ের আড়ালে, গাছে-গাছে, সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত একটি যায়গা হবে। মানসপটে তেমনই একটি ছবি আঁকা হয়েছিল টুমলিং এর। আর তাই যখন টংলু থেকে টুমলিং এর পথে পাহাড়ের রিজ লাইনের উপরে বিছানো পাথরের পথ ধরে যাচ্ছিলাম, একপাশে খাড়া পাহাড়, এক পাশে গভীর পাহাড়ি খাদের কিনার ধরে, যার ওপাশে আবার রয়েছে বড়-বড় আরও আরও পাহাড়, আরও দূরে হিমালয়ের পাহাড় সারি। মনে মনে খানিকটা রমাঞ্চিত হচ্ছিলাম কল্পনায় আঁকা টুমলিং এর ছবিটার কথা ভেবে। এখান থেকে টুমলিং মাত্র এক থেকে দেড় কিলো।
একটু একটু করে এগোচ্ছি, আর একটু একটু করে শিহরিত হচ্ছিলাম টুমলিংকে দেখতে পাবো বলে। আর সেই রোমাঞ্চ আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন আমাদের নেপালি বন্ধু জানালো আজ আমরা টুমলিং এই রাত্রি যাপন করবো। এটা ভাবতেই পারিনি। শুধু যেখানে টুমলিং এ কিছু সময় কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম, দেখানে একটি দুপুর থেকে বিকেল, সন্ধা এমনকি রাতেও থাকা হবে ভাবিনি। তাই পাহাড়ে ৪ ঘণ্টা হাটার ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়েগিয়েছিল সেই আকস্মিক আনন্দে।
একটি পাহাড়ের চুড়ায় উঠতেই দূরে দেখা গেল, সেই কল্পনার জ্বাল বোনা টুমলিং এর পাহাড়ি পাড়া বা গ্রাম। ওই যে চোখের সামনেই। তবে নামতে হবে এই পাহাড় থেকে, যেতে হবে দুই পাহাড়ের একবারে কোলের মধ্যে। হ্যাঁ আসলেই তাই টুমলিংটা ঠিক ঠিক কোন পাহাড়ের চুড়া নয়, নয় কোন পাহাড়ের পিঠ বা পাদদেশ, এটি ঠিক দুই পাহাড়ের মিলন ঘটিয়েছে, ওরা কোলের দোলা দিয়ে যেন! যার নিচে নেমে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়। আর কাছে-দূরে পাহাড়ের সিঁড়ি সারি সারি সেতো আছেই অপলক চেয়ে ওই টুমলিং এর দিকে। যেন অনেক পাহাড় মিলে দিচ্ছে পাহারা, প্রিয় টুমলিং এর রঙিন ফুল আর বর্ণীল ঘর-বাড়িগুলোকে।
পাথরের পথ ধরে ধীরে-ধীরে, ছবি তুলতে-তুলতে নেমে পড়লাম পাহাড়ের কোলে, টুমলিং এ। গিয়েই চারিদিকের পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি দিলাম। এখানে পাহাড়ের আচরণ এমন যেন, পিছনে ফেলে আসা পাহাড়ের চুড়া আপনাকে বিদায় জানাবে ওর মেঘ আর কুয়াসা দিয়ে, আর সামনের পাহাড় গুলো আপনাকে স্বাগত জানাবে একটুখানি রোদের মিষ্টি হাসি দিয়ে। আর সাথে দেবে খানিক দমকা হাওয়া, আপনাকে মেঘে মেঘে ভাসিয়ে নিতে। ফুলেরা দেবে তাদের নানা রঙ ঢেলে আপনার ক্লান্তি দূর করে সতেজ করে দিতে! সত্যি-ই তাই, গিয়েই দেখুন না?
টুমলিং পৌঁছেই, একটি থাকার যায়গা ঠিক করে, সেখানে ব্যাগ রেখে, বেরিয়ে এলাম এক দৌড়ে, রুমে বসে থাকার প্রশ্নই নেই। সে বাতাস আর ঠাণ্ডা যতই হোক। এরপর টুমলিং এর কোলে দুলে-দুলে, দোল খেয়ে, চুমুক দিলাম ধোঁয়া ওঠা কফিতে। আহ, টুমলিং এর মেঘ, ঘিরে ধরা কুয়াসা, ধোঁয়া ওঠা কফি আর চোখ, মন-প্রাণ জড়ানো সবুজ পাহাড়ের হাতছানি। যেন কোন এক স্বর্গের সীমানায় বসে আছি, তুমি-আমি আর আমি-তুমি।
যেখান থেকে পা নড়েনা,
পা নড়লে, প্রাণ সরেনা,
আর,
প্রাণ সরলেও মন নড়েনা।
এক অদ্ভুত মায়া, আর আবেগের আচ্ছন্নতায় ঘিরে ধরা স্বপ্ন আর কল্পনার বাস্তবে এসে পাশে বসে, কাঁধে হাত রেখে, আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে, শিহরিত করে যাওয়া।
গাইডহীন সান্দাকুফু অভিযান...!! (পরের গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪০