পাহাড়ের এতো-এতো কাছে গিয়েও ওকে না ছুঁয়ে, পাহাড়ের গাঁ ঘেঁসে চলে আসার আক্ষেপ সাথে নিয়ে আর অনিন্দসুন্দর জাফলং কে বিদায় জানিয়ে আমরা আবারো সিলেট শহরের পথ ধরলাম, শেষ বিকেলের স্বপ্নিল আভা মাখা সূর্যাস্ত আর সেই ওপাড়ার সুন্দরীদের দূরে দাড়িয়ে থাকা দেখে-দেখে একদিন ছোঁব-ই ছোঁব বলে মনে-মনে আশা বেঁধে চলতে শুরু করলাম।
সকালের সেই অবাধ্য কুয়াশারা শেষ শীতের পড়ন্ত বিকেলের আভাস পেতেই যেন ছুঁটে এসেছে এই পাহাড় ঘেরা পথটুকুর দখল নেবে বলে। হঠাৎ করেই পাহাড় গুলোকে কুয়াশার চাদরে ঢেকে দিয়ে মেঘ আর কুয়াশার সেকি উল্লাস আর আলিঙ্গন! যেন সারাদিনের অবাধ্য রোদের কাছে হেরে যাওয়ার আক্ষেপে প্রলেপ দিচ্ছে! আর আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি আসছে সাথে কিছু শ্লেষ যে তোদের আর পাহাড় দেখতে দেবনা, এই দ্যাখ থেকে দিয়েছি, ঘোমটা টেনে!
তাই আমরাও পরাজয় মেনে নিলাম ওই ঘন মেঘ আর পুরু কুয়াশার কাছে, সেই সাথে সারাদিনের ক্লান্তি মিলেমিশে ঘুমের কোলে অজান্তেই! চোখে মেলতেই জাঁকজমকপূর্ণ সিলেট শহরে। সুরমা নদীর ব্রিজের উপরে। সেখানে কিছু কমলা বা মালটা জাতীয় খেয়েদেয়ে, আমাদের আবাসে। গিয়ে আবার রান্নার প্যাড়া আছে।
রান্না-খাওয়া আর এই-সেই গল্পে-গল্পে রাত নিঝুম হল, আর আমরাও পর দিন অনেক গল্প শোনা আর ঝনঝনে ঝর্ণার প্রসবন সমৃদ্ধ উত্তাল আর অবিরাম বয়ে ছুটেচলা মাধবকুণ্ড দেখতে যাবো। আমাদের আজকের সিএনজির সাথে সেরকম কথা দিয়েই ঘুমোতে গেলাম। কখন ঘুমোতে গেলাম, কখন ঘুমোলাম আর কখনই বা সকাল হল কিছুই জানলাম বা বুঝলাম না! শুধু বুঝলাম যে রাত শেষ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই!
আবারো সেই আগের সকালের মতই আমাদের বন্ধু যথারীতি স্যুট-টাই পরেই রেডি মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে! সিএনজি তে যাচ্ছি আর আমরা তিনজন মিলে সিলেটপ্রবাসী বন্ধুকে ধুয়ে চলেছি ইচ্ছামত কারণ তার এই স্যুট-টাই পরেই ঝর্ণা দেখতে যাওয়া, কিজে অমানুষিক আর চোখের জন্য অসহনীয় সেটা ভুক্তভুগি ছাড়া কেউ ভাবতেই পারবেনা। আজ আর ওকে ইচ্ছামত ঝাড়তে কোন বাঁধা নাই, কারণ আজ রাতের ট্রেনেই আমরা ঢাকা ফিরে যাব, মাধবকুণ্ড দেখে এসে। তাই ওর ওখানে আর থাকা লাগবেনা, সেই সুযোগে ইচ্ছা মত, যত খুশি তত পচাতে লাগলাম।
সে যাই হোক, এক সময় গ্রাম-গঞ্জ আর মফস্বলের মেঠো পথ পেরিয়ে চা বাগানে আর ছোট-ছোট টিলার পথ ধরলাম, মানে মাধবকুণ্ড আর বেশী দূরে নেই। মনে দারুণ উত্তেজনা আর চোখের চাতক চাহুনি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম অনেক-অনেক গল্প শোনা ও ছবি দেখা মাধবকুণ্ড ঝর্নাকে নিজ চোখে দেখার আকুলতা নিয়ে। আর যদি ছুঁয়ে দেখতে পারি একটু, ভিজিয়ে নিতে পারি নিজিকে তো কথাই নেই, পাহাড় ছুঁতে না পারার আক্ষেপ কিছুটা হলেও দূর হবে।
ধুলো ওড়া কাঁচা পথ পেরিয়ে আর চা-বাগানের আতিথিয়তায় আপ্লুত হয়ে আমাদের সিএনজি থেমে গেল মাধবকুণ্ড ঝর্ণা লেখা ইট-পাথরের গেটে! যেতে হবে হেটে বেশ কিছুটা পথ। টিকেট কাটার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আর সামান্য কিছু খাবার সাথে নিয়ে পথ চলতে শুরু করলাম। বামে বেশ খাড়া পাহাড়-প্রাকৃতিক জঙ্গল-ঘন গাছপালা আর সামনে এগোতেই যেন গভীর অরন্য।
একটু দূর যেতেই যেন কান ফাটানো চিৎকার শুনে শরীরের সমস্ত রোমগুলো খাড়া হয়ে গেল নিজের অজান্তেই! থমকে দাঁড়ালাম কয়েক মুহূর্ত, কেন আর কিসের এমন আর্তনাদ আর একটু শুনে বুঝে ওঠার জন্য। পাশের মানুষ জনের কথোপকথন থেকে বুঝে বা জেনে নিলাম যে ওটা ঝর্ণার-ই হুঙ্কার বা গর্জন। অবিরাম পানির স্রোত অনেক উঁচু থেকে পাথরে উপরে পরে সৃষ্টি হওয়া এক শুতিমধুর ব্যাঞ্জনা।
এবার আর তর সইছেনা কতদ্রুত ওখানে পৌছাবো, দেখবো আর পারলে একটু খানি ছোঁয়া নেব। তাই দ্রুত আর খুব দ্রুত পা চালাতে লাগলাম সবাই মিলেই, রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা এবার ছুঁয়ে গেছে সবাইকেই। তাই কে কার আগে গিয়ে দেখতে বা ছুঁতে পারে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হল!
যত এগোচ্ছি সামনে ঝর্ণার মূর্ছনা যেন আনন্দের গর্জনে রূপ নিতে লাগলো। বিকট আর উত্তাল বিস্ফোরণ যেন ঘটে চলেছে একটু দুরেই। দূর থেকে এক ঝলক দেখা গেল সাদা কুয়াশার মত ঝরে-ঝরে পড়ছে অবিরাম গাছ ও পাতার ফাঁক গলে। দেখেই গাঁ ছমছম করে উঠলো! শিউরে উঠলাম খুশি আর আনন্দের উত্তেজনায়! দেখে ফেলেছি পরম প্রার্থিত কিছুকে। শুধু আলিঙ্গনের অপেক্ষা মাত্র! এখানে নিশ্চয়ই আর কোন বাঁধা থাকবেনা।
সেই অবিরাম পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা যেন সূর্যের আলো মেখে আরও রঙিন আর বর্ণিল হয়ে উঠলো সেই ঝর্ণার বর্ণনা দেবার মত সাহস বা শব্দের ভাণ্ডার আর ব্যাবহার আমার জানা নেই বা সাধ্যে কুলাবে না, তাই আমার অগোছালো শব্দ-কথার সীমিত বেড়াজালে বেঁধে ওর অসীমতাকে ছোট বা হেয় করার দুঃসাহস দেখালাম না। ওটা নিজ থেকে গিয়ে-দেখে-ছুঁয়ে আর আবেগ দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করতে হবে।
কিন্তু সেই ঝর্ণার কাছে যেতেই আমার চোখ নিচে না গিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলো অবিরাম, ক্লান্তিহীন বেশ-বেশ কিছু সময়। আর সেই সাথে মাথার ভিতরে পাগলামি খেলা করতে শুরু করলো। আরে ওই ঝর্ণা যেখান থেকে পড়ছে, ওটা তো খুব বেশী উঁচুতে নয়, ওখানে যাওয়া যায়না? এক জনকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ যাওয়া যাবেনা কেন, একটু ঘুরে অন্য পাহাড়ে চড়ে ওখানে যেতে হবে, তবে বেশ সময় লাগবে”।
এই কথা শুনে উপরে তাকাতেই দেখি সেখানে দুই-তিন জন হাজির, আর জয়ের উল্লাসে উন্মাদনা শুরু করে দিয়েছে ওখান থেকেই।
এবার আর পাহাড় ছোঁয়া আর ওর আলিঙ্গনে বাঁধা থেকে রুখবে আমায় কে?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৭