নিঝুম দ্বীপের নিঝুম ও শান্ত ভ্রমণের শেষদিন। সকালে ফেরার পালা, সবাই তোড়জোড় শুরু করলো। আমার মনের ভিতর খানিক খচখচ! কেননা, এবার তেমন কোন এডভেঞ্চার হলনা! আমি একটা ভ্রমণ করবো আর সেই ভ্রমণ এতটুকু এডভেঞ্চার থাকবেনা, সেটা মানতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। যাইহোক খুঁজে-খুজেও কোন অ্যাডভেঞ্চার এর উপায় বের করতে না পেরে বাইকের পিছনে চেপে রওনা হলাম।
ট্রলারে উঠে মোক্তারিয়া ঘাট এলাম, এরপর আবার বাইকে উঠলাম। কিন্তু মনের ভিতরের খচখচানিটা রয়েই গেল! এই ভাবনা, সেই ভাবনা, ভাবতে-ভাবতে জাহাজমারা চলে এলাম, এখানে গরম-গরম জলাপি আর চায়ের বিরতি নেয়া হল। জিলাপির অমৃত স্বাদ নিচ্ছি আর ভাবছি, কি করা যায়?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, আরে যে রাস্তায় যাব, সেই রাস্তাতো এতোটা ব্যাস্ত না, তেমন বড় বা ভারী যানবাহন ও তো চলেনা, তাহলে বাইকের পিছনে যে বসি, সেই বসাটা উল্টো দিকে ফিরে বসলেই তো একটা বেশ ভালো এডভেঞ্চার হতে পারে?
ভাবনাটা মাথায় আশা মাত্রই শরীরে সমস্ত শিরা উপশিরায় সেই রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেল! প্রতিটি রক্ত বিন্দু এই ভিন্ন ধর্মী রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে উঠলো! এবার আর আমাকে পায় কে? সুতরাং যে ভাবনা, সেই কাজ, কিন্তু ব্যাগ? ব্যাগের কি হবে, কোথায় রাখবো? এটাতো কাউকে দেয়াও যাবেনা। কারণ, অন্য সবার কাছেই তো তাঁদের ব্যাগ রয়েছে, এই বুদ্ধিও পেয়ে গেলাম! যে ব্যাগটা আমার বুকের সাথে আঁটকে নিয়ে, মানে পিঠের ঠিক উল্টো পাশে নিয়ে নেব, বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। আর সেই আনন্দে আরও একপিচ জিলাপি খেয়ে নিলাম!
সবাই যে যার ব্যাগ কাঁধে তুলছে, আর আমি আমার ব্যাগ বুকে তুলছি! সবাই-ই একটু অবাক হলো, কি ব্যাপার? “ব্যাগ পিঠের পরিবর্তে বুকে কেন ভাই?” “একটু পরেই দেখবেন, কেন?” সবাই যে যার বাইকে উঠে গেল। আমি একটু শেষে যেহেতু একদমই নতুন একটা অ্যাডভেঞ্চার, কিছুটা অসস্থিতো লাগছিলই।
যাই হোক উঠে পড়লাম পিঠ বাইক চালকের পিঠের সাথে মিশিয়ে দিয়ে আর ব্যাগ বুকের সাথে বেঁধে রেখে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল যখনই বাইক কোন বাঁক নেয়, তখনই আমি পরে যাই-যাই অবস্থা, বুকের ভেতর বেশ একটা ধড়ফড়ে ভাব শুরু হল! আর ভাবছি, পারবো তো?
আবার যেহেতু গ্রামের ইট ও মাটির রাস্তা (ফেরার রাস্তাটা বাইক চালকেরা সর্টকার্ট করে ফেলেছিল) সেহেতু বেশ উঁচু-নিচু আর কিছুটা প্যাচপ্যাচে কাঁদাও ছিল! তাই মাঝে মাঝেই এতো বেশী ঝাঁকুনি লাগছিল যে পরে যাই-যাই অবস্থা! আবার ব্যাগটাও ঠিক সেট হচ্ছিলোনা বুকের সাথে! আসলে মানসিক ভাবে তখনো শক্ত হতে পারিনি! তাই সিটের পিছনে সামান্ন বেরিয়ে থাকা স্টিলের রডই ছিল প্রাথমিক ভরসা! এভাবে ১৫ মিনিট চলার পরে, কিছুটা ভারসাম্য হলাম, বাইকের বাঁক, উঁচু-নিচুর ঝাকি আর ব্যাগের এদিক-সেদিক সরে যাওয়া থেকে।
ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারটা ছিল এই রকম... বাইক যদি ডানে মোড় নেয় তো আমাকে বামে ঝুঁকতে হত, আর বাইক যদি বামে মোড় নেয় তো আমাকে ডানে! আর উঁচু-নিচুর এবং বিপরীত মুখী কোন বড় যান এলে সতর্কতা মূলক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টা ছিল একটু অন্য রকম... সেটা হল আমার বাইকের পিছনে সব সময় আর একটা বাইককে রাখা, যেন তারা আমাকে আগে থেকেই সংকেত দেয়!
তো যেহেতু আমাদের পাঁচটা বাইক আছে, সেহেতু পালা করে কেউনা কেউ আমার বাইকের পিছনে ছিল সব সময়-ই! আর তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী যখন উঁচু-নিচু বা অন্য বড় কোন যান আসতো সাবধান হয়ে যেতাম, কিছুটা আড়ষ্টও! এভাবে চলতে চলতে প্রায় এসে গেছি, চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই কত কিলো এলাম, আর কত কিলো বাকি আছে?” এইতো আর পাঁচ কিলো বাকি আছে, আর প্রায় ২৫-২৭ কিলো আসছি।
এবার কোমর ধরে গেছে, আর ভালো লাগছেনা, এবার একটু সোজা হয়ে আরাম করে আয়েশে যাই! যে কারণে, বাইক চলন্ত অবস্থায়-ই সোজা হতে উদ্ধত হলাম, কিন্তু এ যাত্রা সবাই নিষেধ করলো, কারণ চলন্ত অবস্থায় পুরো দিক পরিবর্তন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ আর কষ্টকর আরও যদি হয় বাইকে উঠার ক্ষেত্রেই আনকোরা! তো কথাই নেই। কিন্তু না, আমি এই চলন্ত বাইকেই দিক ঘুরবো এবং ব্যাগও পিঠে নেব! যে কারণে চালককে শুধু বলা হল যে আপনি গতি একই রাখেন, শুধু উঁচু-নিচুটা একটু এড়িয়ে চলেন।
এবার শুরু হলো, নতুন যুদ্ধ! এক পা ঘুরিয়েছি তো অন্য পা আর ওঠেনা! কারণ কি? জুতোর বেল্টে কোথাও আঁটকে গেছে! এখন ছাড়াবো কিভাবে, বুকেতো ব্যাগ! সবাই এই বিষয়টা বাদ দিতে বলল, কিন্তু আমি দেবনা! যে কারণে বেশ ঝুঁকি নিয়েই, ব্যাগ খুলে মাথার উপরে ধরে, জুতোর বেল্ট ছাড়িয়ে, দিক ঘুরে সোজা হয়ে গেলাম, আর ব্যাগ মাথার উপর থেকে পিঠে রাখার সময় একদম পরে গেছিলাম বলে! পরলেও তেমন অসুবিধা হইতনা, কারণ পাশেই বেশ নরম কাঁদা যুক্ত ধান খেত আর অন্য পাশে টলটলে জলের পুকুর! সুতরাং একটু আধটু কাটা-ছেড়া বা ব্যাথা পাওয়া ছাড়া বড় ক্ষতির সম্ভবনা কমছিল!
যাইহোক, অবশেষে কোন রকম ঝামেলা বা দুর্ঘটনা ছাড়াই পৌঁছে গেলাম, হাতিয়া লঞ্চঘাটে আর সেই সাথে শেষ হল,
আমাদের নিঝুম দ্বীপের সার্থক ও স্মরণীয় নির্ঘণ্ট......!!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৩৭