আগ্রা পৌছালাম প্রায় ৪ ঘণ্টা দেরিতে, ট্রেন লেট তাই, তখন রাত প্রায় ১০ টা, শীতের রাত...... সুতরাং অনেক ঠাণ্ডা, এই প্রথম দেশের বাইরে ভ্রমনে বের হওয়া, যে কারনে, বেশী, বেশী ভালোলাগা, অতিরিক্ত আগ্রহ আর কিছুটা অস্থিরতা মিলিয়ে একটা মিশ্র নার্ভাসনেস অনুভূতি।
সেসব যাইহোক, একটু দুরেই একটি ভাল মানের হোটেল দেখে উঠে পরলাম, ফ্রেস হয়ে, খেতে বের হলাম, দারুণ, স্মরণীয় একটা ডিনার হল, (এখনও ওটাই ভ্রমণের সেরা ডিনার হয়ে আছে...), আমার পাগুলে চিন্তা, এখনই তাজমহল দেখতে যাব, কিন্তু রাতে নাকি বন্ধ! বিশেষ, বিশেষ রাতে খোলা থাকে...।
ফিরে এলাম সকালের অপেক্ষায়, ক্ষণ আর জায়না, রাত আর সরেনা, ভোঁর আর আসেনা, মনও আর মানেনা, কখন? কখন হবে ভোঁর? আমি হব তোর! শুধুই এক দিনের জন্যই! হোক তাই হোক, চোখ ভরে দেখাতো যাবে, মন ভরে উপভোগ তো করা যাবে, পাশে তো বসা যাবে, ছুঁয়ে তো দেখা যাবে, কিছু সময় তো কাটান যাবে। তোর পাশে, তোর সাথে, তোর ছায়ায়, শ্বেত পাথরের ভালোবাসার পরশে, মুগ্ধতায়, মোহাচ্ছন্নতায়, বাঁধা তো যাবে তোকে সীমাহীন মায়ায়!
কিন্তু রাত যে কাটেই না, এক, একটা প্রহর, যেন এক, একটা ঘণ্টা, প্রতি মিনিটে তিন-চার বার ঘড়ির দিগে তাকালে যা হয় আর কি? যেদিন ভাললাগার মানুষ কে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে ভেবেছি সেদিনও এতোটা ব্যাকুল, নির্ঘুম, সীমাহীন আনন্দের যন্ত্রণা! অনুভব করিনি! সহযাত্রীর ঝাড়ি খেয়ে বাতি নিভিয়ে ফেলতে হল, কিন্তু ঘুমকে কি আর তুই এনে দিতে পারবি! পারবিনা, সেতো তাজমহলের মায়ায় আঁটকে আছে!
কখন যেন, ভোঁর হল... কলের তলে, জলের শব্দে জেগে উঠলাম। একে বারেই সেই রকম সাঁজ দিলাম! অজ পাড়া গায়ের, উঠটি যুবকের অনাকাঙ্খিত বিয়ে হলে যা হয় আর কি! যে রকম রং,চং মেখে, সং সাঁজে, সেই রকম!
হোটেল থেকে বেরিয়ে, অটো রিক্সায়, গলি-ঘিঞ্জি পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত দারের কাছাকাছি, উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে ভরপুর, তাজের গেটের কাছে চলে এলাম, নিরাপত্তা সংক্রান্ত পাট চুকিয়ে, আবার চেক! কোন খাবার নেয়া যাবেনা, আছে কিনা তাই দেখবে এবার, আছে, বিস্কিট আছে...
“খাঁ কে যাইয়ে, অওর রাখকে যাইয়ে” চেকারদের একজনের মন্ত্যব্য...
“নে...... তুই-ই খাঁ” এই বলে দিয়ে দিলাম......
প্রথম গেটের সামনে যেতেই দেখা গেল তাকে, এতদিন যা শুধু দেখেছি পোস্ট কার্ডে, ক্যালেন্ডারে, সিনেমার গানে, এই বার নিজ চোখে! কিছুক্ষণ বোধহীন ছিলাম বোধয়!
মুল গেট দিয়ে প্রবেশ করেছি, একটু ছবি তুলব, কিন্তু তেমন কাউকে দেখছিনা, যাকে বলা যায়, বা বললেই তুলে দেবে এমন কেউ! এদিক-ওদিক তাকাই, হঠাৎ দেখি, আরে এই যে মমতাজ! তাজমহলে মমতাজ!! কিন্তু শাহজাহান কই? আছে সাথে একটা, একটু বলগা হরিন টাইপের।
দুই অসি (Australian), কিছুক্ষণ ওদের Observe করে পটিয়ে ফেললাম! এর পর... মমতাজ কে আমি নিলাম আর ওর বলগা কে আমাদের টিমের সাথে ভিড়িয়ে দিলাম, বাঃহ, বেশ তো... বলগাও খুশি, মমতাজও খুশি আর আমি...... তাজমহল আর মমতাজ একই সাথে কাছে ও পাশে পেলে কি হতে পারে....... আহ! তাজমহলে...... মমতাজের সাথে আমি......!!!
আরও বর্ণনা...... সেটা অবর্ণনীয়!! তাই থাক.......
তো হাঁটছি আর হাঁটছি, আমি আর মমতাজ! তাজমহলের উন্মুক্ত বাগান জুড়ে, সে শুনতে চায় বাংলাদেশের কথা আর আমি তার কথা! সে দেখে তাজের বিভিন্ন রূপ আর আমি দেখি তার উপচে পড়া রূপ লহরী! বুঝে উঠতে পারছিলাম না কাকে বেশী দেখবো তাজকে না যার জন্য তাজ তাকে! আমি নিশ্চিত, শাহজাহান বেঁচে থাকলে বেছে নিতে হিমশিম খেতেন কাকে সে তার এই অপার সৃষ্টি উৎসর্গ করবেন এই ভেবে, ভেবে...... কাকে বানাবেন তিনি, তার মমতাজ!
আমার চারপাশে শুধু মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা, সুন্দর আর সুন্দর, আমি বিস্মিত আর বিস্মিত দুটো একি সাথে পেয়ে... তাজমহল আর মমতাজ! সারাদিনে ক্ষুধাতো দুরের কথা, পানির পিপাসা পর্যন্ত পায়নি! পাবে কিভাবে, আমার সকল পিপাসা আর ক্ষুধা তো মিটছেই, রূপ দেখে-দেখে, রূপ খেয়ে-খেয়ে আর রূপের সাগরে তৃষ্ণা মিটিয়ে!
একবার হারিয়ে গেলাম, আমি আর মমতাজ! আমাদের দল থেকে, আমি কপট উদ্বিগ্ন, ওদের হারিয়ে ফেলার উৎকণ্ঠায়! মমতাজের জিজ্ঞাসা, আমি ভীত কিনা সঙ্গীদের হারিয়ে! সে ভীত নয়, চলে যাবে রাতে, তাদের নির্ধারিত হোটেলে।
আমি? ভীত! তুমি আছ না! কিসের ভয়! এবার সারাদিন কাটিয়ে দিলাম একি সাথে, তাজমহলের প্রতিটি কোনে, তাজের সমস্ত রূপ খুঁজে-খুঁজে নিচ্ছি, দেখছি আর আহ্লাদিত হচ্ছি......
কিন্তু তাজের এতো রূপ যে, তা দুই একদিনে তো পরের কথা, দুই-এক মাসেও সে সুধা পানে তৃপ্ত হওয়া যাবেনা! আমার তো মনে হল, শুধু তাজের বাগানেই একটি দিন কাটিয়ে দেয়া যায়, দুই পাশের দুই স্থাপনায় আরও এক-দুই দিন, আর তাজের মূল বেদিতেই কাটিয়ে দেয়া যায় দিনের পর দিন।
তার রং, রূপ আর শীতল ছোঁয়ায়! যমুনা পারেও একটি দিন অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে, সত্যি বলছি, তাজকে আমার সবথেকে ভালো লেগেছে, তাজের কাছে যেয়ে নয়! ছুঁয়ে নয়! বসে নয়! ইচ্ছেমত আস্বাদন করে নয়!! সব থেকে মোহাচ্ছন্ন হয়েছি, আগ্রা ফোরট থেকে তাজকে দেখে।
সে এক অন্য ভালোলাগা, শুধুই অনুভবের, ফোরট এর বেলকনিতে বসে, তার জানালা দিয়ে যমুনার পাড়ে তাজকে দেখা এক অদ্ভুদ অভিজ্ঞতা।
এ যেন সেই সব ভালোলাগার মত, যা আমরা পেতে চাইনা, নিজের করতে চাইনা, ভোগ করতে চাইনা, শুধুই ভালোবেসে যেতে চাই, অনন্ত, অসীম, অদ্ভুৎ আচ্ছন্নতায়!
এ ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা! যার কাছ থেকে ভালোবাসা চাইনা, কখনই না, শুধুই ভালোবেসে যেতে চাই.....................
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৯