মাধবকুণ্ড ঝর্ণার পানির পতন দেখতে পাহাড়ে চড়ার জন্য সাথে থাকা বন্ধুদের প্রস্তাব দিতেই একজন রাজী, ব্যাস আর কোন দেরী না করেই চলতে শুরু করলাম, ওই ঝর্ণাকে আজ ছুঁয়ে দেখবোই দেখবো। অন্য দুই জন গড়িমসি করছে যাবে কি যাবেনা, গেলে কিভাবে যাবে আর না গেলে কত সময় এখানে কাটাতে হবে একা-একা সেই ভাবনায়। সেই ভাবতে ভাবতে ঢাকা থেকে যাওয়া বন্ধুও যেতে রাজী হয়ে গেল। রইলো বাকী স্যুট-টাই পরিহিত সিলেট প্রবাসী। সে ক্যামনে যাবে এখন?
এইবার আমরা আরও মজা নিতে লাগলাম, কারণ ওকে যদি পাহাড়ে উঠতেই হয় বা যদি আমাদের সাথে ঝর্ণার উৎসে যেতেই চায় তো স্যুট-টাই তো এবার খুলতেই হবে মামা! এবার তোর কি হবেরে পাগলা! এবার কোথায় যাবে তোর স্যুট-টাই এর আত্নসম্মান আর বাহাদুরি? খোল এবার স্যুট-টাই তার পর উঠতে শুরু কর পাহাড় বেঁয়ে উপরের দিকে। ধরে গাছ-ঘাস-লতা-পাতা-শিকড়-বাকড় আর খামচে ধরে পাথর-মাটি। হেটে-শুয়ে-গড়িয়ে-কোথাও দিয়ে হামাগুড়ি!
এবার আমাদের টিটকিরি আর অবজ্ঞা গাঁয়ে মেখে সেও উঠতে লাগলো, তবে তার সেই স্যুট-টাই না খুলেই! যতটা না আত্নসম্মান তার চেয়ে বেশী ছিল জেদ আর একরুখো মনোভাব, আমাদের আর বিনোদনের কারণ হয়ে আনন্দের খোরাক হতে চায়না। স্যুট-টাই তো আমাদের কাছে পুরনো আর সহনীয় হয়ে গেছে, এখন খুলে ফেললেই তো ওর রক্ষে নেই! সেই ভঁয় আর সম্মান হারানোর আশঙ্কায় সে আর তার স্যুট-টাই খুললই না!
তাই সেই স্যুট-টাই পরেই এবার সে ট্রেকিং করতে শুরু করলো! অভাবনীয়, হয়তো এটাই একটা বিশ্ব রেকর্ড হলেও হতে পারে, যে পুরো ফরমাল পোশাকে কেউ পাহাড়ে ট্রেক করেছে কোনদিন! ১০ মিনিট যেতে না যেতেই স্যুট আর স্যুট রইলনা! কাঁদা-মাটি আর গাছের ছাল-বাঁকলের ঘসা লেগে ওটা বস্তায় রূপ নিল! কি ভয়াবহ আর অসহনীয় সেই দৃশ, কল্পনাতীত!
আর টাই? গলায় বাঁধা সিল্কের লাল টকটকে টাই যেন মুখ ও কপালের ঘাম মোছা গামছা! ইস কি করুন আর দম বন্ধ হওয়া সেই মুহূর্ত গুলো! মনে পড়লে আর ভাবলে বা সেই তিন বন্ধু এক হলে এখনো দম ফাটানো আর অট্ট হাসির রোল পরে যায়, অবিরত! এ আমাদের চিরন্তন হাসির আর বিশুদ্ধ বিনোদনের অনন্ত উৎস!
স্যুট যেন পারলে ওই টাই দিয়ে গলায় দড়ি দেয়! অপমানে-অসম্মানে আর অবহেলায়, যেন হাহাকার তোলা চিৎকারে সেই স্যুট বলছিল......
“আমাকে একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে দে, তবুও কিছু সম্মান আর মর্যাদা অবশিষ্ট থাকুক! তোর গাঁয়ে আর রাখিস না আমায়! আমাকে ওই মাটিতে অন্তত ফেলে দে!”
আর টাই যেন বলছিল......
“আমাকে গলা থেকে খুলে ফেলে, তোর কোমরে বেঁধে ফেল! অন্য কোন মানুষ দেখার আগে! যেন তারা অন্তত আমাকে টাই বলে চিনতে না পারে! নইলে আমাকে পুড়িয়ে ফেল! ছাই করে উড়িয়ে দে! তবুও তোর গলায় আর রাখিস ঝুলিয়ে!”
এই সব স্যুট-টাই এর ব্যাথা-বেদনা আর অনুনয়-বিনয় শুনতে-শুনতে বা ভাবতে-ভাবতে একটি পাহাড়ের উপরে উঠে পড়লাম, এবার আবার নিচে নামতে হবে, আমারা নিচে নামা শুরু করলাম, তিন জনে নিজেদের টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামালাম কোন মতে গাছের ডাল, শেকড়-লতাপাতা-ছোট গাছের মগ ডাল, পাথর মাটি মাড়িয়ে। কিন্তু আমাদের স্যুট-টাইওয়ালা! তিনি আর নামতে পারছেন না!
কারণ স্যুট পরে তো মোটামুটি সোজা হয়েই থাকতে হয়, তাইনা? হাত-পা তো আর ছড়ান যায়না ইচ্ছে মত, যায় কি? ভেবে দেখুন তো?
এবার যেটা হল, এক হাতে কোনমতে একটা ডাল ধরলেও অন্য হাত আর সামনে বা পিছনে নেয়া যায়না, ফিটিং স্যুট সেটা আর হতে দেয়না, হাতকে টেনে রাখে নিজের কাছে, নিজের সম্মানার্থে! স্যুট এবার তার অসম্মানের শোধ তুলছে যতটা পারে! আবার হাত উপরেও তোলা যায়না ঠিকঠাক মত! যায় কি?
কিন্তু কিছু তো করার ও নেই, তাই স্যুটের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এবার হাত-পায়ের ব্যাবহার শুরু করতেই, স্যুটের ডান বগল প্যাত করে ছিড়ে গেল! না যেন সে নিজেই আত্নহত্যা করে নিজের জীবন বাঁচালো! আহ, একটি স্যুটের কি করুন পরিনতি, সাহিত্যের ভাষায় আমরা যাকে ট্র্যাজেডি বলি! ঠিক তেমনই!
এবার সেই ছেড়া স্যুট পরে মাটিতে বসে পরে সরসরিয়ে নামতে লাগলো, কিন্তু বাঁধ সাধলো গলার লাল মসৃণ টকটকে লাল টাই! সেই জড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো একটি গাছের শিকড়কে পরম মমতা আর মায়ার সুকরুন বাঁধনে! তাই স্বাভাবিক ভাবেই গলায় হ্যাঁচকা টান লাগলো! আর এই হ্যাঁচকা টানে ক্ষেপে যেয়েই আমাদের সেই বন্ধু অবশেষে খুলে ফেলল তার সাধের স্যুট আর টাই!
অবশেষে ধুয়ে দিয়ে সব মান-সম্মান আর তুচ্ছ-ঠুনকো-ক্ষীণ নিজ মনগড়া আভিজাত্য! হাঁয় আভিজাত্য এমনই হয়, যদি নাহয় সত্যিকারের...!
এবং আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই আমরা বয়ে যাওয়া ছরা ধরে পানির স্রোতের দিকে যেতে-যেতে শুনতে পেলাম ঝর্ণার ঝমঝমে শব্দ, মানে আমরা পৌঁছে গেছি আকাঙ্ক্ষার খুব কাছাকাছি। হ্যাঁ আর প্রায় ১০ মিনিট যেতেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই পাহাড় ও ঝর্ণা ছুঁতে না পারার আক্ষেপ ঘোচাতে।
খুব করে, কাছ থেকে, দেখে-ছুঁয়ে-শুয়ে-গড়িয়ে আর ইচ্ছেমত স্বাদ মিটিয়ে পাহাড় আর ঝর্ণা দিয়ে।
আহ কি সুখ! কি সুখ! কি অপার সে প্রাপ্তি!
শুধুই অনুভবের............
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২২