শুক্রবার সকাল ১০ টা। বাসার বাজারকারি বাজারে গেলেন। তিনি শুক্রবার সাধারণত বাজারে যাননা। কারণ শুক্রবারের বাজারটা তার সাথে তেমন একটা যায়না, না সামরথে, না সঙ্গতিতে, না মানসিকতায়! তবুও সেদিন শুক্রবার সকালে তাকে বাজারে যেতে হল, একান্ত নিরুপায় হয়ে। শূন্য বাসার, নিশুন্য আর খটখটে ফ্রিজের দিকে তাকিয়ে।
বাজারে গেলেন তিনি, এমনিতে শুক্রবারের বাজারটা তার ভালোই লাগে, বেশ জমজমাট। দেখতে রংবেরঙের মানুষ, শুনতে তাদের হাজারো ঢঙের চিন্তা-ভাবনা আর তার চেয়েও ভালো লাগে, দেখতে বর্ণিল সব সবজিঃ সবুজ করলা, লাল টমেটো, হলুদ কুমড়ো, লাল-সাদা আলু আরো কত রকমের তরতাজা তরকারী। বিশেষ করে ভালো লাগে তাজা তরকারীর উপরে ছিটিয়ে দেয়া পানির ফোঁটা গুলো যখন শিশিরের কনার রূপ নেয়! আর এতো কিছুর মাঝে তার সবচেয়ে আকর্ষিণীয় হল খুঁজে খুঁজে দারুণ রঙিন ক্যাকপ্সিক্যাম দেখা! কি সুন্দর লাল-হলুদ আর সবুজ! কোন কোনটা আবার দুটি বা তিনটি রঙের মিশ্রণ!
এসব দেখে সে পা রাখে, বিশাল মাছ বাজারের দিকে। যেখানে সমস্ত রকমের মাছ পাওয়া যায় সব রকমের রূপে। পানিতে ছটফট করছে, চঞ্চল হয়ে লাফঝাঁপ দিচ্ছে, কোন কোনটা জীবন প্রায় অস্তাচলে কোন রকমে নড়াচড়া করছে, কোন কোনটা একেবারেই নিস্তেজ। এভাবে বাজার ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা জায়গায় গিয়ে দাড়িয়ে গেল সে নিজের অজান্তেই। দারুণ ছটফটে ট্যাংরা, চিংড়ী, শিং, কই, মাগুর, চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা আর পুঁটির বহর দেখে! ইচ্ছে হচ্ছিল যা লাগে লাগুক কিনে নিক কিছু এক্ষুনি।
দাম জিজ্ঞাসা করবে ঠিক এমন সময় পাশ থেকে মধ্য বয়স পেরিয়ে গেছে এমন একজন ধপধপে কাপড় আর চকচকে চশমা পড়া লোক এসে মাছ বিক্রাতেকে শুধু জিজ্ঞাসা করলো কি কি মাছ আছে? যদিও সব মাছ উন্মুক্তই ছিল! তারপরও! আর জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে মাছ বিক্রেতা কোন কথা না বলে বিশাল এক ব্যাগ বের করে মাছ ভরতে লাগলো কোন দরদাম বা চাহিদার কথা না জেনেই! লোকটিও কিছু বলছেনা। অতপর মাছ বিক্রেতার কাছে থাকা বিশেষ আর সকল উৎকৃষ্ট মাছ এবং আলাদা করে রাখা আরও বিশেষ কিছু মাছ ভরে লোকটির সাথে থাকা ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিল!
লোকটি এরপর কত হয়েছে দাম জানতে চাইলে মাসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মাছ দেখতে থাকা জনকে হতবাক করে দিয়ে বলল ৮ হাজার টাকা দিন! লোকটি কোন কথা না বলে বা কোন রকম দামাদামি না করে কচকচে ৫০০ টাকার নোট বের করে গুণে দিল! হায়রে পাশে দাড়িয়ে থাকা জন হা করে শুধু দেখছে! আর মনে মনে হাসছে! তার সারা মাছের বাজার খরচের চেয়েও বেশী এই লোকের একদিনের মাছ কেনার খরচ! সে ওখান থেকে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আর একটি মাছে মাছে ভরপুর দোকানের সামনে। জেখানে মাছের ধরন আর পরিমাণ আগের দোকানের চেয়ে বেশ বেশী আর আভিজাত্যপূর্ণ!
এখানে এসে সে দাঁড়ালো। নাহ, এবার আর সে মাছ কেনা বা দাম জানার মত দুঃসাহস দেখানোর কোন চিন্তা করেনি। আগের দোকানের অভিজ্ঞতা থেকে সে জেনেছে আর বুঝেছে যে এইসব দোকানের মাছ তার সাধ্য নয় শুধু স্বপ্নসীমারও বাইরে। তাই সে এখানে এসে একে অনেক দেখছে আর দাম জিজ্ঞাসা করার পরে অন্যদের ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
এরপর সেই দোকানের কাছে এলেন এক সম্ভ্রান্ত ধরনের মহিলা, অন্তত কাপড়-চোপড় আর বাহ্যিক গেটআপে তেমনই মনে হবে যে কারো। এসে মাছ দোকানের সামনে শুধু দাঁড়ালো, এমনকি মাছের দাম বা ধরনও জিজ্ঞাসা করেননি, তাকে দেখা মাত্র দোকানদার অতি উৎসাহে উচ্ছ্বসিত হয়ে, আসে পাশের সবাইকে যেন বেমালুম ভুলে গেলেন! আর না চেনার মত পরিবেশ তৈরি করে, মহিলাকে সরবচ্চ সমাদর করতে লাগলেন।
“আরে আপা আপনি আসছেন, গাড়িতেই বইসা থাকতেন, নামলেন ক্যান, একটা ফোন দিলেই তো মাছ আপনার গাড়িতে চইলা যাইত! এই আপার লইগা বড় বড় ব্যাগ লইয়া আয় চার-পাঁচটা”। মাছ বিক্রেতার সহকারীকে আদেশ।
মহিলা-আরে না, আজকে মাছ নেবনা, দেখতে আসলাম কেমন মাছ উঠছে।
আরে কি কন আপা, আপনারা মাছ না নিলে আমরাতো ভাত না খইয়া মইরা যামু! এই ব্যাগ দে?
এই কথা বলে জত রকমের মাছ ছিল, প্রায় তার সব রকম মাছই তুলতে লাগলেন বিভিন্ন ব্যাগের ভিতরে। মহিলা বলতে লাগলেন যে তিনি সাথে করে টাকা আনেননি। শুধু মাত্র দেখতে এলেন! কিন্তু কিসের কি? মাছ ভরে চার চারটি ব্যাগ সহকারীকে দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসতে দিলেন। আর সহকারীকে বললেন মহিলার সাথে গিয়ে বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসতে। আর মহিলাকে জানিয়ে দিলেন যে মাত্র ১২০০০ টাকার মাছ দিয়েছেন তাকে! মহিলা মাছের ব্যাগ বহন করা ছেলেটির সাথে সাথে চলে গেলেন তার গাড়ির দিকে।
এরপর এমন আরও কিছু দোকানের আর সেই সব দোকানের মাছের অদ্ভুত আর অভাবনীয় বিকিকিনি দেখতে দেখতে সে হাপিয়ে উঠলো! আর সে যে আজ মাছ কিনতে এসেছিল তা বেমালুম ভুলে গিয়ে অবশেষে কিছু অন্যান্য বাজার করে, আশে পাশের জ্যান্ত মাছের জলকেলি সাথে নানা রকম পয়সাওলাদের পয়সার ঝনঝনানি দেখতে দেখতে বাসায় চলে গেল!
এরপর থেকে মাছের বাজারে কোন দরকার থাকলে সে সেটা অন্যকোনদিন আগে ভাগেই সেরে রাখে। সেও সন্ধায়, অফিস থেকে ফেরার সময় বা আর একটু রাতে। কারণ তখন মাছের দাম দিনের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ কম থাকে আর শুক্র বা শনিবারের ছুটির দিনের চেয়ে প্রায় অর্ধেক, কখনো কখনো এর চেয়েও কম থাকে!
তাই তার মাছ কেনার সময় হয় সন্ধা বা সন্ধার পরে, তবে সেটা শুক্র বা শনিবার নয় কিছুতেই! তবে হ্যাঁ সে প্রায় শুক্রবার মাছের বাজারে যায়, এই সব কীর্তন (!) দেখতে আর একা একা হেসে হেসে মজা পেতে! কিছুটা অদ্ভুত সুখ পেতে! ওই যে বিখ্যাত উক্তি আছেনা?
“ক্ষুধার্ত কুকুর, অন্যের খাওয়া দেখেও সুখ পায়!!”
ঠিক তেমনি “মাছ কেনার ইচ্ছা সাধ আছে, কিন্তু কিনতে না পেরে, অন্যের কেনা দেখেই সে সুখ পায়!!
তাই সেই বেচারার মতে, শুক্রবারের মাছ বা মাছ বাজার সবার জন্য নয়!!
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:৪৫