এখন পর্যন্ত সকল ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের বানী “সিমলায় দেখার কি আছে?!!” এই কথা শোনা! আচ্ছা সিমলাতে কি আসলেই দেখার কিছু আছে? না আসলেই নাই? কারণ আমরা আসলেই তো কিছু দেখিনি! তাই জানিনা যে সিমলাতে দেখার কিছু আছে কি নেই! কি বিশ্বাস হচ্ছেনা? চলুন গল্পটা জানি, কে? কেন? আর কি প্রেক্ষিতে বলেছিলেন যে সিমলাতে থাকতে হবেনা! সিমলাতে দেখার কি আছে!!
যে কথাগুলো আজও সকল ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হয়ে মনে-প্রানে ভ্রমণ ক্ষত হয়ে প্রতিনিয়মিত কষ্ট ও অসীম যন্ত্রণা দিয়ে যায়, মনে পরলেই! আর যে কথাগুলো ভ্রমণের পিপাসাকে অনিঃশেষিত তৃষ্ণায় রেখে দিয়েছে, আমৃত্যু।
২০১০ থেকে আমরা সিমলা-মানালি যাবো বলে শত-সহস্র পরিকল্পনা করে করে শেষ পর্যন্ত, কখনো দিল্লী, কখনো আগ্রা, কখনো কোলকাতা আর কখনো দার্জিলিং গিয়ে ফিরে আসি। আর ফিরে এসেই আবারও সিমলা-মানালির স্বপ্নের জাল বুনি, কল্পনার রঙিন আকাশ আঁকি, ভাবনার প্রজাপতির ডানা মেলি আর পরিশেষে বাস্তবতার বেড়াজালে আটকে গিয়ে ছটফট করি। কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। একবার, দুইবার বা তিনবার না, পাঁচ পাঁচবার সিমলা-মানালির স্বপ্ন কোন না, কোন জায়গায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পরে। কখনো বাজেটে হয়না, কখনো সময় কুলায়না, কখনো সঙ্গী-সাথি মেলেনা আবার কখনো সার্বিক পরিস্থিতি অনুকুল থাকেনা।
এভাবে তিন বছর কেটে যাবার পরে অনেক অনেক আর অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ২০১৪ সালে এসে সহস্র বাঁধা-বিপত্তি, সামাজিক-রাজনৈতিক আর আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে, কোলকাতা গিয়ে আবারো ধাক্কা! একজনের ‘উডল্যান্ডে” ঢুঁকে এক মায়াবিনীর মায়ার ফাঁদে পরে সিমলা-মানালির অর্ধেক বাজেট দিয়ে একটি জ্যাকেট কিনে ফেলা! সেসবকেও উপেক্ষা করে কলকাতা থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে করে দিল্লী। সেখান থেকে রিজার্ভ “জাইলো” তে করে অবশেষে সিমলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। প্রশান্তি আর প্রশান্তি! এক অপার্থিব সুখের অনন্য অনুভূতি।
একে একে দিল্লী জনাকীর্ণতা, পানিপথের ঐতিহ্য, হরিয়ানার প্রাচীনতা, পাঞ্জাবের শ্যামলীমা ছাড়িয়ে আর সন্ধার আলো-আধারী পেরিয়ে “হিমালয়ান মাউনটেরিয়ান হাইওয়ে” তে অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘেরা আর পাহাড়ে মোড়া পিচ ঢালা রাস্তা ধরে চলেছি চাঁদ আর তারা ভরা আকাশের পানে! হ্যাঁ আকাশের পানেই! এতো এতো উঁচুতে উঠছিলাম যে, মনে হচ্ছিল আকাশ ছুঁতেই চলেছি আজ! একপাশে পাহাড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে শত রঙের আলোর বিচ্ছুরণ, যতদূর চোখ যায় নববর্ষের রঙিন আয়োজনের বর্ণিলতা। অন্যপাশে খাড়া দিগন্ত ছোঁয়া আকাশ। এভাবে চলতে চলতে রাত ১০ টায় সিমলা পৌছালাম।
জানুয়ারির ১ম দিন, উহ সেকি শীত! যে শীতের ছোবলে সে রাতে চারপাশ দেখার সাধ আর ছিলোনা। কোন রকমে চারটা খেয়েই কে কোথায় আর কখন ঘুমিয়ে পরেছে তার খোঁজ আর কেউই রাখেনি বা সেই উপাও ছিলোনা। কখন যেন ভোঁর হল। দারুণ একটা ঘুমে সবাই বেশ ফুরফুরে। মনে-প্রানে দারুণ চঞ্চলতা, উত্তেজনায় সবাই টগবগ করে ফুটছে! সিমলা দেখার লোভে ৫ ডিগ্রী শীতও তখন উপেক্ষিত। সবাই যে যার মত ফ্রেস হয়ে প্রস্তুত। গাড়ি রেডি আছে। বের হব, কোন যায়গা থেকে নাস্তা খাবো তারপর আজ সারাদিন সিমলার প্রেমে হাবুডুবু খাবো! এমনই সাধ, সাধ্য আর সাধনা সবার মনে-প্রানে।
গাড়িতে উঠে পাহাড়ের বুকে-পিঠে খাঁজ কেটে তৈরি করা মিহি আঁকাবাঁকা আর ঢেউ খেলানো রাস্তায় দুলতে দুলতে আর চারপাশে পাইনের সুশোভিত, বরফে আচ্ছাদিত মোহময় মাদকতায় মুগ্ধ আর মগ্ন হয়ে বরফে বিস্তীর্ণ কুফরিতে পৌছালাম। কুফরিতে একটু এদিক-ওদিক করে কিছু সময় পরে যখন ঘোড়া বা পায়ে হেটেই এক অনিন্দ্য পাহাড়ের চুড়ায় ওঠার কথা হচ্ছিল, তখনি একজন বলে উঠলেন উপরে গিয়ে কি হবে? দেখার কি আছে ওখানে!! সেই বরফই তো? সেতো এখানেই আছে। যাক গেলামনা আর সেই বরফ চুড়ায়! একটা গেছে বাকিতো আছে আরও। তাহলে এবার নেমে গিয়ে নাস্তা সেরে সিমলা ঘুরতে শুরু করি।
একটা অসম্ভব সুন্দর চারদিকেই পাহাড় ঘেরা জায়গায় সকালের নাস্তা সারলাম। বের হয়ে সিমলা মুখি হতেই চোখে পরলো মানালি যাবার রাস্তার নির্দেশনা! এটাই কি তবে কাল হলো! এই নির্দেশনাই কি তবে ভ্রমণের অনন্ত আক্ষেপের কারণ হল?
কারণ মানালি যাবার রাস্তার নির্দেশনা দেখেই আমাদের অভিজ্ঞ, শ্রদ্ধেয়, বিজ্ঞ টিম লিডার ঘোষণা দিলেন,
“চল এবার আমরা সরাসরি মানালি যাই!”
“কেন সিমলায় তো কিছুই দেখলামনা! আগে সিমলা দেখা শেষ করি? তারপর মানালি যাবো”
এই কথা শুনে তিনি প্রতি উত্তরে যা বললেন তারপর আর কোন কথা থাকেনা। সবাই নিস্তব্ধ, স্তব্ধ, বাঁকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম! আর আমাদের গাড়ি সিমলা ছেড়ে মানালির পথে চলতে শুরু করেছিল। অথচ আমাদের কাছে ফুল টাইম গাড়ি আছে, থাকার জন্য নির্ধারিত হোটেল আছে, হাতে সময় আছে, সবাই সুস্থ আছে, কিন্তু তার কথা ফেলবে সেই সাধ্য কার আছে?
তবে কি ছিল সেই কথা?
তিনি বলেছিলেন.........
“সিমলায় দেখার কি আছে!!!”
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:২৭