প্রথমবার ভারত গিয়েছি। উত্তেজনায় বাংলার অনেক চাল্লু মালও তাই ধরা খেয়ে ছিলো সেবার। দিল্লী ষ্টেশনের পাশেই এক বটতলার ক্যাপের দোকানে। ১০ রুপীর রুমাল আর ২৫ রুপীর ক্যাপ, মোট ৩৫ রুপীর পন্য কিনতে হয়েছিল পাক্কা ৮০ রুপী দিয়ে! সেই বেদনা ভুলতে আর সেই ভণ্ড সাধুর খপ্পর থেকে বাচার উদযাপন করতে সবাই মিলে চলে গেলাম ইয়া বড় বড় লোহার কড়াইতে ফুটতে থাকা সীমাহীন গরুর দুধের রাবড়ি ও মিষ্টান্নর দোকানে।
কি খাবো, রাবড়ি না মিষ্টি? মিষ্টি নাকি রাবড়ি? মত-দ্বিমত করতে না করতে মতামত এলো মিষ্টিতো কমন একটা খাবার, রাবড়িটাই বরং আনকমন। সুতরাং দিল্লীতে এলাম অথচ রাবড়ি খেলামনা তা কি করে হয়। তাই মিষ্টি বাদ, রাবড়িতেই বেশী ভোট পড়লো। আর তাই রাবড়িরই অর্ডার দেয়া হল। সে কি গ্লাসের সাইজ, বিশাল বিশাল কাঁসার এক একটা গ্লাস! যার এক গ্লাসেই প্রায় এক লিটার রাবড়ি এঁটে যাবে! এতোই বড়!
একজন রাবড়ি খাবেনা। তার পছন্দ হয়নি। সে মিষ্টি খাবে। কিন্তু না, সবাই যা খাবে তাই খেতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, দিল্লী এসেছ অথচ রাবড়ি খাবেনা, সে কি করে হয়? তোকে রাবড়িই খেতে হবে। আমরা তো আছি নাকি? সুতরাং আমাদের পিড়াপিড়ি আর জোরাজুরিতে সে অবশেষে রাবড়ি নিল এবং নাক বন্ধ করে এক টানে শেষ করে দিল! প্রায় এক লিটার রাবড়ি! সবাই শেষ করলো। একজন তো দুই গ্লাস মেরে দিলো!
এবার শুরু হল খেলা, টালমাটাল অবস্থা! যে রাবড়ি খেতে চায়নি সে এবার টলতে লাগলেন! তার নাকি ভালো লাগছেনা। মাথা ঝিমঝিম করছে আর গা গুলিয়ে উঠছে! হাটতে পারছেনা। কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা, এক জায়গায় বসে থাকতে ইচ্ছা করছে! রাবড়িতে ধরেছে! আসলে অভক্তি করে খেয়েছে, তাই মানসিক একটা অসস্থি আর অস্থিরতায় ভুগছে। পুরোটাই মানসিক সমস্যা ছাড়া আর কিছুই না। তাকে নিয়ে কোন মতে ষ্টেশনে দাড়িয়ে থাকা দুরন্ত একপ্রেসে উঠে পরলাম। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগে ভাগেই।
দিল্লী শহরের জৌলুশ আর একটু উপভোগ করবো, তা আর হলনা। কি আর করার। থ্রি টায়ার আসনে গিয়ে তিনি রাবড়ির আর আমরা তার এটা-সেটা উদ্ধার করতে লাগলাম! রাবড়ি-ই খেতে পারবিনা তাহলে তুই ভারত এলি কেন রে? আর তার কথা ভারত এলেই যে যা পাব তাই খাব এটাই বা কেমন কথা? দুই যুক্তিই ঠিক। সুতরাং কেউই কাউকে ছেড়ে কথা কইছেনা।
ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন ছাড়লো। আর ট্রেনের সেই ঝাঁকুনিতে তার পেটেও ঝাঁকুনি লাগলো। যে কারণে কোন রকম নোটিশ ছাড়াই সে এক দৌড়ে টয়লেটে! গেলো তো গেলোই আর ফেরার কোন নাম নেই! প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেল, কিন্তু রাবড়ির আর খবর নাই! গেলো কই আসলে? আসলে সেই ভ্রমনে দিল্লীতে রাবড়ি খাবার পর থেকেই তার নাম হয়ে গিয়েছিল রাবড়ি! ৩০ মিনিট পরে রাবড়ি ফিরলো! এক জনের জিজ্ঞাসা, কিরে পুরা রাবড়িই কি ঝেড়ে আসলি নাকি? তার মুখে কোন কথা নাই। চুপ, একদম চুপ। মিইয়ে গেছে একেবারে।
কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই আবার দৌড়, এই দৌড় আর সেই দৌড়, পুরা রাবড়ি দৌড়! এরপর তার দৌড়ের নামই হয়ে গিয়েছিল রাবড়ি দৌড়! রাবড়ির, রাবড়ি দৌড়! রাবড়ি আসে রাবড়ি যায়, না বসে না সোয়, শুধু দৌড়ায় আর বাথরুমে যায়। তার এই রাবড়ি দৌড়ের সামান্ন সহায় হয়ে আমরা তিন তলার বদলে তাকে দোতালার বিছানায় স্থানান্তর করেছিলাম। ওই অতটুকুই।
এরপর বিভিন্ন রকম খাবার আসে সে আর কিছুই খায়না। তার খাবার সব আমরা খাই আর প্যাকেট করা খাবার গুলো সে তার ব্যাগের পকেটে! আমরাও যে ব্যাগে পুরিনি তা নয় একেবারে, অনেকেই হয়তো এটা করে থাকে।
বেশ সুন্দর-সুন্দর, ছোট-ছোট সব প্যাকেট। চা-কফি-চিনি-দুধ-জেলি-বিস্কিট সব কিছুর মিনি-মিনি সাইজের আকর্ষণীয় ক্ষুদে প্যাকেট। দুই একটা ব্যাগে না পুরে লোভ সামলানো মুশকিল! আরো যদি হয় প্রথম প্রথম ভ্রমন আর একেবারেই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা তো কথাই নেই। সুতরাং সেবার খাবার চেয়ে খাবারের প্যাকেট জাত মিনি মিনি সুলভ সংগ্রহেই বেশী ব্যাস্ত ছিলাম। উপরি হিসেবে ছিলো, রাবড়ির খাবার গুলো না খাওয়ার অতিরিক্ত বিলাসিতা!
সন্ধ্যা হল রাত, রাত থেকে ভোর, আর ভোর থেকে সকাল। ট্রেন লেট থাকতে সকাল গিয়ে পৌঁছালো পরদিন দুপুরে। সুতরাং ঘণ্টার হিসেবে একদিন না হলেও দিনের হিসেবে দুই দিন প্রায়। কারণ আগেরদিন বিকেল থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত সেই দুরন্ত একপ্রেসেই কাটালাম। আর আমাদের রাবড়ি? তার ছিল দুইটাই কাজ, টয়লেটে যাওয়া আর টয়লেটে যাওয়া-আসার অবসরের সময়টুকু শুয়ে বা ঘুমিয়ে কাটানো!
এভাবেই কেটে গেল তার দুরন্ত এক্সপ্রেসের দুই দিন! তাই দুরন্ত এক্সপ্রেসের সেই ভ্রমন টুকুর নাম দিয়েছিলাম......
একগ্লাস রাবড়ি ও দুরন্ত এক্সপ্রেসের দুইদিন!
কোলকাত্তাকা ল্যাড়কা, দিল্লীছে অ্যায়া...!! পরের গল্প
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৪৫