অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, এমন একটা ভ্রমণ হবে, যেখানে... ছোটাছুটি করে, অল্প সময় অনেক দেখার পরিবর্তে, ধীরে-ধীরে অনেক সময় নিয়ে অল্প দেখা আর বেশী উপভোগ করার প্রয়াস। প্রায় প্রতিবার ভ্রমণের শেষেই পরবর্তী ভ্রমণটা উপরের মত করে করবো বলে মনস্থির করি। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনা...!
প্রতিবারই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে বিরামহীন ভ্রমণ ও দর্শনের অস্থির আকুলতা...! কিন্তু এবার আর তা হয়নি। সেই সুযোগই যে ছিলনা, ছুটে-ছুটে এদিক-ওদিক যাবার... “নিঝুম দ্বীপ” আমাদের দিয়েছে সেই পূর্ণতা...! শুধুই বসে থাকার আর দু-চোখ ভরে উপভোগের সেই অধরা বিলাসিতা...!
ঢাকা থেকে হাতিয়া ১৫ ঘণ্টার বিলাস বহুল লঞ্চ ভ্রমণ এর পর নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে যতক্ষণ থাকবেন ব্যস্ততাহীন প্রকৃতির বিশাল ব্যাঞ্জনা...! (মাঝের কিছু চড়াই-উৎরাই ছাড়া...!) আবার ফিরে আশার সময় সেই ১৫ ঘণ্টার নির্মোহ নীরবতা।
যেখানে পাশে ও সাথে থাকবেঃ সীমাহীন জলরাশি... উড়ে যাওয়া গাংচিল... চির সবুজ গ্রামের যাপিত জীবন... জেলেদের জলের আবাস... গোধূলির রঙিন আলো... আঁধার রাতের নীরবতা... নিজেকে, নিজের প্রশ্ন করার অবারিত অবসর... আর ব্যাস্ত জীবনের কিছু খণ্ডিত ক্ষণ। সাথে মনের মাঝে জমে যাওয়া কিছু গল্প। যা, অভিজ্ঞতা আর সৃতির সমন্বয়ে সাজানো কিছু অপরিপক্ক শব্দ-কথায় গাঁথা।
যাত্রা শুরুর ঠিক আগের রাতে এক সহযাত্রীর আত্মীয়র একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা...! মেসেজ দিলেন তিনি যেতে পারবেন না...! খানিক হতাশ সবাই-ই কিন্তু হাল ছেড়ে দিলাম না। অফিস থেকে তিনটায় বের হব এমনই ঠিক করলাম। সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাবে ঠিক ৫:৩০ এ। দুই জন আরও আগেই চলে গেছে। বাকি তিন। একজন বাসায় গেছে, তার প্রয়োজনীয় কাজ সারতে। একজন এখনো বসকে বলতে পারেন-নি একটু আগে বের হবার কথা। সময় তখন ২:৩০ মিনিট! এই কাজ, সেই কাজ, অযথা কাজ শেষ করতে প্রায় ৩:১৫ বেজে গেল! অবশেষে শত অনিচ্ছা আর প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে, সেই দুর্ঘটনা কবলিত জনও আমাদের সাথে...! নিঝুম দ্বীপ আর একত্রে কিছু প্রহর কাটানোর নেশায়...!
অফিস থেকে বের হতে-হতে ৩:৩০। লঞ্চ ৫:৩০ এ! সময় দুই ঘণ্টা। সাথে তিন দিনের ছুটির সকলের সার্বিক ব্যাস্ততা। তিন জন এক হতে-হতে আরও ২০ মিনিট...! সময় ৩:৫০...! রাস্তায় এতটুকু ফাঁকা নেই...! বাসে ওঠার মত পরিস্থিতি নেই...! একটিও সিএনজি ফাঁকা নেই...! কি করার আছে? শুরু হাটা আর পিছন ফিরে বাস বা সিএনজির জন্য আকুতি নিয়ে তাকিয়ে থাকা...! নেই, কিচ্ছু নেই...! ঘেমে-নেয়ে একাকার রামপুরা বাজার যেতে-যেতেই...!
এলো এক অরাধ্য ভিক্টর পরিবহন। উঠে পড়লাম ওতেই ঠেলে-ঠুলে...! গন্তব্য সদরঘাট। বেশ আছি ব্যাগ পিঠে নিয়ে। অন্য যাত্রীদের গালি শুনে...! “ওই মিয়ে ব্যাগ হাতে লন” “ভাই ব্যাগ টা নামান, আপনার ব্যাগের লইগা আমার একজন যাত্রী কম যাইতাছে” সুপারভাইজারের মন্তব্য!
সাথে সিগারেটের ধোঁয়া...! ধুলোর সাগর...! দাঁত না মাজা মুখের বিকট গন্ধ...! ঘামের ভেজা শরীরের ঘেঁষা-ঘেঁষি! ছিটের কোনা থেকে বের হওয়া টিনের খামচিতে গেঞ্জি ছিড়ে মাংসপেশী থেকে রক্তের ছিটে...! দমবন্ধ অবস্থার সাথে যোগ হল জ্যাম...! মালিবাগ পেরুবার আগেই...! অপেক্ষা ১০ মিনিটের। সময় ৪:২০ মিনিট...! যেতে হবে আরও বহুদুর...! প্রয়োজনের সময়ই কেন জ্যাম নিরন্তর...! আর কেনই বা আমার বা আমাদের সাথেই...! বিধাতার কাছে বিবেকের আর্তনাদ...!
অনেক জ্যাম, কখন ছাড়বে ঠিক নেই...! তবে কি নেমে হাটা শুরু করবো? যেই ভাবা, সেই কাজ, নেমে পড়লাম। কিন্তু হাঁয়, বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। নামা মাত্রই ছেড়ে দিল বাস...! মুহূর্তেই রাস্তা ফাঁকা, নিমিষেই চলে গেল চোখের পলকে বহুদুর...! সংক্ষিপ্ততম সহায় এক সিএনজি। গন্তব্য গুলিস্থান পর্যন্ত। কোন মতে ঠেলে-ঠুলে জিপিওর মোড়...! এদিকে একের পর এক ফোন... “কোথায় আমরা, কতদুরে?” আবার জ্যাম...! ১৫ মিনিট একই জায়গায়...! সময় ৫:০৫ মাত্র পচিশ মিনিটে সদরঘাট পৌঁছানো অসম্ভব।
অসম্ভব কে, সম্ভব করাই এডভেঞ্চারিষ্টদের কাজ...!! (সাথে যদি সহায় থাকেন সেই বিধাতা... সাধ্য কার ঠেকাবে...!) শুরু হাটা-দৌড়-ধাক্কা-লাফ-ঝাঁপ এই শহরের ইট-পাথর আর ইস্পাতের কঠোরতা উপেক্ষা করে...! আমাদের টিমের সবচেয়ে বিলাসী আর শান্ত-শিষ্ট জনও, এই পথে আমাদের মতই ঝঞ্ঝা মাড়িয়ে...! বাঁধা ভেঙে...! এক কাপড়ে...! উম্নাদের মত উত্তপ্ত... উল্লাসের নেশায়...! নিঝুম দ্বীপের নিরবতার নেশায়...!
কোনক্রমে ইংলিশ রোড...! ৫:২০! বাকি মাত্র ১০ মিনিট...! এবার দৌড় যে, যার মত, উদ্দেশ্য একজনও যদি গিয়ে পৌছাতে পারি তো লঞ্চ এর লোকদের বলে কিছু সময় যদি অপেক্ষা করানো যায়...! এবার শুরু ভোঁ দৌড়...! একে ওকে ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে, সিএনজির রডে পা দিয়ে... রিক্সার চাকায় ঠেস দিয়ে... কার এর বনেটে হাত রেখে লাফ দিয়ে ডিঙ্গিয়ে, ভেঙে-চুরে...! ৫:৩৫ এ সদরঘাট এ...!
আহ স্বস্তি! লঞ্চে একটা বড়-সড় বস্তু উঠছে, যে কারনে কিছুটা কালক্ষেপণ...! আসলে আমাদের এডভেঞ্চার আর নির্ভেজাল আনন্দের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে সময় আর সৃষ্টিকর্তার সহমর্মিতা......! থেকে গেলেই অসম্ভব ছিল। থেমে যাইনি তাই স্বার্থক হয়েছি। সুতরাং থেমে থাকা যাবেনা, কিছুতেই... কখনও-ই, যত বাধাই আসুক না কেন? এগিয়ে যেতেই হবে... সব বাঁধা ডিঙিয়ে........!
চলুন এর পরের পর্ব গুলোতে আপনাদের পুরো নিঝুমদ্বীপ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।
উল্লেখ্যঃ এই লেখাটার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন ছবি নেই, তোলার মত সময়, ইচ্ছা বা মানসিকতা ছিলোনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৪৫