দুপুরের খাবার আর রাতের বাজার করে, একটু এদিক-সেদিক করে বন্ধুর প্রাসাদে পৌছাতে-পৌছাতে সন্ধার হাঁকডাক আর কুয়াশার সাদা চাদরে ঢাকা পড়ে গেল চারিদিক! আর ঝুপ করে নেমে আশা অন্ধকার আমাদের ঘরেই আবদ্ধ করে রাখলো। সেই সাথে ছিল সারাদিনের ভ্রমন ক্লান্তি। তাই পরের দিন জাফলং যাবো এই টুকু ভেবে, কথা বলে আর খেয়েদেয়েই চার বন্ধু মিলে সেই পুরনো প্যাঁচালের নির্ভেজাল বিনোদনে ডুব দিলাম, সাথে আছে বস্তাপচা সব আবোল তাবোল আর উদ্ভট মানহীন আতলামি আর সেই বন্ধুর ছেড়া শত-সহস্র জোড়াতালি ও শেলাই দেয়া............!!!
খুব-খুব আর খুব ভোরে লেপের উষ্ণতা ছেড়ে আর শীতের হৃদয়হীন ছোবল উপেক্ষা করে ফ্রেস হয়েই বেড়িয়ে পড়া, তাড়াতাড়ি সিএনজি ঠিক করে বেড়িয়ে পড়তে হবে জাফলং এর উদ্দ্যেশ্যে, কারণ আজকে গিয়ে আজকেই ফিরে আসতে চাই। আমাদের সিলেট নিবাসি বন্ধুও এর আগে জাফলং যায়নি, তাই তারও আগ্রহ অপার। কিন্তু ওর দিকে তাকিয়েই আমরা তিনজন হা হয়ে গিয়েছিলাম!
কেন? কারণ তিনি যাচ্ছেন ভ্রমণে অথচ পড়েছেন পুরো ফরমাল পোশাক! শার্ট-প্যান্ট ইন করে, টাই! (ক্লিপ সহ!!) কালো স্যুট!! শার্টে আবার কাফ্লিং...!! “ওহ মাই গড তুই করছিস কি বাপ? তুই কি অফিসে যাবি? মিটিং আছে নাকি আমাদের সাথে জাফলং?” নারে দোস্ত আমি এখানে শিক্ষক মানুষ, তার উপর ছাত্রীরা আছে, আমার ইমেজের একটা ব্যাপার! আমি ফরমাল পোশাক ছাড়া বাইরে যাইনা...!! বলিস কি? তাই বলে ভ্রমনেও!
আর শালা তোর মেয়ে রোগ গেলনা না? তুই কি মনে করিস কোন মেয়ে তোর দিকে তাকালো মানেই কি তোর প্রেমে পড়ে গেল! আর তোর এই স্যুট টাই পড়া না দেখলে মেয়ে বা তোর ছাত্রীদের বাবারা তোকে রিজেকট করে দেবে? তুই কি পাগল নাকি? শোন সবাই তোর প্রেমে পরেনি, ইনফ্যাকট শুনতে কষ্ট হলেও বলি, কাউকেই দেখে আজ পর্যন্ত আমাদের মনে হয়নি যে তোর প্রেমে পড়েছে!! তুই এটা একা-একাই ভাবিস! তোর দিকে কেউ তাকালে বা একবার তাকিয়ে হাসলেই তুই মনে করিস যে তোর প্রেমে পড়েছে! জত্তসব।
তো তিনি সেভাবেই যাবেন, নতুবা নয়! তাই বাধ্য হয়েই আমরা ওকে অভাবে নিয়েই রওনা হলাম পাছে আবার ফ্রি থাকার জায়গাটা হারাই! সেই আশঙ্কায়! কিন্তু বাসা থেকে বের হয়েই বিক্ষুদ্ধ মন আরও বেশী বেদনায় ছেয়ে গেল কুয়াশার বায়না দেখে! কুয়াশায় ঢেকে আছে চারিদিক। কিছুই দেখা যায়না। তাহলে জাফলং যেতে-যেতে দূরের পাহাড় আর অসংখ ঝর্ণার নাচন কিভাবে দেখবো? সেই সাথে নিল আকাশ আর সাদা মেঘেদের দল বেঁধে ছুটে চলা? তাই মন খারাপকে বুকে বেঁধে আর কুয়াশার সাথে ঝগড়া করতে-করতে পথ চলতে শুরু করলাম, শীতের বাতাসে গুটিশুটি মেরে আর বিষণ্ণ মনের বিষাক্ত ভাবনায়! কিছুই দেখা হলনা বা হবেনা সেই ভাবনায়।
খুব ধীরে-ধীরে পথ চলছি কুয়াশার বাঁধা আর শীতের বাতাসকে উপেক্ষা করে, পীচ ঢালা-মিহি আর আঁকাবাঁকা বেশ-বেশ নান্দনিক পথ ধরে। কিন্তু কুয়াশাতো কাটছেইনা বরং আরও ঘন ও অন্ধকার নামাচ্ছে! আজ যেন কুয়াশারা বায়না ধরেছে যে এই পথেই থাকবে, সূর্যকে উঠতে-দেখতে বা আমাদের অবলোকন করতে দেবেনা পাহাড়-ঝর্ণা-নদী-বা নির্মল সবুজের হাতছানি। কি যন্ত্রণা, কি কষ্ট আর কি ব্যাথা বোঝাবার নয়।
কিন্তু রোদ যে কুয়াশার বায়নার চেয়েও অবাধ্য, ও যদি উঠতে চাই, যদি ছড়াতে চায় ওর বিভা কে আছে আড়াল করবে, কোন বায়নাই সূর্যের অবাধ্যতার কাছে মার্জনা পাবেনা, তাই ৩০ মিনিট যেতে না যেতেই সূর্য হেসে উঠলো তার পরম উষ্ণতা আর অপার আনন্দ নিয়ে। আর আমাদের বিমুঢ়তা দূর করে আবারো উচ্ছল হয়ে উঠতে। সেই সাথে দেখাতে সবুজে-সবুজে সাজানো, সুশোভিত আর সৌন্দর্যের সব রূপ মেলে ধরা সিলেটের পাহাড় ঘেরা পথ, দূরের জল ও জলহীন শুকনো ঝর্ণা, বয়ে চলা লাজুক নদী, রুক্ষ কিন্তু সুন্দর অল্প পাতায় সজ্জিত চা বাগান, একদম মসৃণ পথ, এঁকেবেঁকে বেঁয়ে চলা ঢেউ খেলানো নদীর মত! কখনো-কখনো ধবধবে সাদা মেঘেদের ছুটে যাওয়া, যেন এই একটু লাফ দিলেই ছোঁয়া যাবে! হ্যাঁ সে হয়তো যেত মেঘকে ছোঁয়া তবে সেক্ষেত্রে পড়ে যেতে হত প্রায় হাজার ফিট নিচে! কারণ ঠিক ঠিক পাহাড়ের ওপাশেই মেঘেদের হেটে বেড়ানো, রাস্তা বা সমতলে নয়।
তাই দূর থেকেই দেখি-দেখি আর দেখি, শুধু দেখেই এতো সুখ-আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছুঁতে পারলে যেন বিলীন হয়ে যেতাম! দূরে বেশ দূরে কত বড়-বড় আর উঁচু-উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের শরীর চিড়ে চিড়ে বেরিয়ে আশা ঝর্ণা! কতশত! শীতেই এতো ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে, বর্ষাতে তো শকত ঝর্ণা হাজারে গিয়ে পৌঁছাবে নিশ্চিত! এর আগে কখনোই পাহাড় দেখিনি তাই ওই অন্য দেশের আর দূরের পাহাড়ের প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম, অন্য পাড়ার কোন মেয়ের প্রেমে পড়ার মত! শুধু দূর থেকে দেখে-দেখে সুখ পেয়ে যাবি, ধরতে-ছুঁতে বা নিজের করে পাবিনা! কিন্তু নিজের অজান্তেই গান ধরেছিলাম...
“এ আকাশ কে সাক্ষী রেখে, এ বাতাস কে সাক্ষী রেখে তোমাকে (পাহাড়কে) বেসেছি ভালো......”
ডানে পাহাড় আর বামে টলমলে স্বচ্ছ নদী দেখতে দেখতে আর রুক্ষ কালো, মায়াবিহিন, কর্কশ কালো কয়লার স্তূপে স্তূপে আচ্ছাদিত তামাবিল পেরিয়ে আবারো নির্মল সৌন্দর্যের আকাশ-মেঘ-মৃদু কুয়াশা-ঝিরঝিরে শীতল বাতাস-চারদিকের সবুজের বন বনানী আর সর্বোপরি পাশের পাড়ার সুন্দরী মেয়ে বা দূর পাহাড়ের আহবানে আহ্লাদিত হয়ে পৌঁছে গেলাম এক নতুন আর অন্য রকম সৌন্দর্যের জাফলং এ......!
ঝলমলে জাফলং ও টলমলে জলের কলতান...... (পরের গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৯