অরণ্যরা কয়েক বন্ধু মিলে ভার্সিটির গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বেড়াতে গেল পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া। ঘোরাঘুরিটা ওদের কয়েক বন্ধুকে এক সুতোয় বেঁধেছে অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও। সময়-সুযোগ আর অর্থের সম্মিলন ঘটলেই ওরা বেড়িয়ে পরে দেশের আনাচে-কানাচে দেশটাকে দেখতে, দুচোখ ভোরে উপভোগ করতে আর হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে।
তবে ওদের এতো এতো বেড়ানোর মধ্যে কখনো তেমন কোন ইট-পাথরের স্থাপনা তেমন একটা স্থান পায়না। পাহাড়-জঙ্গল-সবুজে ছাওয়া প্রকৃতি, সাগর-নদী আর খাল-বিল ওদেরকে সবথেকে বেশী টানে। কখনো কখনো এই বেড়ানোর ও প্রকৃতি উপভোগের নেশা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও নিয়ে গেছে ওদের। বিদেশ বলতে এই ভারত-নেপাল আর ভুটান। এই তিন দেশই ওদেরকে ভ্রমণের পূর্ণতা দিয়েছিল সব রকমভাবে।
দেশের সব না হলেও প্রায় অনেক অনেক কিছুই ওদের দেখা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তাই এই তিন দেশের মধ্যে ভারত ওদেরকে সবথেকে বেশী তাড়িত করে, আকুল করে আর করে ভীষণ ভীষণ অবাধ্য। কারণ অন্য দুই দেশে স্বাভাবিক ও সহজ ভাবে যেতে হলে বিমানে যেতে হয়। যে কারণে প্রচুর টাকা লাগে শুধু বিমান ভাড়ার জন্যই। যে বিমান ভাড়ার টাকা দিয়েই অন্তত দুইবার ভারতে ভ্রমণ সম্ভব! পাশাপাশি কম খরচে অনেক অনেক বেশী যায়গা দেখা সম্ভব। তাই ওদের ভ্রমণের প্রথম ও প্রধান পছন্দ ভারত।
কিন্তু আজকাল ভারতের ভিসা পাওয়া অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত দুর্লভ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আর দেশের সকল উল্লেখযোগ্য স্পটেই ওদের যাওয়া হয়েছে বিধায় এবার ওরা একটি ভিন্ন লোকেশন আর স্বাভাবিক ভাবে ভ্রমণের জন্য তেমন একটা জনপ্রিয় নয় এমন যায়গা বেছে নিল। পঞ্চগড়ের তেতুলিয়াতে গড়ে ওঠা সমতলের চা বাগান।
সবাই মিলে পঞ্চগড় থেকে একটি মাইক্রো ভাড়া করলো আগামী কয়েকদিনের জন্য সব সময় ওদের সাথে থাকবে আর যখন যেখানে খুশি যেতে পারবে এই ভাবনায়। এশিয়ান হাইওয়ের মসৃণ পথ ধরে ছুটে চলেছে অরণ্যদের গাড়ি। হুহু বাতাসে গরম তখন দূরে পালিয়েছে। রাস্তার দুই পাশের অবারিত প্রান্তর জুড়ে সবুজ গাছে সোনালি ধান, কোথাও তিলের ক্ষেত, কোথাও তরমুজের আবাদ আর সবচেয়ে বিসৃত ব্যাবসা মাটির তলা থেকে পাথর তুলে তার বিকিকিনি।
সেসব ছাড়িয়ে ওরা পৌঁছে গেল ওদের কাঙ্ক্ষিত লখ্যের প্রায় কাছাকাছি। তেতুলিয়ার প্রবেশ দার। আর কয়েক মিনিট গাড়ি ছুটে যেতে না যেতেই চোখে পড়লো রাস্তার পাশ ঘেঁসে সাদা সাদা পিলারে ভারত আর বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণের লেখা। এক অদ্ভুত সুখের শিহরণ ছুঁয়ে গেল অরণ্যকে! কি যেন হয় অরণ্যর ভ্রমনে বেরোলেই ভুলে যায় নাওয়া-খাওয়া সহ অন্য সকল পার্থিব অনুভূতি গুলোর। অদ্ভুত আর অজানা এক আচ্ছন্নতায় ডুবে যায় সে।
সেই আচ্ছন্নতায় ডুবে থাকতে না থাকতে ওকে কেড়ে নিল ওর কাছ থেকে আরও পাগল করা সবুজ প্রকৃতি। রাস্তার দুই ধাঁরে শুরু হয়েছে অমোঘ মুগ্ধতার সবুজ চা বাগান, বাতাসের খেয়াল যেন ঢেউ উঠেছে সেই চা বাগান জুড়ে! এক সীমাহীন সবুজের ঢেউ যেন! অবাধ্য আর পাগুলে আরণ্যকে বেঁধে রাখবে সাধ্য কার? এক রকম জোর করেই গাড়ি থামালো সে। নেমে নয় লাফিয়ে পড়লো গাড়ি ঠিকঠাক থামার আগেই। দিগন্ত জোড়া সবুজ চা বাগানের অদ্ভুত আকর্ষণে।
নেমেই দে ছুট, দে ছুট ওই সবুজ সমুদ্রে, সুখের অসুখে! আহা কি দারুণ কচি সবুজ চা পাতায় সূর্যের আলো পরে হলুদ রঙ ধারন করেছে! চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দাড়িয়ে থাকা আমলকী গাছের ছোট ছোট ডাল ও পাতার ফাঁক গলে ঝরে পড়ছে সোনা রোদ্দুর, সদ্য সেচ দেয়া চা পাতার ডগায় জমে থাকা পানির কণায় রোদের ঝিলিক পরে জ্বলজ্বল করছে মুক্ত দানার মত! সাথে মাতাল করা বাতাস, সে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। এই মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে অরণ্য যেন উন্মাদ প্রায়। ছবি তুলছে, ছুটছে-দৌড় আর ঝাঁপে মত্ত। আর এইসব উন্মাদনার মাঝে সে পেরিয়ে যেত থাকলো বাংলাদেশ আর ভারতের “নো ম্যান্স ল্যান্ড” এর নিরাপদ এরিয়াটুকুও।
রাস্তার ওপর থেকে অরণ্যর বন্ধুরা আর রিক্সায় ছুটে চলা পথ যাত্রীরা অরণ্যকে নিষেধ করতে লাগলো আর সামনে না এগোতে, কারণ ওপারে বিএসএফ যে কোন সময়ে গুলি করে দিতে পারে, কাটা তাঁরের ওপরে দাড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা চৌকি থেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অরণ্যর নেশায় পেয়েছে আজ সবুজের অবগাহনের আর সেলফি তোলার নেশায়। সবুজ সমুদ্রে সাতারের সাথে সাথে চলছে অরন্যার সেলফি তলা অবিরাম।
কাটা তাঁরের বেড়ার কাছাকাছি গিয়ে থমকে গেল অরণ্য, যেতে বাধ্য হল আসলে। কাটা তাঁরের ওপারে রঙ বেরঙের তাবু ফেলা হয়েছে চা বাগানের ভিতরের কিছুটা ফাঁকা জায়গায়। অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের সমাগম সেথায় বর্ণিল এক আয়োজন। ওপারের কোন এক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সফরে এসেছে ওরা, আমলকী গাছে ঝোলানো ব্যানার দেখে বুঝলও অরন্য। ব্যাস আরও কিছু ছবি তুলল অরণ্য চা বাগানের স্বর্ণালি সবুজের, আমলকী গাছের, কচি সবুজ পাতায় জমে থাকা শিশির কণার, আর নিজের সাথে সবুজের মানে সেলফি!
শেষমেশ চলে যেতেই হল বন্ধুদের হাঁকডাক, অস্থিরতা আর অনিরাপদ পথের বিপদে পড়া থেকে রেহাই পেতে। চলে গেল সবাই গাড়িতে করে। বাকিদিন ঘুরে ঘুরে বাংলোতে এলো ওরা শেষ সন্ধায়। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর ছবি তোলার শেষে যেটা সাধারণত হয়ে থাকে সবাই ছবি দেখার জন্য বেশ অস্থির থাকে, কিন্তু মোবাইল বা ক্যামেরাতে স্বভাবতই চার্জ থাকেনা। যে কারণে সবাই সব কিছুতে চার্জ দেবার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। এবং কোন মতে সব কিছু চারজিং এ দিয়ে ফ্রেস ও খাওয়া-দাওয়া শেষ করে স্বচ্ছ টাইলসের ঝকঝকে ও খোলা বারান্দায় গা এলিয়ে দিল। ক্লান্তি সবাইকে এতটাই ঘিরে ধরেছিল যে বাধ্য হয়ে যে যার বিছানায় চলে গেল। আর অরণ্য বসেছিল নির্মল প্রকৃতির সবটুকু সাধ উপভোগের লোভে।
প্রায় ঘণ্টাকাল কেটে যাবার পরে অরণ্য মোবাইল অন করলো। ছবি গুলো দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শুরু থেকে দেখতে দেখতে চা বাগানের ছবির কাছে আসতেই অরণ্যর চোখ আটকে গেল ছবি গুলোর দিকে! অরণ্যর সেলফির সাথে পিছনে তার কাটার সাথে দাড়িয়ে ছিল কোন মানবী! নীল স্কাট, সর্ষে হলুদ জামা, লাল ওড়না আর কমলা ক্যাপ পরে! সেতো এটা খেয়ালই করেনি ফেলফি তোমার সময়! আবছা ছবিতেও বোঝা যাচ্ছে দেখতে মন্দ হবেনা আদৌ! আর “নো ম্যান্স ল্যান্ড” এবং তার পরের কাটা তাঁরের ওপাশে আছে বেশ কিছু রঙ-বেরঙের তাবু খাটানো। তার মানে ক্যাম্পিং এ এসেছে ওপারের কোন যায়গা থেকে। তবে তো দেখতে হয় আর একবার গিয়ে, কাল সকালে।
দুইঃ
পরদিন ভোর হতে না হতেই অরণ্য ফিরে এলো সেই চা বাগানের কাছে। দেখছিল সবুজ চা পাতার উপরে জমে থাকা মুক্ত দানার মত শিশিরের কণা, তখনো সূর্য তার আলো ছড়ানো শুরু করেনি। চারদিক তখনো অনেকটা অন্ধকার। চুপচাপ শিশিরের ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ শুনছিল সে, পাখিদের হেয়ালি গুঞ্জন, পাশের বাঙালি পাড়া থেকে ভেসে আসছিল শুকনো পাতা পোড়ার তাজা ঘ্রাণ! কোন কৃষক বা মজুরের সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে আপন মনে বেজে ওঠা বেলের টুংটাং শব্দ। চা গাছের পাতায় জমে থাকা জলের কণায় ভিজে যাচ্ছিল অরণ্য। হঠাৎ অরণ্য থেমে গেল, এই নির্জনতার মাঝে পেয়ে নূপুরের শব্দ!
শব্দ শুনে চোখ ফেরাতেই দেখে ওপাশে কাটা তাঁরের গাঁয়ে গাঁয়ে হেটে বেড়াচ্ছে এক রূপসী। নীল জামা, লাল ওড়না, মাথায় হলুদ ক্যাপ আর পায়ে নূপুরের ছন্দ তোলা কোন মানবী। সব কিছু যেন থেমে গেল অরণ্যর এক নিমিষেই। স্থবির হয়ে গেল অরণ্য দেখে সেই রঙিন আর বর্ণিল রূপসীকে। এখন শুধু চেয়ে থাকা আর নূপুরের শব্দ শোনা। এখনো তেমন রোদ ওঠেনি, আঁধার কমেছে কিছুটা মাত্র। শুধু তার কাঁটার ওপাশে এক মানবীর বর্ণিল বিচরণ স্পষ্ট! স্পষ্ট তার নূপুরের শব্দ, তার ঘুম ভাঙা সকালের অগোছালো এলো চুল আর আকর্ষণীয় অবয়ব!
অরণ্য এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওপারে, দাড়িয়ে “নো ম্যান্স ল্যান্ডে” ধীরে ধীরে আলো ফুটছে পূবের রক্তিম আকাশকে রঙিন করে। চা বাগানের অন্ধকার মুছে গিয়ে আলোকিত হল মুহূর্তেই। অরণ্য আরও অবাক হল দেখে সেই মানবীকে! আসলেই দারুণ আকর্ষণীয় আর অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে দেখতে এই দূর থেকেই! তবে মেয়েটি বেশ কাছাকাছি আছে ওপারের কাঁটাতারের। একা একা হাঁটছে আর হয়তো গুনগুন করে গাইছে কোন রবীন্দ্র বা নজরুল, ভাবছে অরণ্য তেমন। হারিয়েছিল কোন এক স্বপ্নিল মায়াজালে।
আচমকা অরণ্যর খেয়াল ভাঙলো কোন স্বপ্নময়ীর রিনিঝিনি ডাকে। কে ডাকে অরণ্যকে? নাহ কেউ না, ওটা খেয়াল ওর। কে ডাকবে এখানে? আবার ডাক, না কারো নাম ধরে নয় “হ্যালো এই যে শুনছেন!” এভাবে! অরণ্য পাশ ফিরে তাকাতেই বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেল! ওপারের সেই মানবী তারকাটার একদম কাছে এসে ডাকছে ওকে। মানবীর পাশেই হেটে যাচ্ছে সতর্ক পাহারার বিএসএফ জওয়ান। তাই অরণ্য কথা বলতেও ভঁয় পাচ্ছে, পাছে গুলি করে দেয়!
সেকি সাড়া দেবে না দেবেনা ভেবে পাচ্ছেনা। অবশেষে ওপারের মানবী-ই বলল, কাছে আসুন আপনার সাথে একটু কথা বলি, আপনাকে কেউ কিছু বলবেনা, এখানকার গার্ডরা আমার পরিচিত। আসুন এগিয়ে আসুন।
সত্যি বলছেন? অরণ্যর জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ কোন সমস্যা নেই, আপনি তো বাংলাদেশী তাইনা?
হ্যাঁ বাংলাদেশী, আপনি কি জলপাইগুড়ির? কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল অরণ্য......
হ্যাঁ কলেজের বন্ধুদের সাথে শিক্ষা সফরে এসেছি, আপনি?
আমিও বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছি।
আপনার বন্ধুরা কোথায়?
ওরা বাংলোতে।
ওহ আচ্ছা, আপনি একাই এসেছেন এখানে? এই আঁধারে! কেন, চা বাগান খুব ভালোবাসেন বুঝি? জানেন এখানে আসার আগে মানে এই সীমান্তে মনে মনে ভেবেছিলাম কোন বাংলাদেশীর সাথে যেন দেখা হয়, কথা হয় আর সম্ভব হলে যেন একটুখানি বন্ধুত্ত! ইস এভাবে, এই ভোর বেলাতে যে কারো সাথে দেখা বা কথা হবে ভাবতেই পারিনি। আপনাকে একটা থ্যাংকস! আচ্ছা এই সাত সকালে আপনি এখানে কেন এলেন? কিসের টানে, পরেও তো আসতে পারতেন বন্ধুদের সাথে? উহু আমি একা একাই বক বক করে যাচ্ছি, আপনাকে তো বলার কোন সুযোগই দিচ্ছিনা! বলুন, এবার আপনি বলুন।
অরণ্য স্তম্ভিত, কি করবে আর কি বলবে সেটা বুঝতেই পারছেনা। অরন্য চেয়েছিল একটি মেঘ, মেঘের ফাঁক গলে একটু আলো, আর সেই আলো কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে সামান্য বৃষ্টি! কিন্তু একি হল? এ যে প্রথমে ঝকঝকে রোদ আর তারপর মুহূর্তেই মুষলধারে বৃষ্টি! এতটা তো অরণ্য ওর সুদুরতম কল্পনাতেও ভাবেনি। কি বলবে অরণ্য, সত্য বলবে নাকি মিথ্যে? কেন এসেছে এখানে অরণ্য।
অরণ্য এবার বলতে লাগলো, ওরা বেড়াতে এসেছে শুধুমাত্র। পুরো দেশ মোটামুটি দেখেছে তাই এবার এই অন্যরকম জায়গাটাতে এসেছে সমতলের চা বাগান দেখবে বলে। আর কাল এখানে নেমেছিল ছবি তুলেছিল। রাতে সেই ছবি দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো রঙিন কিছু তাবু ও ক্যাম্প সাইট! তাই ওর খেয়াল চাপলো এখানে এসে যদি কারো সাথে দেখাহয়, একটু কথা হয় আর সেই সুযোগে যদি একটু ভারতে যাওয়া যায় সেই রোমাঞ্চে ও এখানে এসেছে।
বাহ বেশ তো, তবে আপনার এপারে আসার আশা পূরণ হবে বলে মনে হয়না। তবে আমরা যে কদিন এখানে আছি, আপনি “নো ম্যান্স ল্যান্ড” পেরিয়ে এই তারকাটা পর্যন্ত আসতে পারবেন সেই ব্যাবস্থা আমি করতে পারি, অবশ্য যদি আপনি চান?
হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, আমি চাই, আসতে চাই এই স্বর্গময় চা বাগানকে ভীষণ ভীষণ ভাবে উপভোগ করতে চাই। আর সাথে বা কাছাকাছি যদি আপনার মত কেউ থাকে তো কথাই নাই আর। আমাদের অনেকদিনের ছুটি যে কদিন ভালো লাগবে এখানে সেই কদিন থাকবো, এমন প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি এখানে। আপনারা কদিন থাকবেন?
আমরা প্রায় ৫ দিন থাকবো তার একদিন চলে গেছে গতকাল আর চারদিন। হ্যাঁ আমরাও আছি তো বেশ কদিন।
ও হ্যাঁ আমি অধরা, অনার্স শেষ বর্ষে আছি, আপনি?
আমি অরণ্য! মাস্টার্স করছি।
বাহ দারুণ মিল তো আপনার আর আমার নামে, অরণ্য আর অধরা! নিন আমরা বন্ধু, অধরা তার কাঁটার ফাঁক দিয়ে সন্তর্পণে বাড়িয়ে দিল তার ডান হাত! অরণ্য ছুঁয়ে দিল ওকে! হাত ছোঁয়াল ওর হাতে! এক অজানা আর অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হল ওরা দুজন, এক অচেনা সুখ ছুঁয়ে দিল ওদের দুজনকে! এতো অল্প পরিচয়েও কি কোন মায়া জন্মাতে পারে কারো প্রতি? কি জানি, কে জানে?
কিন্তু ওদের মায়া জন্মেছিল এক অদ্ভুত টান আর আকর্ষণে প্রতি। এক সোনা ছড়ানো রোদেলা সকালে সবুজে সবুজে ছেয়ে যাওয়া প্রান্তর আর অপার ভালোবাসার চা বাগান জুড়ে! ওদিকে অধরার ডাক পড়লো! চলে যেতে হল ওকে তড়িঘড়ি করে। অধরা আবার আসতে বলল অরণ্যকে শেষ বিকেলের আলো-আধারিতে ওরা কথা বলবে, এও বলল ওর খুব ভালো লেগেছে অরণ্যর সাথে কথা বলে, দেখা হয়ে আর সবথেকে ভালো লেগেছে অরণ্য, অধরার বন্ধু হওয়াতে!
চলে গেল অধরা চা বাগানের সরু রাস্তা ধরে ওদের ক্যাম্প সাইটের দিকে। আর অরণ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অপলক ওপারের চা বাগান আর অধরার চলে যাওয়ার দিকে। সবুজ চা গাছের মাথায় ছুঁয়ে যাওয়া অধরার লাল ওড়নার দিকে। যেন কোন এক ভীষণ সুখের স্বপ্ন দেখছিল অরণ্য এতক্ষণ ধরে! বোধ অরণ্যর লুপ্ত আর চেতনা তখন শূন্য, যেন ভেসে চলেছে অরণ্য কোন এক অজানা সুখের ঢেউ খেলানো নদীতে!
আবার শেষ বিকেলে এখানে ফিরে আসার আকুল আহবানের টানে চলে গেল তখনকার মত, তবে বারে বারে চাইছিল পিছু ফিরে। ক্ষনিকের সুখ স্বপ্নের পানে, অচেনা সুখ আর অপার আনন্দের পানে, অরণ্য চলে গেল পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা ধরে, শেষ বিকেলের আমন্ত্রনে!
একটা মোহের মধ্যে বাংলোতে গিয়ে পৌঁছালো অরণ্য। যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে রুমে ঢুকলো ঠিক ততটাই মর্মাহত হল কয়েক মুহূর্তেই! কারণ, অন্যান্য বন্ধুরা মিলে ঠিক করেছে এখানে আর দেখার তেমন কিছু নেই, তাই আজ রাতের বাসেই ফিরে যাবে! না হলে অন্তত আগামীকাল সকালে তো ফিরে যাবেই যাবে! কিন্তু অরণ্য? অরণ্যও কি যাবে ফিরে ওর বন্ধুদের সাথে? এদিকে অরন্য যে বাঁধা পড়েছে এক অন্য মায়ায়।
তিনঃ
কে যাবে আর কে থাকবে এ নিয়ে বন্ধুদের সাথে অনেক বিতর্ক আর মনোমালিন্য হল শেষ পর্যন্ত! কে থাকবে আর কে থাকবেনা সে অরণ্য জানেনা, আর জানতেও চায়না! অরণ্য এখনি মানে আগামী দুই একদিনের মধ্যে এই তেতুলিয়া চা বাগান আর সেই বাগানের মায়া ছেড়ে যাবেনা, সেটা জানিয়ে দিল স্পষ্ট করে!
ব্যাস এরপর যা হবার তাই হল, পরদিন সকালে ওর বন্ধুরা চলে যাবে তাই টিকেট কাটল বিকেলে আর অরণ্য সারাদিন রুমে শুয়ে বসে থেকে মহানন্দার পাড়ে সময় কাটিয়ে বিকেল হতেই সেই মায়ায় মাতাল করা সবুজ চা বাগানের রঙিন আহ্বানে!
অধরা দাড়িয়ে ছিল “নো ম্যান্স ল্যান্ডে!” তাই দেখে অরণ্য অভিভূত! তবে কি অধরারও একই রকম আকর্ষণ আছে! কি জানি নেই হয়তো? তবে দাড়িয়ে ছিল কেন? নিজের কাছেই নিজের জিজ্ঞাসা। এভাবে “নো ম্যান্স ল্যান্ডে” কিছুটা আড়ালে ওরা দেখা করলো পরের দুই দিন সকালে আর বিকেলে পালা করে। একজন কাটা তাঁরের ওপারে আর একজন এপারে! বিনিময় হল দুজনের মোবাইল নাম্বার আর অতি আবশ্যিক ভাবেই আজকালকার সবচেয়ে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডি! তাই দেখা দুই বেলা হলেই কথা হতে থাকলো সারাক্ষণই! তিন দিনেই ওরা জেনে গেল একে অন্যের অনেক অনেক কিছুই। টানও জন্মালো একের প্রতি অন্যের! এরপর ফিরে যাবার সময় হল দুজনেরই। যার যার জায়গায়, যার যার আবাসে ছেড়ে ওদের বন্ধুত্তের আর আবেগের সবুজ ভূমি “নো ম্যান্স ল্যান্ডে!”
ফিরে ওরা গেল ঠিক-ই, কিন্তু বন্ধুত্ত, যোগাযোগ আর নিয়মিত খোঁজ খবর থেকে নেই একদিনের জন্যও! ফেসবুক আছেনা! অধরার কতটা কি অবস্থা জানেনা তেমন, কিন্তু অরণ্য হন্যে হয়ে উঠলো ভারত যাবে। অধরাও সম্মত ভারতে যেতে পারলে ঘুরে বেড়াবে অরণ্যর সাথে। জলপাইগুড়ি থেকে ওরা যাবে কাছেই দার্জিলিং, সেখান থেকে রিশপ-লাভা আর শেষ বেলায় ঘুরে আসবে টুমলিং হয়ে সান্দাকুফু! অধরার একা একা বন্ধুদের সাথে বাইরে যাবার তেমন একটা বাঁধা নেই। আর ওদিকে চেনা-জানা বন্ধু আর আত্মীয়ও আছে ওর। তাই শুধু অরণ্য যেতে পারলেই হয়!
অনেক অনেক চেষ্টা করে অরণ্য কোন ভাবেই ভিসা করতে পারেনা! ফরম পূরণ করে তো, জমার তারিখ পায়না, জমার তারিখ কোন ভাবে নিতে পারে তো, এম্বাসি তেমন কোন কারণ না দেখিয়ে পাসপোর্ট জমা রাখেনা, আবার কখনো জমা রাখে তো, কোন কারণ ছাড়াই ভিসা দেয়না! এক অসম্ভব, অদ্ভুত আর নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় অরণ্য! ভারত যাবার জন্য, অধরাকে কাছ থেকে দেখার জন্য, ওর সাথে সান্দাকুফু যাবার জন্য ছটফট করে সারাক্ষণ, কিন্তু ভিসা জটিলতা কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা অরণ্যর!
একটি ভিসার জন্য প্রায় পাগল হয়ে ওঠে অরন্য, এখানে সাহায্য চায়, ওখানে সাহায্য চায় কিন্তু সহজ কোন সমাধান সে পায়না। অবশেষে বেশ কিছু টাকা দিয়ে, দালাল ধরে একটি ফরম পূরণ করে জমা দানের তাখির পায়, কিন্তু সেই বারও ভিসা না পেয়ে এম্বাসিতে ঝামেলা করে অনেক অনেক! এমনকি পুলিশী হয়রানীর স্বীকারও হতে হয়! পাসপোর্ট জব্দ করে! অপদস্ত করে অনেকভাবেই! তাই বিমর্ষ অরণ্য অধরাকে জানায় সে আর আসতে পারছেনা ভারতে! ভিসা পাচ্ছেনা আর হয়তো পাবেওনা সহসা!
সব জেনে অধরা মন ভেঙে যায়, সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে অরণ্যকে দেখতে, কথা বলতে, পাশাপাশি হাটতে আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে বসে রঙিন স্বপ্ন দেখতে! নাহ, এই ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপ বা ভাইবারে নয়, সামনা সামনি দেখতে চায় অরণ্যকে! অরণ্যর ও কি তেমন করে নয়! কিন্তু কিভাবে? শেষমেশ অধরার পরামর্শ আর ব্যাকুলতার কাছে হার মেনে ওরা আবার তেতুলিয়ার সেই “নো ম্যান্স ল্যান্ডে!” দেখা করার জন্য ঠিক করে!
অরণ্য কোন ক্রমে ছুটি নিয়ে ছুটে যায় অধরার কাছে! দেখাহয় ঠিক আগের মতই, সেই “নো ম্যান্স ল্যান্ডে!” কাঁটাতারের দুইপাশে দুইজন, ক্ষণিকের আয়োজন যা ওদেরকে আরও অস্থির আর উন্মাদ করে তোলে! কাছে পেতে, পাশে বসতে, হাত ধরে হাটতে, সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে! কিন্তু বাঁধা? সেই কাঁটাতার! এ যেন “সীমান্তে নয়, হৃদয়ে কাঁটাতার!”
আবারো ফিরে যায় ওরা ওদের নিজ নিজ আবাসে! অধরা অরণ্যকে আবারো চেষ্টা করতে বলে ভিসা পেতে আর ভারতে যেতে! অরণ্য ফিরে এসে আবারো হন্যে হয়ে ওঠে ভারতের ভিসা পেতে! কিন্তু এখন সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়, আগে যেখানে কিছু টাকা দিয়ে ভিসার নেবার বা পাসপোর্ট জমা দেবার তারিখ পাওয়া যেত, সেটা এখন বেড়ে গেছে বহুগুণ! তাও সেই টাকা দিয়েও ভিসা পাবে কি পাবেনা সেই নিশ্চয়তা নেই!
অথচ অধরা আর অরণ্যর প্রাথমিক সেই বন্ধুত্ত এখন আর শুধু বন্ধুত্তে সীমাবদ্ধ নেই! হয়ে গেলে ভালোলাগা, ভীষণ ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকে ওরা বাঁধা পড়েছে একে অন্যের এক আকুল প্রেমের বাঁধনে! কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারেনা আর চায়ওনা! ওদের সমস্ত অবসর এখন শুধুই দুইজনের! একান্তে কথা বলার, হাসার-কাঁদার-বেদনার আর কবে ভিসা নিয়ে একে অন্যের কাছে যেতে পারবে সেই স্বপ্নের!
অরণ্যর এইসব ছেলেমানুষী আর ভীষণ পাগলামি দেখে ওর বন্ধুরা বিভিন্নভাবে উপায় খুঁজতে থেকে কিভাবে ভারতের ভিসা পাওয়া যেতে পারে কিছুটা সহজে! তাই আজকালকার বিভিন্ন ভ্রমণ গ্রুপে খবর নিতে থাকে আর বিভিন্ন উপায় বের করার সাহায্য চায়।
ধীরে ধীরে অরণ্য আর অধরার এই অবাধ্য ভালোবাসা জেনে যেতে থেকে একে একে সবাই, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে! আর এরই প্রভাবে একদিন একটি বড় ট্র্যাভেল গ্রুপ থেকে গণ মেইল কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়! ভারতীয় এম্বাসিতে হাজার নয়, লাখ লাখ মেইল পড়তে থাকে ভিসা সহজীকরনের জন্য, দুর্নীতি আর অনিয়মের বেড়াজাল থেকে ভিসা প্রক্রিয়াকে মুক্ত করার জন্য! যা নজরে আসে বিবিসির মত গুরুত্তপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমের! যে সংবাদ প্রচারে টনক নড়ে ভারতীয় কর্তা ব্যাক্তিদের! কেন্দের।
তাই তারা ঘোষণা দিয়েছে এম্বাসির নতুন ভবন উদ্বোধন উপলখ্যে কিছু দিনের জন্য ভিসা প্রক্রিয়াকে সহজ করবে, কোন তারিখ ছাড়াই ফরম পূরণ করে জমা দিলেই মিলবে বা মিলতে পারে ভারতের ভিসা! আর এই খবরে আনন্দে-উচ্ছ্বাসে আর আবেগে আত্নহারা অরণ্য আর অধরা!
দেখা হবে, কথা হবে, পাশাপাশি বসা হবে, হাতে হাত রাখা হবে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা যাবে, আর হারিয়ে যাওয়া যাবে দুজন দুজনের মাঝে......
কোন এক পাহাড়ে অথবা অরণ্যে, সমুদ্রে নাহয় বরফের রাজ্যে......!!!
হবে কি অরণ্য আর অধরার অপেক্ষার অবসান? পেয়ে ভিসা, গিয়ে ভারতে, এড়িয়ে কাঁটাতারের বাঁধা আর “নো ম্যান্স ল্যান্ড”?
কে জানে?
তাই আপাতত শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা......
অরণ্য আর অধরার ভালোবাসার, কাছে পাবার, অজানায় হারাবার......
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৮